চট্টগ্রাম নগরীতে দিনে ১৫ ডিভোর্স!

গত দেড় বছরের বেশির ভাগ সময় করোনা পরিস্থিতির জন্য ঘরবন্দী ছিল মানুষ। তার আগের বছরগুলোতে ব্যস্ত থাকা লোকগুলোর কাছে সুযোগ আসে পরিবারকে সময় দেওয়ার। কিন্তু টানা ঘরে থাকতে থাকতে হিতে বিপরীত হয়। অনেক ক্ষেত্রে বেড়ে যায় সাংসারিক নানা জটিলতা। এর মধ্য দিয়ে ভাঙছে সংসার।

অবশ্য গত কয়েক বছর ধরেই সারা দেশে বৃদ্ধি পাচ্ছিল বিয়েবিচ্ছেদের ঘটনা। ব্যতিক্রম ছিল না চট্টগ্রামও। তবে করোনাকালের কঠিন সময়ে বৃদ্ধির গতি ছিল বেশি।

যেমন চলতি বছরের প্রথম সাড়ে আট মাসে নগরে দৈনিক ১৫টি বিয়েবিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) সালিসি আদালতে। যা ২০২০ সালে ছিল ১৩টি। ওই বছরও করোনার জন্য বেশিরভাগ সময় ঘরবন্দী থাকতে হয়েছে লোকজনকে।

এর আগে ২০১৪ সালে দৈনিক ৮টি, ২০১৫ সালে ৯টি, ২০১৬ সালে ও ২০১৭ সালে ১০টি করে, ২০১৮ সালে ১১টি এবং ২০১৯ সালে ১২টি আবেদন জমা পড়েছে। চলতি বছরের এখনও সাড়ে তিন মাস বাকি। ধারণা করা হচ্ছে, এ সংখ্যা আরও বাড়বে।

করোনাকালে বাধ্য হয়ে ঘরবন্দী থাকার সময় স্বামী-স্ত্রীর দোষ-ত্রুটি সহজেই একে অপরের চোখে পড়ছে। অন্য ব্যস্ততা না থাকায় পরস্পরের দোষ-ত্রুটি ভুলে থাকার মাধ্যমে সমঝোতার পথও এসময় সংকুচিত হয়ে পড়ে। ফলে বেড়েছে বিচ্ছেদের ঘটনা। অবশ্য মানসিক চাপের পাশাপাশি করোনাকালে অর্থনৈতিক সংকট ও সামাজিক চাপও সংসার ভাঙার জন্য দায়ী।

সিটি কর্পোরেশনের সালিসি আদালতে ২০১৪ সালে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য ৩ হাজার ২৬৮ জন আবেদন করে। চলতি বছর প্রথম আট মাসেই তা ছাড়িয়ে গেছে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন হাজার ৫৭২ জন আবেদন করেন। অর্থাৎ গড়ে প্রায় ১৫টি আবেদন পড়েছে। ওই ধারা অব্যাহত থাকলে সাত বছরের ব্যবধানে বিয়ে ভাঙার হার প্রায় দ্বিগুণ হতে পারে।

এছাড়া ২০১৫ সালে তিন হাজার ৪৮৬ জন, ২০১৬ সালে তিন হাজার ৯৬১ জন, ২০১৭ সালে তিন হাজার ৯২৮ জন, ২০১৮ সালে চার হাজার ৩৩১ জন, ২০১৯ সালে ৪ হাজার ৫৫০ জন এবং ২০২০ সালে চার হাজার ৮৫৪ জন আবেদন করেন।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সালিশি আদালতের স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা জজ) জাহানারা ফেরদৌস বলেন, নানা কারণে সংসার ভাঙছে। উচ্চ, মধ্য ও নিম্নবিত্ত- সব ক্ষেত্রেই সংসার ভাঙার ঘটনা ঘটছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর বিয়েবিচ্ছেদের প্রবণতা বেশি।

তিনি বলেন, মাদকাসক্তি, মোবাইল ফোনে আসক্তি, বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কের কারণেই মূলত বিয়েবিচ্ছেদের হার ও প্রবণতা বাড়ছে। মানুষের মধ্যে সহনশীলতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাবেও বিয়েবিচ্ছেদ ঘটছে। এছাড়া, অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও বিয়ে ভাঙার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। বরপক্ষের যৌতুকের চাপ ও কনেপক্ষের দেনমোহরের চাপও এর জন্য দায়ী।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সালিশি আদালতে জমা দেওয়া বিয়েবিচ্ছেদের আবেদনগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিয়েবিচ্ছেদে ইচ্ছুক স্বামী বা স্ত্রীকে তার সিদ্ধান্তের কথা লিখিতভাবে প্রথমে সিটি করপোরেশনের মেয়রকে জানাতে হয়। যাকে তালাক দিতে ইচ্ছুক তাকেও সেই নোটিশ পাঠাতে হয়। আবেদন পাওয়ার পর মেয়র নোটিশটি সালিশি আদালতে পাঠিয়ে দেন।

আদালতে মেয়রের পক্ষে নিযুক্ত থাকেন স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা জজ)। আদালত বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর করার আগে স্বামী-স্ত্রী দুই পক্ষকে তিন মাসে তিনবার নোটিশ দেন। দুই পক্ষের কোনো পক্ষ বা দুই পক্ষই হাজির হলে সমঝোতার চেষ্টা করেন আদালত। কিন্তু সমঝোতা না হলে আইন অনুযায়ী, ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হয়ে যায়।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সালিশি আদালতের স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা জজ) জাহানারা ফেরদৌস আরও বলেন, করোনাকালে বিচ্ছেদের হার বেড়েছে। এর অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। করোনার কারণে দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকতে থাকতে হয়তো একে অন্যের দোষ-ত্রুটি মেনে নিতে পারছেন না। এ কারণেও বিয়ে ভাঙছে। বাস্তবতা হলো মানুষের মধ্যে সহনশীলতা অনেক কমে গেছে। অনেক সময় তালাকের আবেদন করলেও দুই পক্ষকে বুঝিয়ে সংসার টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেটার হার খুবই কম।

করোনাকালে বিয়েবিচ্ছেদ বাড়ছে মূলত চারটি কারণে, এমনটিই বলছেন বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী।

তিনি বলেন, অর্থ সংকট, বাল্যবিয়ে, বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহারের কারণে সমাজে বিয়েবিচ্ছেদ বাড়ছে। এ প্রবণতা সামনে আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন এ সমাজবিজ্ঞানী।

তিনি বলেন, দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। করোনাকালে শহর থেকে মানুষ গ্রামে ছুটছে। সেখানে গিয়ে মেয়েদের নিদিষ্ট বয়সের আগেই বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অল্প বয়সে সংসার জীবনে মানিয়ে নিতে পারছে না মেয়েরা। ফলে বিয়েবিচ্ছেদ বাড়ছে। মেয়েরা বাল্যবিয়ের কারণে মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব কাটিয়ে উঠতে পারছে না।

উচ্চবিত্ত হোক আর নিম্নবিত্ত হোক, সব আবেদনের ভাষা প্রায় একই। নারীদের বিয়েবিচ্ছেদের আবেদনের প্রধান কারণগুলো হচ্ছে, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, অন্য নারীর সঙ্গে স্বামীর সম্পর্ক বা দ্বিতীয় বিয়ে, মতের বনিবনা না হওয়া, শাশুড়ির সঙ্গে দ্বন্দ্ব, স্বামীর মাদকাসক্তি, চাকরি করতে না দেওয়া বা স্বাবলম্বী হতে বাধা দেওয়া ইত্যাদি।

পুরুষের বিয়েবিচ্ছেদের আবেদনের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, অন্য পুরুষের সঙ্গে স্ত্রীর সম্পর্ক, সংসারে মানিয়ে না চলা, স্বামীর কথা না শোনা, যৌথ পরিবারে থাকতে না চাওয়া, সন্তান না হওয়া, শ্বশুর ও স্বামীর নিকটাত্মীয়ের প্রতি সম্মান না দেখানো ইত্যাদি। অনেক ক্ষেত্রে দেনমোহরের লোভেও বিয়ের কয়েক মাস না যেতেই স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে তালাক দেওয়ার ঘটনা ঘটে।

আবেদনের পর সমঝোতার মাধ্যমে সংসার টিকে যায়, এমন উদাহরণ খুবই কম। আবেদনকারীদের অধিকাংশই নারী। মাদকাসক্তি, মোবাইল ফোনে আসক্তি, বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কের কারণেই মূলত বিয়েবিচ্ছেদের হার ও প্রবণতা বাড়ছে। মানুষের মধ্যে সহনশীলতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাবেও বিয়েবিচ্ছেদ ঘটছে। এছাড়া, অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও বিয়ে ভাঙার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। বরপক্ষের যৌতুকের চাপ ও কনেপক্ষের দেনমোহরের চাপও এর জন্য দায়ী।

এসএইচ-২৯/২১/২১ (আঞ্চলিক ডেস্ক)