বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা বান্দরবানের গভীরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘাতে জড়িয়ে পড়া সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ-এর সাথে আলোচনা শুরু হয়েছে। কেএনএফ-এর সশস্ত্র তৎপরতা বন্ধ করার জন্য গত বেশ কয়েকমাস যাবত সেনাবাহিনী সে এলাকায় অভিযান পরিচালনা করেছে এবং বেশ কয়েকজন সেনা সদস্য নিহতও হয়েছে। কেএনএফ বাংলাদেশের ভূখণ্ডে এসে বৈঠক করতে ‘শর্তসাপেক্ষে’ রাজী হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
স্থানীয় সিভিল সোসাইটি ও জেলা পরিষদের উদ্যোগে গঠিত ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির’ সদস্যদের সাথে বুধবার এক ভার্চুয়াল বৈঠকে কেএনএফ তাদের এসব শর্তের কথা জানিয়ে দিয়েছে। এর মাধ্যমে এই প্রথম কেএনএফ তাদের দাবি নিয়ে আলোচনায় এলো।
এই বৈঠকে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা’র নেতৃত্বে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির’ ১২ সদস্য এই বৈঠকে যোগ দেন। অন্যদিকে কেএনএফ-এর তরফ থেকে চার সদস্য যোগ দেন, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন মুইয়াম বম। তিনি কেএনএফ-এর সাংগঠনিক কাঠামোতে ‘ব্রিগেডিয়ার জেনারেল’ হিসেবে পরিচিত।
কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন’ হিসেবে বিবেচনা করে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী।
‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির’ মুখপাত্র কাঞ্চন জয় তঞ্চঙ্গ্যা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন এ বৈঠকে কেএনএফ সরাসরি আলোচনায় আসতে রাজি হয়েছে।তবে এজন্য কিছু শর্ত দিয়েছে।
“আমরা তাদেরকে তাদের দাবি ও শর্ত লিখিত আকারে দিতে বলেছি। সেগুলো যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আমরা দিব। আশা করছি কেএনএফ এর সাথে একটি আলোচনার সূত্রপাত আমরা করতে পেরেছি। পরের বৈঠকটি আশা করছি বাংলাদেশের ভূখণ্ডেই হবে। সে আস্থা আমরা অর্জন করতে পেরেছি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে সেনাপ্রধান জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ বান্দরবান সফরে যান। তখন তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তারা শান্তিপূর্ণভাবে সবকিছুর সমাধান চান। তবে দেশের প্রয়োজনে কঠোর ভূমিকা পালন করতে সেনাবাহিনী দ্বিধা করবে না।
এরপর থেকে অনেক ধারণা করছিলেন যে কেএনএফ-এর সাথে হয়তো আলোচনার সূত্রপাত হতে পারে।
বুধবার বৈঠকের পরপরই ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির’ সদস্যরা কেএনএফ এর বক্তব্য ও দাবিগুলো বান্দরবান অঞ্চলের নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছে।
নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ কেএনএফ -এর কিছু শর্তের বিষয়ে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এবং সে কারণে তাদের বাংলাদেশের ভূখণ্ডে এসে বৈঠক করে আবার নিরাপদে ফিরে যেতে সমস্যা হবে না বলে মনে করছেন ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির’ আরেকজন সদস্য মনিরুল ইসলাম।
তবে কেএনএফ এর দিক থেকে সরাসরি কোনো বক্তব্য বিবিসি পায়নি। সাধারণত কেএনএফ তাদের পরিচালিত ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে বিভিন্ন বক্তব্য-বিবৃতি দেয়। কিন্তু এই আলোচনার বিষয়ে তাদের ফেসবুক পেইজে কোন কিছু উল্লেখ করা হয়নি।
বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে কেএনএফ-এর বক্তব্য নেয়ার চেষ্টা করা হলেও তাদের দিক থেকে কোন সাড়া মেলেনি।
চলতি বছরের ১৯শে মে কেএনএফ সরকারের কাছে কয়েকটি দাবি জানায়। এসব দাবির মধ্যে রয়েছে..
রুমা, থানচি, রোয়াংছড়িসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের নয়টি উপজেলা নিয়ে ‘স্বায়ত্তশাসিত’ অঞ্চল গঠন,
ওই এলাকায় কুকি চিনের নেতৃত্বে পৃথক প্রশাসনিক অঞ্চল এবং
ভারত ও মিয়ানমারে চলে যাওয়া কুকি-চিন জনগোষ্ঠীকে ফেরত আনার ব্যবস্থা করা।
বুধবারের বৈঠকে শান্তি আলোচনার জন্য কেএনএফকে তাদের দাবি লিখিত আকারে জানাতে বলা হয়েছে এবং এসব দাবি শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির হাতে আসলে তারা সেটি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করবে।
‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সদস্য’ মনিরুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলছেন কেএনএফ নেতারা বাংলাদেশে এসে বৈঠকের জন্য পূর্ণ নিরাপত্তা চান- যাতে করে তারা বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এসে বৈঠক করে আবার তাদের অবস্থানে নিরাপদে ফিরে যেতে পারে।
এছাড়া সংলাপ চলাকালে কাউকে আটক না করার পাশাপাশি ধরপাকড় বন্ধ রাখার দাবি করেছে তারা।
“প্রথমে তারা ভারতের মিজোরামে বসতে চেয়েছিলো। কিন্তু আমরা বলেছি আলোচনা বাংলাদেশের মধ্যেই হতে হবে। তারা রাজী হয়েছে। আমরা তাদের শর্তগুলো নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তারাও ইতিবাচক। আশা করছি খুব শিগগিরই আমরা সরাসরি আলোচনায় বসতে পারবো,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
জানা গেছে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা এখন মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন। তিনি সেখান থেকে ফিরে আসার পর এবং এর মধ্যে কেএনএফ এর দাবিনামা লিখিত চলে আসলে দু পক্ষের মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই বৈঠকের উদ্যোগ নেয়া হবে।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে কেএনএফ এর সামরিক শাখা কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মি বা কেএনএর সদস্যদের হামলায় সেনাসদস্যদের হতাহতের ঘটনা ঘটেছিলো।
চলতি বছরের মার্চে বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে সেনাবাহিনীর টহল দলের ওপর কেএনএর অতর্কিত গুলিবর্ষণে সেনাবাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন নিহত হন।
এরপর মে মাসে রুমা উপজেলায় অতর্কিত গুলিতে নিহত হন দুজন সৈনিক। আহত হন আরও দুজন অফিসার।
এ ঘটনার পর সেনাবাহিনীর তরফ থেকে বলা হয়েছিলো রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার গহীন অরণ্যে কুকি চিন অরাজক পরিবেশ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে।
এর আগে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে কুকি চিনের আটজন সদস্য নিহত হয়েছিল। নিহতরা সবাই ছিল বম সম্প্রদায়ের।
তখন নিরাপত্তা বাহিনীর দিক থেকে বলা হয়েছিল, কুকি চিন এবং এবং ইউপিডিএফ-এর মধ্যে সংঘাতে তারা নিহত হয়।
এখন এই আলোচনায় সেনাবাহিনীর সায় আছে কি-না বা তারা কীভাবে দেখছে সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বিষয়টি নিয়ে আইএসপিআর-এর সাথে যোগাযোগ করা হলেও তারা আলোচনায় যারা অংশ নিয়েছে তাদের সাথে যোগাযোগের পরামর্শ দিয়েছে।
তবে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সূত্র গুলো বলছেন কেএনএফ এর সাথে আলোচনায় নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের সায় আছে। মূলত সে কারণেই জেলা পরিষদের উদ্যোগে গত মাসে এ কমিটি হয়েছে আলোচনার সূত্রপাতের জন্য।
গত বছরের শেষার্ধে এসে কুকি-চিনের তৎপরতা দৃশ্যমান হয়েছিলো বাংলাদেশে। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হিসেবে বর্ণনা করেছিলো তখন।
সংগঠনটি তাদের ফেসবুক পাতায় তখন দাবি করেছিলো যে তারা বাংলাদেশের কোন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন নয়।
তাদের ভাষায়, “সুবিধা বঞ্চিত কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর জন্যে স্বশাসিত বা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতাসহ একটি ছোট রাজ্য” চাইলেও তারা কোন স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়নি।
কেএনএফ-এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাথান বম এর নাম গণমাধ্যমে এসেছিলো। তিনি ২০১২ সালে কুকি চিন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনস বা কেএনডিও নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন যা পরে কেএনএফ এ রূপান্তরিত হয়।
গত বছর র্যাব অভিযোগ করেছিলো যে কিছু তরুণকে সীমান্তের দুর্গম পাহাড়ে প্রশিক্ষণ ও রসদ যোগাচ্ছে এই কেএনএফ।
এর মধ্যেই বাড়ি ছেড়ে কথিত হিজরত করতে যাওয়া ৫৫ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করে র্যাব, যারা “জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া”র সাথে জড়িত বলে বলা হচ্ছে এবং র্যাবের দাবি হলো এদেরকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে কেএনএফ।
এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে সসময়ে সেখানে জঙ্গি ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাপক অভিযান চালায়।
এ অভিযানের কারণে বান্দরবানের বিভিন্ন জায়গায় পর্যটক ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো।
এরপর সেনাবাহিনীও ওই অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করে। এসময় অতর্কিত হামলা সেনাসদস্য হতাহতের ঘটনাও ঘটে।
সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সংঘাতের জেরে বেশ কয়েকশো কুকি-চিন (যাদের বাংলাদেশে অনেকে ‘বম’ বলে ডাকেন) ভারতের মিজোরামের লংৎলাই জেলার আশ্রয় শিবিরগুলোতে নিয়েছিলো।
তাদের অনেকে জানিয়েছিল যে কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যে অভিযান চালাচ্ছে, তার থেকে বাঁচতেই ভারতে পালিয়ে এসেছেন তারা।
তবে সম্প্রতি গত ১৪ই জুলাই রোয়াংছড়ি ছাড়া বান্দরবানের বাকী সব জায়গা পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা করে।
যদিও কেএনএফ তাদের ফেসবুক পাতায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এর বিরোধিতা করে রুমায় বগালেক এলাকায় চলাচল থেকে বিরত থাকা পরামর্শ দিয়েছে।
এসএইচ-০৪/২০/২৩ (আঞ্চলিক ডেস্ক, সূত্র : বিবিসি)