আল-কুরআন ও সহিহ হাদিসে শব-এ-বরাতের অকাট্য দলিল

আল-কুরআন

পবিত্র শব-এ-বরাত হচ্ছে সৌভাগ্য অর্জন ও দোয়া কবুলের রাত। ‘শব-এ-বরাত’ কথাটি ফার্সি। ‘শব’ অর্থ রাত আর ‘বরাত’ অর্থ সৌভাগ্য। সুতরাং ‘শব-এ-বরাত’ শব্দের অর্থ দাড়ায় ‘সৌভাগ্যের রাত’। অন্যদিকে এর আরবী হলো ‘লাইলাতুল বারাআত’ ( ليلۃ البراءۃ )। হাদীসের ভাষায় এটি ليلۃ النصف من شعبان (লাইলাতিল নিফস মিন শাবান) বা অর্ধ শাবানের রাত।

পবিত্র আল-কুর’আনের সুরা আদ-দুখানের ৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ

(ইন্না আনযালনাহু ফি লাইলাতিম্ মুবারাকাতিন্ ইন্না কুন্না মুনযিরীন্)

অর্থ : নিশ্চয় আমি তা নাযিল করেছি লাইলাতুল মুবারাকাতে; নিশ্চয় আমি সতর্ককারী।

উল্লেখিত ‘লাইলাতুল মুবারাকাত’ কথাটির জন্য মুফাসসিররা ৪টি অর্থ করেছেন। যেমন-

১। الليلۃ المباركۃ (পবিত্র রাত)

২। وليلۃ البراءۃ (সৌভাগ্যের রাত)

৩।وليلۃالصك ( ছাড়পত্রের রাত)

৪। واليلۃ الرحمۃ (করুণার রাত)

শব-এ-বরাতের দলিলের জন্য এদিক সেদিকে যেতে হবে না,সিহাহ সিত্তাহতেই রয়েছে। যেমন, তিরমিযী শরীফের كتاب الصوم عن رسولالله صلی الله عليه وسلم অধ্যায়ে باب ما جاء في ليلۃ النصف من شعبان নামে আলাদা পরিচ্ছেদ রয়েছে। সুনানে ইবনে মাযাহ শরীফে ১৫ শাবানের ফজিলত নিয়ে كتاب اقامۃ الصلاۃ والسنۃ فيها অধ্যায়ে باب ما جاء في ليلۃ النصف من شعبان নামে আলাদা পরিচ্ছেদ রচনা করেছেন।

রাসুলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা রাহমাতাল্লিল আলামিনের (দ) সহিহ হাদিসে এই রাতের রসম বা রেওয়াজ কীভাবে প্রচলিত হয়, সে কথা বর্ণিত হয়েছে।

নবীজি (দ) বলেন, মধ্য শাবানের রজনীতে অর্থাৎ ১৫ই শাবানের রাতে ঘুমিয়ে ছিলাম। এমন সময় জিব্রাঈল (আ) আমার শিয়রে উপস্থিত হয়ে বললো, ‘হে মুহাম্মাদ, কীভাবে আপনি এ রাতে ঘুমিয়ে আছেন!’ জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হে জিব্রাঈল‌, এই রাত এমন কী রাত?’ সে বললো, ‘এ রাত হচ্ছে ১৫ই শাবানের রাত। হে মুহাম্মাদ, উঠুন!’ এরপর সে আমাকে শোয়া থেকে ওঠালো এবং জান্নাতুল বাকীর কবরস্থানে নিয়ে গিয়ে বললো, ‘আকাশের দিকে চেয়ে দেখুন! আজ রাতে আসমানের দরজাগুলো খুলে যাবে। রহমতের দরজাগুলো খুলে যাবে এবং খুলে যাবে সকল সুখ, সমৃদ্ধি, ক্ষমা, রুযি, পরিত্রাণ পাওয়া ও পুনরুজ্জীবিত হওয়ার দরজাগুলো। মহান আল্লাহ্ এ রাতে চারপেয়ে জন্তুর গায়ের চুল ও পশমের পরিমাণ নিজ বান্দাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দান করবেন। এ রাতে তিনি মৃত্যুর সময় এবং আগামী এক বছরের রিযিক (এখানে সকল নেয়ামতকেই বুঝানো হয়েছে) নির্ধারণ করবেন। হে মুহাম্মাদ (দ), যারা এ রাতে জাগ্রত থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালাকে পবিত্র ও একক সত্তা জেনে তার যিকির করবে, তাকে রাজি-খুশি করার জন্য নামায-দোয়া পড়বে, পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করবে ও বেশি বেশি পরিমাণে ইস্তেগফার করে রাতকে ভোরে পৌঁছাবে, তাদের স্থান হবে জান্নাতে এবং তারা এর আগে যা কিছু গোনাহ আঞ্জাম দিয়েছে, তাও ক্ষমা করে দেবেন।

রাবিরা উল্লেখ করেছেন দ্বিতীয় হিজরীর ১৫ই শাবানের মধ্য রাতে এই ঘটনাটি সংঘটিত হয়। আর তখন থেকেই শব-এ- বরাতের এ রসম বা রেওয়াজ প্রচলিত হয়।

(সূত্র : তিরমিজী শরীফ/৭৩৬, ইবনে মাজাহ/১৩৮৫, ইবনে তাউউস ও আলী বিন মুসা রচিত ইকবালুল আ’মাল গ্রন্থের পৃ.- ২১২ (বৈরুত প্রিন্ট , প্রকাশক – মুয়াসসিসাতুল আ’লামিলিল মাতবুআ’ত, ১৪১৭ হিজরী)।

এ প্রসঙ্গে হাদিস শরীফে বর্ণিত রয়েছে-

ان الدعاء يستجاب فى خمس ليال اول ليلة من رجب وليلة النصف من شعبان وليلة القدر المباركة وليلة العيدين

অর্থ: নিশ্চয়ই পাঁচ রাত্রিতে দোয়া নিশ্চিতভাবে কবুল হয়ে থাকে। (১) রজব মাসের প্রথম রাতে, (২) শবে বরাতের রাতে, (৩) ক্বদরের রাতে, (৪) ঈদুল ফিতরের রাতে, (৫) ঈদুল আযহার রাতে। (মা-ছাবাতা বিসসুন্নাহ)

হাদীস শরীফে আরও ইরশাদ হয়েছে-

عن على عليه السلام قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا يومها فان الله تعالى ينزل فيها لغروب الشمس الى السماء الدنيا فيقول الامن مستغفر فاغفرله الا مسترزق .فارزقه الا مبتلى فاعافيه الا كذا الا كذا حتى يطلع الفجر

অর্থ : হযরত আলী (কা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যখন শাবানের ১৫ তারিখ রাত্রি উপস্থিত হবে, তখন তোমরা ওই রাতে নামায আদায় করবে এবং পরের দিনে রোযা রাখবে। কেননা নিশ্চয়ই আল্লাহপাক সেই সূর্যাস্তের সময় পৃথিবীর আকাশে আসেন অর্থাৎ রহমতে খাস নাযিল করেন। এরপর ঘোষণা করেন, ‘কোনও ক্ষমা প্রার্থনাকারী কি আছ? আমি তাকে ক্ষমা করে দিবো। কোনও রিযিক প্রার্থনাকারী কি আছ? আমি তাকে রিযিক দান করবো। কোনও মুসিবতগ্রস্ত ব্যক্তি কি আছ? আমি তার মুসিবত দূর করে দেবো’ এভাবে ফজর পর্যন্ত ঘোষণা করতে থাকেন। সুবহানাল্লাহ! (ইবনে মাজাহ্, মিশকাত)

হাদীসে আরও এসেছে-

ﻋﻦ ﻋﺎﺋﺸﺔ : ﻗﺎﻟﺖ ﻓﻘﺪﺕ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭ ﺳﻠﻢ ﻟﻴﻠﺔ ﻓﺨﺮﺟﺖ ﻓﺈﺫﺍ ﻫﻮ ﺑﺎﻟﺒﻘﻴﻊ ﻓﻘﺎﻝ ﺃﻛﻨﺖ ﺗﺨﺎﻓﻴﻦ ﺃﻥ ﻳﺤﻴﻒ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻚ ﻭﺭﺳﻮﻟﻪ ؟ ﻗﻠﺖ ﻳﺎ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺇﻧﻲ ﻇﻨﻨﺖ ﺃﻧﻚ ﺃﺗﻴﺖ ﺑﻌﺾ ﻧﺴﺎﺀﻙ ﻓﻘﺎﻝ ﺇﻥ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﺰ ﻭ ﺟﻞ ﻳﻨﺰﻝ ﻟﻴﻠﺔ ﺍﻟﻨﺼﻒ ﻣﻦ ﺷﻌﺒﺎﻥ ﺇﻟﻰ ﺍﻟﺴﻤﺎﺀ ﺍﻟﺪﻧﻴﺎ ﻓﻴﻔﻐﺮ ﻷﻛﺜﺮ ﻣﻦ ﻋﺪﺩ ﺷﻌﺮ ﻏﻨﻢ ﻛﻠﺐ

অর্থ : হযরত আয়েশা (রাদি.) বলেন, একরাতে রাসূল (সা.) কে না পেয়ে খুজতে বের হলাম। খুঁজতে খুঁজতে জান্নাতুল বাকীতে গিয়ে আমি তাঁকে দেখতে পেলাম। আল্লাহর নবী (দ) বললেন, কী ব্যাপার আয়েশা? তোমার কি মনে হয় আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল তোমার ওপর কোনও অবিচার করবেন? হযরত আয়েশা (রাদি.) বললেন, আমার ধারণা হয়েছিল আপনি অন্য কোনও বিবির ঘরে গিয়েছেন। রাসূল (দ) তখন বললেন, যখন
শাবান মাসের ১৫ই রাত আসে, তখন আল্লাহপাক এ রাতে প্রথম আসমানে নেমে আসেন। তারপর বনু কালব গোত্রের বকরীর পশমের চেয়ে বেশি সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। (সুনানে তিরমিযী)

শাইখ নাসীরুদ্দীন আলবানী (রাহ.) তাঁর সিলসিলাতুল আহাদিসিস সহীহাহ গ্রন্থের ৩/১৩৫-১৩৯ -এ শব-এ-বরাত সম্পর্কিত হাদিসের সমর্থনে আটটি হাদিস উল্লেখ করার পর লেখেন যে, শব-এ-বরাত সম্পর্কিত হাদীসগুলো নিঃসন্দেহে সহিহ প্রমাণিত হয়।

আরএম-০১/২১/০৪ (ধর্ম ডেস্ক)