ভিক্টোরিয়ান যুগে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন যে ব্রিটিশ খ্রিস্টানরা

ভিক্টোরিয়ান যুগে

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ খ্রিস্টান ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ভিক্টোরিয়ান যুগে যখন খ্রিস্টান ধর্মের মূল্যবোধই ব্রিটিশ পরিচয়ের মূল ভিত্তি ছিল তখন যারা সামাজিক নিয়মের বাইরে গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এমন তিনজন ব্রিটিশকে নিয়ে এ প্রতিবেদন।

আবদুল্লাহ কুইলিয়াম

উইলিয়াম হেনরি কুইলিয়াম ছিলেন একজন আইনজীবী। ১৮৮৭ সালে মরক্কো সফরের সময় যাত্রা বিরতিতে মরক্কোর কয়েকজনকে নামাজ পড়তে দেখে ইসলামের প্রতি আগ্রহী হন তিনি।

“জাহাজটি দুলছিল, প্রবল বাতাস বইছিল, কিন্তু তারা তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ করছিল না। আমি তাদের এভাবে নামাজ পড়তে দেখে ভীষণ অবাক হই।”

“তাদের চেহারায় যে প্রশান্তির ছাপ ছিল তা স্রষ্টার প্রতি তাদের অটুট বিশ্বাস আর আনুগত্যের প্রমাণ”, কুইলিয়াম বলছিলেন সেদিনটির কথা।

সেসময় মরক্কোতে কিছুদিন ছিলেন কুইলিয়ান। তিনি ওই সময় ইসলাম সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেন।

এরপর ৩১ বছর বয়সী কুইলিয়াম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।

তিনি বলেন, “আমার নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে ইসলামের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। বরং অনেক মিল রয়েছে। তাই ইসলাম গ্রহণ করা আমার কাছে খুবই যুক্তিসংগত ব্যাপার মনে হয়েছে।”

ইসলামে নাম পরিবর্তনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবু তিনি নিজের নাম বদলে ‘আবদুল্লাহ’ নাম গ্রহণ করেন।

১৮৮৭ সালে ইংল্যান্ড ফিরে গিয়ে তিনি ধর্মপ্রচার শুরু করেন।

বলা হয়ে থাকে, পুরো ইংল্যান্ডে প্রায় ৬০০ জনকে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে উৎসাহিত করেছিলেন।

ঐ বছরই তিনি লিভারপুলে ব্রিটেনের প্রথম মসজিদ স্থাপন করেন। লিভারপুলকে তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় প্রধান শহর মনে করা হত।

ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে কুইলিয়াম একটি ছোট পুস্তিকা প্রকাশ করেন। সেটি ১৩টি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল।

রানী ভিক্টোরিয়া তাঁর লেখা এ পুস্তিকা সংগ্রহ করেছিলেন। বলে রাখা ভালো যে, তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে যত মুসলমান ছিল, তার চেয়েও বেশি সংখ্যক মুসলমানদের শাসক ছিলেন রানী ভিক্টোরিয়া।

রানী তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য আরো ছয় কপি বই অর্ডার করেছিলেন। তবে তাঁর সমাজ এই আগ্রহ ভালোভাবে নেয়নি, কারণ অধিকাংশের ধারণা ছিল ইসলাম একটি সহিংস ধর্ম।

১৮৯৪ সালে, রানীর অনুমতি নিয়ে অটোমান সুলতান কুইলিয়ামকে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের ‘শেখ-আল-ইসলাম’ বা ‘মুসলমানদের নেতা’ খেতাব দেন।

এই স্বীকৃতির পরেও, লিভারপুল শহরের ধর্মান্তরিত মুসলমানদেরকে নানা লাঞ্ছনা, গঞ্জনা সইতে হত।

তাদের দিকে ইট-পাথর, ঘোড়ার মলসহ নানা আবর্জনা ছুঁড়ে মারার মত ঘটনাও ঘটেছে।

কুইলিয়াম বিশ্বাস করতেন আক্রমণকারীদের ব্রেইনওয়াশ করা হয়েছে। তাদেরকে বোঝানো হয়েছে যে মুসলমানরা খারাপ লোক।

তিনি স্থানীয় লোকজনের কাছে বেশ পরিচিত ছিলেন। কেননা তিনি সুবিধাবঞ্চিতদের নিয়ে কাজ করতেন। বিশেষ করে ট্রেড ইউনিয়ন ও বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার নিয়ে তিনি বেশ সোচ্চার ছিলেন।

এক মহিলাকে বিবাহ বিচ্ছেদে সাহায্য করতে গিয়ে তার ওকালতি পেশা হুমকির মুখে পড়ে।

ওই মহিলার কুখ্যাত দুশ্চরিত্র স্বামীকে হাতেনাতে ধরার জন্য ফাঁদও পেতেছিলেন তিনি। তখন ইংল্যান্ডে আইনজীবীদের ক্ষেত্রে এটা খুব সাধারণ ঘটনা ছিল। কিন্তু ওই কৌশল ব্যর্থ হয়, কুইলিয়াম নিজে উল্টো ফেঁসে যান। মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর এ ঘটনার বেশ প্রভাব পড়েছিল।

বিতর্ক এড়াতে তিনি ১৯০৮ সালে লিভারপুল ত্যাগ করে হেনরি ডি লিওনে চলে যান।

তবে সেখানেও অনেকেই তাঁকে চিনতেন বলে দাবি করেছেন কুইলিয়ামকে নিয়ে রচিত বইয়ের লেখক প্রফ রন গিভস।

তাঁর সুনাম নষ্ট হওয়ার পরেও তিনি ওকিন শহরে দেশটির দ্বিতীয় পুরাতন মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ওকিনে ১৮৮৯ সালে মসজিদটি তৈরি হয়েছিল।

১৯৩২ সালে কুইলিয়ামের মৃত্যু হয়। লিভারপুল মসজিদে এখনো তাঁর নাম খোদাই করা আছে।

লেডি এভলিন কাবল্ড

মুসলিম দেশগুলো ভ্রমণ করতে গিয়ে ধনীদের অনেকেই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হতেন।

লেডি এভলিন মারে, এডিনবার্গের এক ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান, শৈশবের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন স্কটল্যান্ড ও উত্তর আফ্রিকা যাওয়া-আসা করে।

তিনি লিখেছেন, ‘সেখানে আমি আরবি বলতে শিখি। আমি প্রায়ই আমার তত্ত্বাবধায়কের চোখ এড়িয়ে বাড়ির বাইরে যেতাম। আমার আলজেরিয়ান বন্ধুদের সাথে মসজিদে ঘুরে বেড়াতাম। ধীরে ধীরে অবচেতন মনে আমি পুরোপুরি মুসলমান হয়ে উঠি।’

ডানমোর পার্কের পৈত্রিক বাড়িতে থাকার সময় তিনি হরিণ শিকার ও স্যামন মাছ ধরায় দক্ষ হয়ে ওঠেন।

তাঁর পরিব্রাজক বাবা, সপ্তম আর্ল অব ডানমোর, প্রায়ই চীন এবং কানাডার মত দেশে ঘুরতে যেতেন। তাঁর মাও ছিলেন একজন পর্যটক।

বাবা মায়ের মতই লেডি এভলিনও ঘুরে বেড়াতে ভীষণ ভালোবাসতেন।

কায়রোতে লেডি এভলিনের সঙ্গে দেখা হয় জন কোবোল্ডের। পরে যাকে তিনি বিয়ে করেন। জন কোবোল্ডও বেশ ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান।

লেডি এভলিন ঠিক কবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তা জানা যায় না। তবে ছোটবেলার অভিজ্ঞতার রেশ তার মনে রয়ে গিয়েছিল।

একবার ছুটি কাটাতে এভলিন রোমে গেলেন। সেখানে তার সঙ্গে দেখা হয় পোপের।

এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “হঠাৎ পোপ যখন আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমি ক্যাথলিক কিনা, আমি থমকে গেলাম, একটু ভাবলাম, তারপর বললাম, আমি মুসলমান।”

“আমি জানি না তখন আমাকে ঠিক কী পেয়ে বসেছিল। অনেক বছর ধরে আমি ইসলাম ধর্মের কথা ভাবিওনি। হঠাৎ আমার মনের মধ্যে যেন একটি বাতি জ্বলে উঠল। আমি ইসলাম সম্পর্কে আরো জানতে ও পড়তে শুরু করলাম।”

লেডি এভলিনের আত্মজীবনীর ভূমিকায় ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ফেইসি লিখেছেন, “বেশিরভাগ ধর্মান্তরিত মুসলমান আকৃষ্ট হয়েছিলেন এ ধর্মটির আধ্যাত্মিক দিকের প্রতি।”

তিনি আরো লিখেছেন, “তারা মনে করতেন, পৃথিবীতে যত ধর্ম আছে তাদের মূল কথা একই। ধর্মগুলোর ছোটখাটো বিভেদের মধ্যেও রয়েছে এক বড় ঐক্য। মানুষ ইচ্ছে করে ধর্মের ভেতর নানা বিভেদ তৈরি করে রেখেছে।”

মধ্যপ্রাচ্যে লেডি এভলিন তাঁর বন্ধুদের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘লেডি জয়নব’ নামে। সেখানে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত জায়গাগুলোতে তাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল। তিনি মুসলিম সংস্কৃতিতে নারীদের আধিপত্যমূলক প্রভাব নিয়ে একটি লেখাও লিখেছিলেন।

পঁয়ষট্টি বছর বয়সে তিনি হজ্ব পালন করতে মক্কায় যান। সম্ভবত তিনিই প্রথম ব্রিটিশ নারী যিনি হজ্ব পালন করেছেন।

তাঁর এই হজ্বযাত্রা নিয়ে তিনি পরে একটি বই প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি লেখেন যে ঐ যাত্রা তাকে অফুরান আনন্দের পাশাপাশি দিয়েছে সৌন্দর্য আর বিস্ময়ের অগাধ উপকরণ।

তিনি অল্প সময়ের জন্য কেনিয়া গিয়েছিলেন। এরপরে কী ঘটেছিল সে ব্যাপারে তেমন কিছু জানা যায়না।

১৯৬৩ সালে, ৯৫ বছর বয়সে স্কটল্যান্ডের এক নার্সিং হোমে তিনি মারা যান।

তিনি লিখে গিয়েছিলেন, তার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যেন ব্যাগপাইপ বাজানো হয়। আর তাঁর কবরে যেন কোরআনের ২৪ নম্বর সুরার ৩৫ নম্বর আয়াত (সূরা আন্ নূর এর একটি আয়াত) খোদাই করা হয়।

হাইল্যান্ডে তাঁর কবরে ‘সূরা আন্ নূর’ এর আয়াত খোদাই করা হয়েছিল, তবে পরে এটি কে বা কারা ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে নষ্ট করে দেয়। এটাই প্রমাণ করে যে তাঁর বিশ্বাস তাঁকে কতটা বিতর্কের মুখে ফেলেছিল।

তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “আমাকে লোকে প্রায়ই জিজ্ঞাসা করে যে, আমি কখন এবং কীভাবে মুসলিম হলাম।”

“উত্তরে আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি যে, আমি আসলেই জানি না প্রথম কখন ইসলামের আলো আমাকে ছুঁয়েছে।”

“আমার মনে হয় আমি সবসময়ই মুসলিম ছিলাম।”

রবার্ট স্ট্যানলি

ভিক্টোরিয়ান আমলে যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে ধনীদের ব্যাপারেই বেশি জানা যায়, যেহেতু তাদের ইতিহাসই ভালোভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

“দিনলিপি বা ডায়েরি লেখা ছিল মধ্যবিত্তদের কাজ”, বলছিলেন ক্রিস্টিনা লংডেন। তার বাবা তাদের বংশলতিকা খুঁজতে গিয়ে দেখেন তাদের পূর্বপুরুষদের একজন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।

সামান্য মুদি দোকানি থেকে স্ট্যালিব্রিজ শহরের মেয়র হয়েছিলেন রবার্ট স্ট্যানলি। তখন ১৮৭০ সাল।

মিস লংডেন তাঁকে নিয়ে লেখা এক বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে, রবার্ট স্ট্যানলি একজন ম্যাজিস্ট্রেটও ছিলেন।

তিনি সেইসব শ্রমিকদের জন্য ফান্ড সংগ্রহ করেছিলেন যারা তাদের বসদের পছন্দমত ভোট দিতে রাজি না হওয়ায় চাকরি খুইয়েছিলেন।

মি. স্ট্যানলি কুইলিয়ামের লিভারপুল মসজিদের নিউজলেটারে ব্রিটিশ ঔপনিবেশ নিয়ে নিয়মিত লিখতেন।

১৮৯০ সালের শেষ দিকে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার থেকে অবসর নেওয়ার পর কুইলিয়ামের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তারা খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।

মিস লংডেন বলেন, “রর্বাট ছিলেন কুইলিয়ামের চেয়ে ২৮ বছরের বড়। তাই আমার মনে হয় তাদের সম্পর্ক অনেকটা পিতা-পুত্রের মতই ছিল।”

১৮৯৮ সালে স্ট্যানলি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বয়স তখন ৭০ বছর।ধর্মান্তরিত হবার পরে তিনি নতুন নাম গ্রহণ করেন।

মিস লংডেন ধারণা প্রকাশ করেন যে তখন স্ট্যালিব্রিজে অন্য কোনো মুসলিম ছিল না। স্ট্যানলি পরে ম্যানচেস্টারে চলে যান। ১৯১১ সালে সেখানেই তিনি মারা যান।

তাঁর ধর্মান্তরের বিষয়টি তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের জানাননি। ১৯৯৮ সালে লংডেন এটি আবিস্কার করার আগ পর্যন্ত বিষয়টি তাদের কাছে অজানাই ছিল।

মিস লংডেন বলেন, “তখনকার সময়টা অন্যরকম। অন্যদের কাছে মুসলমান হবার কথা বলার মতন পরিস্থিতি তখন ছিল না।”

কাকতালীয়ভাবে, মিস লংডেনের ভাই স্টিভেন ১৯৯১ সালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।

স্টিভেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে মিশর গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন যা কিনা স্ট্যানলির ধর্মান্তরিত হবার কথা জানার সাত বছর আগের ঘটনা।

তার পূর্বপুরুষের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ব্যাপারটি শুনে তিনি খুশিতে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।

”ভাবা যায় একটা মানুষ ওইরকম একটা গোঁড়া সময়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন! আপনি ভেবে দেখুন সেটা কোন সময়, আর সেটা ম্যানচেস্টারের মত জায়গায়!”

”মানুষ যা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে তা বলতে এখন আর দ্বিধা করে না। সেটা রাজনীতির ব্যাপারেই হোক, আর ধর্মীয় ব্যাপারেই হোক।”

আরএম-০১/২১/০৫ (ধর্ম ডেস্ক)