আবেগঘন পোস্ট দিয়ে শিক্ষক হচ্ছেন রবিদাস

অত্যন্ত গরিব ঘরের সন্তান সন্তোষ রবিদাস অঞ্জন। মা পেশায় চা-শ্রমিক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আবেগঘন পোস্ট দিয়ে তুলে ধরেছেন চা-শ্রমিক মায়ের জীবন সংগ্রামের গল্প। চায়ের পাতা ভর্তা আর শুকনো ভাত খেয়ে জীবনধারণের চরম বাস্তবতাও উঠে এসেছে তার লেখায়। আজ রবিদাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছেন। এই দীর্ঘ পথচলার পিচ্ছিল পথ আর দুর্গম বাঁক পেরিয়ে আজও একটি চাকরির জন্য যখন হন্যে হয়ে ফিরছেন, তখনও সেই মা শ্রম বেচছেন মাত্র ১২০ টাকায়। এমন অসংখ্য মায়ের ঘাম ও শ্রমের অবমূল্যায়নের চিত্র উঠে এসেছে রবিদাসের লেখায়।

মূলধারার সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিক মাধ্যমে রবিদাসের সেই পোস্ট ভাইরাল হলে তা অনেকেরই দৃষ্টি কাড়ে। তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে সবর হয়েছেন অনেকেই, প্রকাশ করেছেন ক্ষোভও।

এদিকে রবিদাসের সেই দুঃখগাথা জানার পর একটি স্কুলের শিক্ষকতার চাকরির প্রস্তাব দিয়েছেন মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান। এমনকি তাকে ডেকেছেন নিজ কার্যালয়েও। ওই সাক্ষাতে তাকে কমলগঞ্জ মডেল হাইস্কুলে শিক্ষকতার নিয়োগপত্র দেয়ার কথা রয়েছে। এমন প্রস্তাবে অত্যন্ত খুশিমনে রাজি হয়েছেন সন্তোষ রবিদাস অঞ্জন।

জানা গেছে, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগর কানিহাটি চা-বাগানের চা-শ্রমিক পরিবারের সন্তান সন্তোষ রবিদাস অঞ্জন। জন্মের ছয় মাসের মধ্যেই তার বাবা মারা যান। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তার মা। করেন চা-বাগানে শ্রমিকের কাজ। সেই সময় দৈনিক মজুরি ছিল মাত্র ১৮ টাকা। ছোট শিশু সন্তোষকে পটের দুধ খাইয়ে অন্যের বাসায় রেখে প্রতিদিন কাজে যেতেন মা। এভাবেই চলতে থাকে সন্তোষ রবিদাস ও তার মায়ের পথচলা। তবে তার মায়ের ইচ্ছে ছিল ছেলেকে পড়ালেখা করে বড়সাহেব বানাবেন। রবিদাস যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়েন, তখন তার মায়ের মজুরি বেড়ে ৮৮ টাকা দাঁড়ায় (২০০৭ সাল)। অথচ দীর্ঘ ১৫ বছরে চা-শ্রমিকের মজুরি মাত্র ৩২ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২০ টাকায়।

“মৌলভীবাজার জেলার শমসেরনগরে ফাঁড়ি কানিহাটি চা বাগানের এক চা শ্রমিক পরিবারের ছেলে আমি। জন্মের ছয় মাসের মাথায় বাবাকে হারিয়েছি। মা চা বাগানের শ্রমিক। তখন মজুরি পেতেন দৈনিক ১৮ টাকা। সেই সময় আমাকে পটের দুধ খাইয়ে, অন্যের বাসায় রেখে মা যেতেন বাগানে কাজ করতে।

২০০৭ সালে আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। মায়ের মজুরি তখন ৮৮ টাকা। একদিন বললেন, ‘বাজারে গিয়ে পাঁচ কেজি চাল নিয়ে আয়।’ সেই চাল দিয়ে এক মাস চলেছে আমাদের। পরদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে দেখি মা চাল ভাজলেন। পলিথিনে সেই ভাজা চাল, আটার রুটি আর লাল চা একটা বোতলে ভরে গামছায় প্যাঁচালেন। আর আমাকে আটার রুটি ও লাল চা দিলেন। দুপুরে খেতে গিয়ে দেখি শুধু পেঁয়াজ, শুকনা ভাত, তেল আর লবণ আছে। তা দিয়ে মেখে খেলাম। রাতেও কোনো তরকারি ছিল না। তখন পাশের বাসার কাকু আমাকে ডেকে কুমড়া আর আলু দিয়েছিলেন, যা দিয়ে আমরা দুইটা দিন পার করেছিলাম। তখন কুপি বাতির আলোয় পড়তাম। মা আগেই রেডি করে দিতেন বাতি। তেল শেষ হয়ে গেলে আর পড়া হতো না। দোকানদার বাকিতে তেল দিতেন না।

পঞ্চম শ্রেণির পর ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন স্কুলে পাঁচ বছরের জন্য ফ্রি পড়ালেখার সুযোগ পাই। মা অনেক খুশি হয়েছিলেন। তখন তার সামান্য আয়ের একটা অংশ থেকে আমাকে টিফিন খাওয়ার জন্য প্রতি সপ্তাহে ৭০-৮০ টাকা দিতেন।

২০১৩ সালে বিএএফ শাহীন কলেজে ভর্তি হই। তখন মা ১০২ টাকা করে পেতেন। এই সময়ে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক থেকে কিস্তি তুলে আমার ভর্তির টাকা, ইউনিফর্ম আর বই-খাতা কিনে দিয়েছিলেন।

২০১৪ ডিসেম্বর মাস, মায়ের হাতে টাকা নেই। তখন এইচএসসির রেজিস্ট্রেশন চলছিল। মা ৫০ টাকার একটা নোট দিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলেছিলেন, ‘কেউ ধার দেয়নি রে বাপ।’ কলেজের এক শিক্ষকের কাছ থেকে ধার নিয়ে সেবার রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়েছিলাম।

এইচএসসির পর ভর্তি পরীক্ষার কোচিং। মা তখন আবার লোন নিলেন গ্রামীণ ব্যাংক থেকে। লোনের কিস্তির জন্য এই সময় মা বাড়ি থেকে অনেক দূরে গিয়ে বালু শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। বিনিময়ে পেতেন ৩০০ টাকা। আমি জানতাম ঘরে চাল নেই। শুধু আলু খেয়েই অনেক বেলা কাটিয়েছিলেন মা।

এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলাম। মা তখন কী যে খুশি হয়েছিলেন! কিন্তু ভর্তির সময় যত ঘনিয়ে আসছিল, মায়ের মুখটা তত মলিন দেখাচ্ছিল। কারণ চা-বাগানে কাজ করে যা পান তা দিয়ে তো সংসারই চলে না। ভর্তির টাকা দেবেন কোথা থেকে। পরে এলাকার লোকজন চাঁদা তুলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে সহায়তা করল।

বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশনি করেই চলতাম। হলের ক্যান্টিনে ২০ টাকার সবজি-ভাত খেয়েই দিন পার করেছি। অনেক দিন সকালে টাকার অভাবে নাশতাও করতে পারিনি। দুর্গাপূজায় কখনো একটা নতুন জামা কিনতে পারিনি।

২০১৮ সালে শ্রেষ্ঠ মা হিসেবে উপজেলায় মাকে সম্মাননা দেয়া হবে বলে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জানানো হয়। পরে মায়ের নামটা কেটে দেয়া হয়েছিল। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, মা আমার চা শ্রমিক। স্টেজে উঠে নাকি কিছু বলতে পারবেন না। তাই নাম কেটে দিয়েছে!

মা এখনো প্রতিদিন সকালে একটা বোতলে লবণ, চা-পাতা ভর্তা, আটার রুটি, সামান্য ভাত পলিথিনে ভরে নিজের পাতি তোলার গামছায় মুড়িয়ে নিয়ে দৌড়ান চা-বাগানে। আট ঘণ্টা পরিশ্রম করে মাত্র ১২০ টাকা মজুরি পান! এই মজুরিতে কীভাবে চলে একজন শ্রমিকের সংসার? আজকাল মায়ের শরীর আর আগের মতো সায় দেয় না। বলেন, ‘তোর চাকরি হইলে বাগানের কাজ ছেড়ে দেব।’

আমি এখন সেই দিনের প্রতীক্ষায় আছি…!”

এই পোস্ট মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের নজরে এলে তিনি কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাফাত আলীকে সন্তোষ রবিদাস অঞ্জনের বাড়িতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। উপজেলা প্রশাসন এ নির্দেশ পেয়েই বৃহস্পতিবার কানিহাটি চা-বাগানে রবিদাসের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হন। তার মায়ের জন্য খাবারসহ অনেক উপহার নিয়ে যান। সেই সঙ্গে রবিদাসকে শনিবার জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বলেন। রবিদাস উপজেলা প্রশাসনের এমন কার্যক্রমে খুবই সন্তুষ্ট।

জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান জানান, কমলগঞ্জ মডেল হাইস্কুলে তাকে খণ্ডকালীন শিক্ষকতার সুযোগ দেয়া হবে। সাক্ষাতে তাকে স্কুলের নিয়োগপত্র তুলে দেয়া হবে বলেও জানান তিনি।

এসএইচ-০৮/১৯/২২ (আঞ্চলিক ডেস্ক)