খুলে দেয়া হয়েছে সুন্দরবনের দুয়ার

টানা ৩ মাস বন্ধের পর পর্যটক, বনজীবী ও মৎস্যজীবীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্যারাবন সুন্দরবন।

বৃহস্পতিবার সুন্দরবন খুলে দেওয়ার প্রথম দিনেই বেশ কয়েকটি পর্যটকবাহী লঞ্চ সেখানে প্রবেশ করেছে।

সাপ্তাহিক ছুটি ও পর্যটন মৌসুমের প্রথম হওয়ায় পর্যটকদের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। তা ছাড়া, পদ্মা সেতু হয়ে সুন্দরবনে আসতে কম সময় লাগছে বলে ঢাকা থেকে সরাসরি অনেকেই খুলনা ও মংলায় এসে সুন্দরবনে প্রবেশের সুযোগ নিচ্ছেন।

এ পর্যটন মৌসুম আগামী বছরের ৩১ মে পর্যন্ত চলবে।

সুন্দরবনের নদ-নদীতে মাছের প্রজনন মৌসুমের কারণে গত ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ৩ মাস ইকো-ট্যুরিজমসহ (প্রতিবেশ পর্যটন) বনজীবীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।

খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার বলেন, ‘সুন্দরবন জল-স্থলভাগ শুধু জীববৈচিত্র্যেই নয়, মৎস্য সম্পদের আধার। সে কারণে সুন্দরবনের মৎস্যসম্পদ রক্ষায় ইন্ট্রিগ্রেটেড রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানিংয়ের (আইআরএমপি) সুপারিশ অনুযায়ী ২০১৯ সাল থেকে প্রতি বছর ১ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনের সব নদী ও খালে মাছ আহরণ বন্ধ থাকে।

এ বছর থেকে মৎস্য বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে এই প্রথম এক মাস বাড়িয়ে ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ৩ মাস সময় বৃদ্ধি করে বন মন্ত্রণালয়। এ সময় সুন্দরবনের সব নদী ও খালে মাছ ধরা বন্ধের পাশাপাশি পর্যটক প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। সুন্দরবনে প্রবেশে সব ধরনের পাস-পারমিট ও নৌ-চলাচলও বন্ধ করা হয়।

এই ৩ মাস পুরো সুন্দরবন ছিল জেলে ও পর্যটক শূন্য।

বৃহস্পতিবার থেকে সুন্দরবনে প্রবেশ করছেন পর্যটকরা। একইসঙ্গে বনজীবীরা সুন্দরবনের বনজসম্পদ আহরণের জন্য পাস-পারমিট নিয়ে বনে প্রবেশ করছেন।

৩ মাস সব ধরনের মাছ আহরণ বন্ধের পাশাপশি সুন্দরবনে পর্যটকসহ বনজীবীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকায় ২১০ প্রজাতির মাছ ও ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর প্রজনন ও বংশ বিস্তারে সুফল আনবে বলে ধারণা বন বিভাগ ও বিশেষজ্ঞদের।

এ দিকে, সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হওয়ায় জেলে, ট্যুর অপারেটর, লঞ্চ ও বোটচালকরা প্রস্ততি শেষ করে অনেকে রওনা হয়েছেন। পর্যটকদের সুন্দরবনে প্রবেশের ট্যুর অপারেটররা তাদের লঞ্চসহ বোটগুলোকে যথাযথভাবে সংস্কার করে পর্যটক বহনের জন্য উপযোগী করে তুলেছেন। অনেকেই ইতোমধ্যে রওনা হয়েছেন সুন্দরবনে।

ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের সাধারণ সম্পাদক এম নাজমুল আযম ডেভিড বলেন, ‘আমরা অগ্রিম বুকিং নেওয়া শুরু করেছি। ১ সেপ্টেম্বর থেকে পর্যটকদের নিয়ে ৪টি জলযান ছেড়ে গিয়েছে। আরও বেশ কয়েকটি যাবে। ৩ মাস বন্ধ থাকার ফলে টুর অপারেটরের সঙ্গে জড়িতরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। পর্যটন মৌসুম শুরু হতে আরও সময় লাগবে। তারপরও ক্ষতি কাটিয়ে ট্যুর অপারেটররা তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছেন।’

‘পরিকল্পিত উপায়ে সুন্দরবনকে ইকো ট্যুরিজমের আওতায় আনা গেলে বনের জীববৈচিত্র্য যেমন রক্ষা পাবে তেমনি পর্যটকরা এর মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। সেই সঙ্গে টুরিরিজম ব্যবসায় জড়িতরা উপকৃত হবেন,’ যোগ করেন তিনি।

তার মতে, ‘পর্যটনের স্বার্থে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও পরিবেশের সঙ্গে আনুসঙ্গিক সুবিধাগুলো নিশ্চিত করতে হলে বন বিভাগ ও ট্যুরিজম বোর্ডসহ বিভিন্ন বিভাগের সমন্বয়ে কমিটি করা দরকার।’

তিনি আরও বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সুন্দরবনকে ঘিরে পর্যটনভিত্তিক বিনিয়োগ জরুরি। সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্য অক্ষুন্ন রেখে পর্যটন বিকাশে পরিবেশ সুরক্ষায় বিশেষ পরিকল্পনা নিতে হবে।’

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনে পর্যটকদের জন্য বর্তমানে ৭ ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার পর্যটক আসেন। পর্যটকদের জন্য নতুন করে ৪টি ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে।

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদ পাই রেঞ্জের করমজল ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবীর বলেন, ‘মংলা থেকে খুবই কাছের পর্যটন কেন্দ্র করমজল। স্বল্প সময়ে সুন্দরবন দেখার সব থেকে কাছের পর্যটনকেন্দ্র এটি। মোট পর্যটকের ৯০ শতাংশ এখানে আসেন।’

বন বিভাগ সূত্রে আরও জানা গেছে, সুন্দরবন থেকে সম্পদ আহরণের জন্য প্রায় ১২ হাজার নৌকাকে বোর্ড লাইসেন্স সার্টিফিকেট (বিএলসি) দেওয়া হয়েছে। প্রতি বছর প্রায় দেড় লাখ বনজীবী সুন্দরবন থেকে সম্পদ আহরণ করবেন।

সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগের খুলনা রেঞ্জের কালাবগী ফরেস্ট স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম জুয়েল  বলেন, ‘১ সেপ্টেম্বর থেকে জেলেদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়া শুরু হয়েছে। তারা এখন থেকে মাছ আহরণ করতে পারবেন। অনেকেই মাছ আহরণ করার জন্য বনের বিভিন্ন খালে প্রবেশ করেছেন।’

সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, ‘সেই অর্থে এখনো পর্যটন মৌসুম শুরু হয়নি। এখন আবহাওয়া অনেকটা দুর্যোগপূর্ণ। আগামী অক্টোবর থেকে নভেম্বর মূলত পর্যটন মৌসুম।’

‘বর্ষায় সুন্দরবনের অধিকাংশ প্রাণীর প্রজনন হয়। এ সময়ে যাতে বন্যপ্রাণীদের সমস্যা না হয়, সে জন্য সবাইকে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়ে থাকে।’

সুন্দরবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হচ্ছে সুপতি, কচিখালী, ডিমের চর, কটকা, বাদামতলা, টিয়ার চর, শেলার চর, দুবলার চর ও আলীবাদাসহ অন্যান্য এলাকা।

এসএইচ-০২/০২/২২ (আঞ্চলিক ডেস্ক)