যে আমলে মরেও অমর হয়ে থাকবেন

যে আমলে মরেও

জীবিত ব্যক্তি নেক করে সওয়াব হাসিল করতে পারে। মৃত্যুর পরে পারে না। তাই জীবিত ও মৃতের যদি অর্থ করা হয়, নেক আমল দ্বারা যার সওয়াব লাভের সুযোগ আছে সে জীবিত আর মৃত হচ্ছে, যার এই সুযোগ নেই।

এই অর্থের দিকে লক্ষ্য করে, কোনো মানুষ মরে অমর হয়ে থাকতে পারে। অর্থাৎ মারা যাওয়ার পরও তার নেকির পাল্লা ভারি হতে থাকবে, যেমনটি হচ্ছিল সে জীবিত থাকা অবস্থায়। মুহাম্মাদ (সা.) এ কথা বলে গিয়েছেন। হাদীসটি হচ্ছে- হজরত আবু হুরাইরা (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, মানুষ যখন মারা যায় তখন তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমলের সওয়াব মৃত্যুর পরও পেতে থাকে।

(এক) ছদকায়ে জারিয়া (যেমন মসজিদ, মাদ্রাসা, রাস্তা-ঘাট নির্মাণ)।

(দুই) ওই ইলেম বা জ্ঞান, যা দ্বারা মানুষ তার মৃত্যুর পরও উপকার পাইতে থাকে।

(তিন) ওই নেক সন্তান, যে মৃত্যুর পর তার জন্য দোয়া করতে থাকে। (সুনানে আবু দাউদ-২৮৮২)

আল্লাহ তায়ালা কত মহান! বান্দার উপর বড় ইহসান যে, মানুষ যদি চায় মৃত্যুর পর কবরে শুয়ে আরাম করবে আর তার মর্যাদা বৃদ্ধি হতে থাকবে, সেই ব্যবস্থাও আল্লাহ তায়ালা করে রেখেছেন। এটা কারো জন্য নির্দিষ্ট নয়; সকলের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। শর্ত হচ্ছে, দুনিয়ায় থাকাবস্থায় এর ব্যবস্থা করে যাওয়া। তা তাদের পক্ষেই সম্ভব, যাদের অন্তরে রয়েছে হেদায়েতের আলো। আখেরাতের প্রতি রয়েছে অগাধ বিশ্বাস।

ইসালে সওয়াবের ওসিয়ত করে যাওয়া: সাহাবায়ে কেরাম ও পূববর্তি বুযূর্গগণের অভ্যাস ছিলো, মৃত্যুর সময় ইসালে ছওয়াবের জন্য ওসিয়ত করে যাওয়া। যেমন আব্দুর রহমান বিন আলা বিন জাল্লাজ নামে এক প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ছিলেন। আব্দুর রহমান বলেন, আমার পিতা মৃত্যুর সময় ওসিয়ত করেন, আমার কবরের পাশে যেন সূরা বাকারার প্রথমাংশ তেলাওয়াত করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি এই কথাও বলিয়াছেন যে, আমি আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-কে এই ওসিয়ত করতে শুনেছি। (ফাযায়েলে সাদাকাত-১০৮) মৃত্যুর আগে আমরা সন্তানদেরকে জাগতিক বিভিন্ন বিষয়ে ওসিয়ত করি। কিন্তু ভাগ্যবান ওই সমস্ত লোক, যারা মৃত্যুর আগে আখেরাতে নেকি লাভের রাস্তা খুলে যায়। উল্লেখিত ঘটনা দ্বারা প্রমাণীত, পূর্ববর্তী বুযূর্গরা মৃত্যুর আগে বিভিন্ন নেক কাজ করে, ইসালে সওয়াবের জন্য সন্তানদেরকে ওসিয়ত করে যেতেন।

ইসালে ছওয়াব জীবিতদের উপর মৃতের হক: মৃত ব্যক্তির দায়িত্ব ইসালে সওয়াবের ব্যবস্থা করে যাওয়া। যদি না করে যায় তাহলে কী জীবিতদের উপর কোনো কর্তব্য নেই? জীবিতদের উপর মৃত ব্যক্তির হক হচ্ছে, ইসালে ছওয়াব করা; চাই মৃত ব্যক্তি এর ব্যবস্থা করে যাক বা না যাক। আল কোরআনে মুমিনদের আলোচনায় এসেছে তারা তাদের পূর্ববতিদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করে। কিন্তু সেখানে পূর্ববতিদের ওসিয়তের কোনো উল্লেখ নেই। বলা হয়েছে,

وَالَّذِينَ جَاؤُو مِن بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالإِيمَانِ وَلا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلاًّ لِّلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَؤُوفٌ رَّحِيمٌ

‘এবং যারা তাদের পরে এসেছে- তারা বলে, ‘হে আমাদের রব! ক্ষমা করুন আমাদের এবং আমাদের ভাইদের, যারা আমাদের পূর্বে ইমান এনেছে এবং আমাদের অন্তরে ইমানদারদের প্রতি কোনো বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের রব! আপনি অতি দয়ার্দ্র, পরম মেহেরবান। (সূরা হাশর-১০) এই আয়াতে পূর্ববর্তীদের জন্য দোয়ার কথা বলা হয়েছে। তাই আমাদের বুযূর্গ, সালেকিন ও আউলিয়াদের অভ্যাস ছিলো, তাদের পূর্ববর্তীদের জন্য দোয়া করা।

হজরত আবু হুরাইরা (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, জান্নাতে কনো কোনো ব্যক্তির মর্যাদা হঠাৎ করে বেড়ে যাবে। তখন ওই ব্যক্তি জিজ্ঞেস করবেন, হে আল্লাহ! আমার মর্যাদা কী কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে? তখন আল্লাহ তায়ালা বলবেন, তোমার জন্য তোমার ওমুক ছেলে দোয়া, ইস্তেগফার করার কারণে মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। (মুসনাদে আহমদ-১০৬৬০) মনজুর নোমানী (রাহ.) এই হাদীসের ব্যাখায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছেন, যেগুলো হয়তো আমাদের হৃদয়ের বদ্ধ জানালা খুলে দিতে পারে। তিনি লিখেন, ‘এই হাদীসে সন্তানের দোয়া দ্বারা, পিতামাতার মর্যাদা বৃদ্ধির বিষয়টি উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে। অন্যথায়, যে কোনো ঈমানদারের দোয়া মৃত ব্যক্তির জন্য উপকারী।

পিতা-মাতা জীবিত থাকাবস্থায় সন্তানের উপর যেমন তাদেরই হক বেশি, তাদের খেদমত ও আনুগত্য করা ফরজ, তেমনি মৃত্যুর পরও সন্তানের উপর তাদের বিশেষ হক রয়েছে। মৃত্যুর পরের হক হচ্ছে, তাদের উপর আল্লাহর রহমত ও ক্ষমার জন্য দোয়া করা। মৃত্যুর পর তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহারের রাস্তা এটাই। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত এই হাদীসগুলোর মাকসাদ শুধু আমাদেরকে বার্তা দেয় না। বরং মূল মাকসাদ হচ্ছে, সন্তানাদি ও আত্মীয়স্বজনকে ইসালে সওয়াবের প্রতি উৎসাহ দেয়া। কারণ, মৃত ব্যক্তিরা কবরে শুয়ে শুয়ে এর সওয়াব পেতে থাকে। (মাআরেফুল হাদীস, খণ্ড- ৫, পৃষ্ঠা- ২০৬)

কবরে কাছে গিয়ে ইসালে ছওয়াব করার ফায়দা: যেকোনো জায়গা থেকে মৃত ব্যক্তির রূহে ইসালে সওয়াব করলে তা পৌছে। তবে কবরের কাছে গিয়ে ইসালে ছওয়াব করার দ্বারা অতিরিক্ত তিনটি ফায়দা পাওয়া যায়।

(এক) ইসালে সওয়াবকারীর জন্য কোরআন তেলাওয়াত, দোয়া, ইস্তেগফারের নেকি ছাড়া অতিরিক্ত ফায়দা হচ্ছে, পরকালের কথা বেশি বেশি মনে হয়। আখেরাতের দিকে মন ঝুঁকে। রাসূল (সা.)-ও এক হাদিসে এই ফায়দার কথা উল্লেখ করেছেন। ইমাম আবু দাউদ (রাহ) ‘সুনানে আবি দাউদ’ গ্রন্হে হাদিসটি উল্লেখ করেছেন। হাদিসটি হচ্ছে, ‘রাসূল (সা.) এক দিন তাঁর মায়ের কবরের কাছে আসলেন। এসে তিনি নিজেও কাঁদলেন এবং আশপাশের লোকজনকেও কাঁদালেন। অতঃপর রাসূল (সা.) বলেন, ‘আমি আমার মায়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়ে আল্লাহ তায়ালার কাছে অনুমতি চাই। আল্লাহ তায়ালা আমাকে এ বিষয়ে অনুমতি দেননি। অতঃপর আমি তার কবর যিয়ারতের অনুমতি চাই। আল্লাহ তায়ালা আমার মায়ের কবর যিয়ারতের অনুমতি দেন। তোমরা কবর যিয়ারত করো, কেননা তা আখেরাতকে স্মরণ করিয়ে দেয়। (সুনানে আবু দাউদ-৩২৩৪)

(দুই) কবর কাছে গিয়ে ইসালে সওয়াব করা দ্বারা, মৃত ব্যক্তির একাকিত্বের অনুভব দূর হয়। প্রসিদ্ধ সাহাবি আমর ইবনুল আস (রা.) বলেন, তোমরা আমাকে দাফন সম্পন্ন করে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে, একটি উট জবাই করে গোশত কেটে ভাগ করতে যতটুকু সময় লাগে ততটুকু সময় পর্যন্ত। যেন আমি তোমাদের কারণে একাকিত্ব অনুভব না করি।’ (সহীহ মুসলিম-৩৩৬) এই হাদীস দ্বারা প্রমাণীত হয় জীবিতদের দ্বারা মৃত ব্যক্তির একাকিত্ব দূর হয়। তাই ইমাম শাফী (রাহ.) বলেন, ‘দাফনের পর মুস্তাহাব হচ্ছে, কবরের কাছে কোরআনের একটি অংশ তেলাওয়াত করা। তবে পূর্ণ কোরআন খতম দিতে পারলে আরো ভালো।’ (রিয়াজুস সালেহিন-২৫৬) তবে মনে রাখতে হবে, মৃত ব্যক্তির অনুভূতি জীবিতের চেয়ে ভিন্ন।

(তিন) দোয়া, ইস্তেগফার ও তেলাওয়াতের কারণে যে নুর সৃষ্টি হয়, তা দ্বারা অন্তরে প্রশান্তি আসে। (জাওয়াহিরুল ফিকহ, খণ্ড- ৩, পৃষ্ঠা-২৯০)

ইসালে ছওয়াবকারীও সমপরিমাণ নেকি পায়: অনেক কাজ থাকে যা অন্যের জন্য করলে নিজে কিছুই পায় না। ইসালে সওয়াব হচ্ছে এর ব্যতিক্রম। কারণ, যদিও হচ্ছে অন্যের জন্য, কিন্তু নিজেও এর সমপরিমাণ সওয়াব পেয়ে যাবে। হাদীসে বলা হয়েছে,

قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم إذا تصدق بصدقة تطوعا أن يجعلها عن أبويه فيكون لهما أجرها ولا ينقص من أجره شيء

হজরত আবু আমর (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি নফল সদকা করে তার সওয়াব মৃত পিতা-মাতার জন্য দিলে, তা তারা এবং দাতা উভয়ে পাবে; সওয়াব রসানির জন্য দাতার নেকিতে কনো কমতি করা হবে না। (তবরানি, মুজামুল আওসাত-৭৭২৬)

ফিকহে হানাফির প্রসিদ্ধ গ্রন্ত্র ‘ফতোয়ায়ে শামি’তে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি নফল সদকা করে তার জন্য উত্তম হচ্ছে, এর দ্বারা সমস্ত মুমিন নর-নারীর রূহে সওয়াব পৌছানোর নিয়ত করা। কেননা, এর সওয়াব তাদের রূহে পৌছে এবং এ কারণে দাতার নেকিতে কোনো ঘাটতি করা হয় না। এটাই আহলে সুন্নত ও জামাতের মত।

ইমাম শাফী ও মালেক (রাহ.) বলেন, আর্থিক ইবাদতের সওয়াব মৃত ব্যক্তির রূহে পৌছে, কিন্তু শারীরিক ইবাদতের সওয়াব পৌছে না। (ফতোয়ায়ে শামী, খণ্ড- ৬, পৃষ্ঠা-৪০৪) শারীরিক ইবাদতের সওয়াব পৌছা, না পৌছার ব্যাপারে মতানৈক্য থাকায় উলামায়ে কেরাম বলেন, ইসালে সওয়াবের ক্ষেত্রে আর্থিক ইবাদতের মাধ্যমে সওয়াব পৌছানোই উত্তম।

জুমার দিন ইসালে সওয়াব করার ব্যাপারে হাদীসে গুরুত্বারোপ: ইমাম বায়হাকী (রাহ.) মুরসাল সনদে একটি রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন, যে ব্যক্তি প্রতি জুমার দিন পিতা-মাতার কবর জেয়ারত করে, তার গুনাহ মাফ করে দেয়া হয় এবং সে পিতা-মাতার অনুগত সন্তান হিসেবে সে তালিকাভূক্ত হয়।

মাসয়ালা-মাসায়েল: (এক) মৃত ব্যক্তির রূহে ইসালে সওয়াবের জন্য বিনিময়ের ভিত্তিতে কোরআন বা অন্য কোনো খতম পড়া, পড়ানো উভয়টি না জায়েজ। এতে উভয়ে গুনাহগার হবে। যারা পড়ছেন তাদেরই যখন নেকি হাসিল হচ্ছে না তাহলে অন্যের জন্য কীভাবে হবে?

(দুই) নির্দিষ্ট কোনো তারিখ, বিশেষ কোনো দিন ঠিক না করে যদি ইসালে সওয়াব করা হয় তাহলে নেকির বিষয় হবে। আর যদি নির্দিষ্ট কোনো কিছু ঠিক করে বা প্রচলিত আনুষ্ঠানিতা রক্ষার জন্য করা হয় তাহলে তা শরীয়তের দৃষ্টিতে না পছন্দ এবং এর আল্লাহর দরবারে জবাবদিহিতার সম্মুক্ষিণ হতে হবে। (জাওয়াহিরুল ফিকহ, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-২৮৭)

(তিন) কবরের দিকে ফিরে, হাত ওঠিয়ে দুয়া করা থেকে ফকিহগণ নিষেধ করেছেন। কারণ, এটা কবরবাসীর কাছে কোনো কিছু চাওয়ার সঙ্গে সাদৃশ্য হয়ে যায়।

(চার) ইসালে সওয়াবের জন্য নির্দিষ্ট দিন ধার্য করা যেমন মৃত্যুর তিন দিন, চল্লিশ দিন পর আনুষ্ঠানিকভাবে দোয়া করে ইসালে সওয়াব করা বেদয়াত। (জাওয়াহিরুল ফিকহ, খণ্ড- ৩, পৃষ্ঠা-১৯২)

ইসালে সওয়াবের দোয়া আল্লাহ তায়ালাও শিখিয়েছেন: আল কোরআনে আল্লাহ তায়ালা শিক্ষা দিয়েছেন কীভাবে মৃত মাতা-পিতার জন্য দোয়া করতে হয়। দোয়াটি হচ্ছে,

رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا

‘হে আল্লাহ! আপনি তাদের উপর রহম করুন যেমন তারা আমাদের উপর রহম করেছে ছোট সময়।’ (সূরা: বনি ইসরাইল, আয়াত: ৩৪)

তাই আসুন! শত ব্যস্ততার মাঝেও আমরা আমাদের মৃত বাবা-মা’কে স্মরণ রাখি। তাহলে আমাদের পরবর্তিরা আমাদেরকে স্মরণ করবে।

আরএম-০৯/২১/০৩ (ধর্ম ডেস্ক)