আসামিদের ফুল, ডায়েরি উপহার দিয়ে বাড়ি পাঠালেন আদালত

‘আজ থেকে আর কোর্টে আওন লাগতো না, আদালত আমারে মুক্তি দিছইন আমি খুশি। অখন থাকি আমি ভালা হয়ে চলমু।’ আদালত থেকে মুক্তি পেয়ে এসব কথা বলছিল সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার চরেরবন গ্রামের কিশোর মিলন মিয়া।

কিলঘুষি মামলার আসামি ছিল এই কিশোর। দেড় বছর ধরে চলে আসা ওই মামলায় ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার আদালতে হাজিরাও দিতে হয়েছে তাকে। তবে আজ থেকে আর আদালতে আসতে হবে না এটা ভেবেই খুশিতে আত্মহারা কিশোর মিলন।

বুধবার বেলা ১২টায় সুনামগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ও শিশু আদালতের বিচারক মো. জাকির হোসেন ৫০টি মামলায় ৭০ শিশুকে সাজা না দিয়ে ৬টি শর্তে বাবা মায়ের জিম্মায় মুক্তি প্রদান করেন।

এসময় আদালতের বিচারকের পক্ষ থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত শিশুদের হাতে রজনীগন্ধা ফুলের স্টিক ও ডায়েরি তুলে দেওয়া হয়।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, এই শিশুরা চুরি, কিলঘুষির মতো ছোটখাটো অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে দীর্ঘদিন আদালতে হাজিরা দিয়েছে। শিশুদের সংশোধনের জন্য সংশোধন কেন্দ্রে না পাঠিয়ে তাদের বাবা-মায়ের জিম্মায় মুক্তি দেওয়া হয়েছে। মুক্তি পাওয়ার পর শিশুরা শর্তগুলো মেনে চলছে কিনা তা মনিটরিংয়ের জন্য প্রবেশন কর্মকর্তা ও একজন পুলিশ কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করবেন।

আদালত আরও জানিয়েছে, আদালতের আদেশের ব্যত্যয় ঘটলে তাদেরকে টঙ্গীর কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হবে। এ রায়ের ফলে শিশুরা নিজের পরিবারের সঙ্গে থেকে নিজেদের সংশোধনের সুযোগ পাবে।

জগন্নাথপুর উপজেলার গন্ধর্বপুর গ্রামের লায়েক মিয়া প্রতিজ্ঞা করে বলে সে স্থানীয় একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। মামলায় হাজিরা দিতে এসে তার লেখাপড়ার অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। আজ সে মুক্তি পেয়েছে। এখন থেকে আর কোনো মারামারিতে সে জড়াবে না।

শান্তিগঞ্জ উপজেলার মুছা মিয়া জানায়, আদালতের রায়ে সে নুতন জীবন ফিরে পেয়েছে। এখন থেকে কোনো খারাপ কাজ সে করবে না।

যে ৬ শর্তে ওই শিশুদের জামিন দেন আদালত

প্রতিদিন দুটি ভালো কাজ করা ও তা আদালতের দেওয়া ডায়েরিতে লিখে রেখে বছর শেষে আদালতে জমা দেওয়া, বাবা-মায়ের আদেশ নিষেধ মেনে চলা ও তাদেরকে সাহায্য করা, নিয়মিত ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা, অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করা, মাদক থেকে দূরে থাকা এবং ভবিষতে অপরাধমূলক কার্যক্রমে না জাড়ানো। এসব শর্ত মেনে চলা সাপেক্ষে বাবা-মায়ের জিম্মায় মুক্তি পায় জেলার বিভিন্ন উপজেলার ৫০ মামলার ৭০ শিশু-কিশোর।

এ বিষয়ে টিআইবির সনাকের সভাপতি অ্যাডভোকেট আইনুল ইসলাম বাবলু বলেন, এসব শিশু কারাগারে গেলে আরও দাগি অপরাধীদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হত। এতে তাদের ভালো হওয়ার সুযোগ কমে যেত। আদালতের এই রায়ের ফলে শিশুরা বাবা-মায়ের জিম্মায় থেকে নিজেদের সংশোধনের সুযোগ পাবে। বিচার বিভাগের ইতিহাসে এই রায় মাইলফলক হয়ে থাকবে।

শিশু ও মানবপাচার আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর হাসান মাহাবুব সাদী বলেন, এই শিশুরা তাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম পড়ালেখা বাদ দিয়ে মাসে মাসে আদালতে হাজিরা দিতে আসত। এতে তাদের শিশু জীবন ব্যহত হত। আদালতের এই যুগান্তকারী রায়ের ফলে শিশুরা মামলা থেকে রেহাই পেল। তাদের পরিবার হয়রানি থেকে রক্ষা পেল।

প্রবেশন কর্মকর্তা শাহ সফিউর রহমান বলেন, আদালতের আদেশ মেনে চলছে কিনা তা তিনি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন। তাদেরকে নিয়মিত মনিটরিং করা হবে। প্রতি তিন মাস পরপর তাদের প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হবে। বিচারক জাকির হোসেন আগেও এক সঙ্গে অনেক মামলার জনকল্যাণমুখী রায় দিয়ে সুনামগঞ্জবাসীর ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন।

এসএইচ-১৮/১৩/২১ (আঞ্চলিক ডেস্ক)