নবীপুত্র ইসমাইলের কোরবানির ঘটনা

নবীপুত্র ইসমাইলের

মা হাজেরা (আ.) এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পুত্রকে কোরবানি করার উদ্দেশ্যে ইবরাহিম (আ.) মিনায় রওনা হন। পথে কয়েবার শয়তান ইবরাহিম (আ.) এর গতিরোধ করে আল্লাহর নির্দেশ পালনে বাধা সৃষ্টি করে। কিন্তু তিনি পাথর মেরে শয়তানকে তাড়িয়ে দেন। অদ্যাবধি এ প্রশংসনীয় কাজের স্মৃতির অনুসরণে হাজীরা মিনায় তিনটি স্থানে পাথর নিক্ষেপ করেন। এটি হজের গুরুত্বপূর্ণ আমলও বটে

ইবরাহিম (আ.) দোয়া করলেন, ‘হে প্রভু! আমাকে একটি নেক্কার সন্তান দান করুন। ফলে আমি তাকে একটি ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম।’ (সূরা সাফফাত : ১০০)। আল্লাহর বন্ধু ইবরাহিম (আ.) ছিলেন নিঃসন্তান। জীবনের পড়ন্ত বেলায় আল্লাহ তায়ালা তাকে সন্তান দান করেন। জন্মের পর নাম রাখেন ইসমাইল। আরবি ‘ইসমা’ অর্থ শোন আর হিব্রু ভাষায় ‘ইল’ মানে আল্লাহ। সন্তানের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা ইবরাহিম (আ.) এর প্রার্থনা কবুল করেছেন বিধায় এ নাম রাখা হয়।

পরীক্ষার জীবন

জন্মের পরপরই কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন ইসমাইল (আ.)। জন্মের পর তিনি তখনও অবোধ। মহান আল্লাহর নির্দেশে ইবরাহিম (আ.) স্ত্রী হাজেরা ও শিশু ইসমাইলকে আরবের বিজন এক পাথুরে প্রান্তরে পাহাড়ের পাদদেশে রেখে যান, সেই জায়গাতেই পরে জমজম কূপের আত্মপ্রকাশ এবং কাবাঘর প্রতিষ্ঠিত হয়।

জনমানবহীন মরুভূমিতে মা হাজেরা ও শিশু ইসমাইল একাকী জীবনযাপন করতে লাগলেন। একদিন নিদারুণ পিপাসায় কাতর হয়ে মা হাজেরা (আ.) পানির খোঁজে একবার সাফা পাহাড়ে যান আবার মনে হলো মারওয়া পাহাড়ে গেলে পানির সন্ধান পাওয়া যাবে। এভাবে তিনি পাহাড়দ্বয়ের মাঝে সাতবার দৌড়ান। এরই মধ্যে কোনো অদৃশ্য আওয়াজ আঁচ করতে পেরে ফিরে এসে দেখেন ইসমাইলের পায়ের কাছে একটি পানির ফোয়ারা উথলে উঠছে। মা হাজেরা তাড়াতাড়ি পানির চারপাশে বাঁধ দিয়ে দিলেন। বর্তমানে এটিই জমজম কূপ নামে পরিচিত।

ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা

ইসমাইল (আ.) এর বয়স যখন ৭ কিংবা ১৩ বছর, তখন পিতা ইবরাহিম (আ.) স্বপ্নযোগে ইসমাইলকে কোরবানি করার নির্দেশ পান। পবিত্র কোরআনে এ ঘটনা এভাবে বর্ণিত হয়েছেÑ ‘অতঃপর যখন পুত্র পিতার সঙ্গে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো, তখন ইবরাহিম বললেন, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে আমি তোমাকে জবাই করছি।’ (সূরা সাফফাত : ১০২)। পয়গম্বরদের স্বপ্ন ওহি হয়ে থাকে। তাই এ স্বপ্নের অর্থ ছিল, ইসমাইলকে জবাই করার ব্যাপারে ইবরাহিমের প্রতি আল্লাহপাকের নির্দেশ। এ নির্দেশ তিনি সরাসরি ফেরেশতার মাধ্যমেও দিতে পারতেন; কিন্তু স্বপ্নে দেখানোর তাৎপর্য হলো, ইবরাহিম (আ.) এর আনুগত্য পূর্ণমাত্রায় প্রকাশ পাওয়া। স্বপ্নের মাধ্যমে প্রদত্ত নির্দেশের ভিন্ন অর্থ নেওয়ার যথেষ্ট অবকাশ ছিল। কিন্তু আল্লাহর বন্ধু ইবরাহিম (আ.) কোনোরূপ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের আশ্রয় নেওয়ার পরিবর্তে নিঃসংকোচে আল্লাহপাকের নির্দেশের সামনে মাথানত করে দেন। তিনি স্বপ্ন সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেননি যে, ‘এত কঠিন নির্দেশ কেন আমাকে দেওয়া হলো? পৃথিবীর কোনো আইনে তো পিতা কর্তৃক সন্তান জবাই করার নজির নেই। কোনো সুস্থ বিবেকও এটা সমর্থন করে না। তাহলে কেন এই নির্দেশ? কী এর রহস্য? ইবরাহিম (আ.) সব দ্বিধা-সংকোচ পরিহার করে স্বতঃস্ফূর্র্তভাবে আল্লাহর নির্দেশ পালনে তৈরি হয়ে গেলেন। তবে মহান মালিকের নির্দেশের গুরুত্ব সন্তান কতটা উপলব্ধি করতে শিখেছে, তা যাচাইয়ের জন্য ছেলেকে ডেকে বললেন, ‘হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে আমি তোমাকে জবাই করছি।’ এতে তোমার কী অভিমত?’

ইসমাইল আল্লাহর বন্ধুর পুত্র এবং ভাবী পয়গম্বর। তাছাড়া তার ঔরসেই একদা জন্মগ্রহণ করবেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব মুহাম্মদ (সা.)। তাই তিনি পিতাকে জিজ্ঞেস করেননি, ‘আব্বু! আমি এমনকি অপরাধ করেছি যে, আমাকে জবাই করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে? এ কঠিন নির্দেশের মধ্যে আল্লাহর কী রহস্য? বরং তিনি সরলকণ্ঠে বললেন, ‘আব্বাজান! আপনাকে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা পালন করুন। আমাকে ইনশাআল্লাহ ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন।’ (সূরা সাফফাত : ১০২)। ভবিষ্যতের কোনো কথা বলতে গিয়ে ‘ইনশাআল্লাহ’ বলা আল্লাহর শেখানো আদব, যা পবিত্র কোরআনে আমাদের নবীজির এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বর্ণিত হয়েছে। শিশু ইসমাইলের কথায় আদব ও বিনয় প্রকাশ পেয়েছে। কারণ তিনি ‘ইনশাআল্লাহ’ বলে ব্যাপারটি আল্লাহর কাছে সমর্পণ করেছেন। আবার ‘আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন’ বলে বুঝিয়েছেন, ধৈর্য ও সহনশীলতা শুধু আমার একার কৃতিত্ব নয়; বরং জগতে আরও বহু ধৈর্যশীল ব্যক্তি রয়েছেন। (তাফসিরে রুহুল মায়ানি)।

মিনা প্রান্তরে ইসমাইল (আ.)

মা হাজেরা (আ.) এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পুত্রকে কোরবানি করার উদ্দেশ্যে ইবরাহিম (আ.) মিনায় রওনা হন। পথে কয়েবার শয়তান ইবরাহিম (আ.) এর গতিরোধ করে আল্লাহর নির্দেশ পালনে বাধা সৃষ্টি করে। কিন্তু তিনি পাথর মেরে শয়তানকে তাড়িয়ে দেন। অদ্যাবধি এ প্রশংসনীয় কাজের স্মৃতির অনুসরণে হাজীরা মিনায় তিনটি স্থানে পাথর নিক্ষেপ করেন। এটি হজের গুরুত্বপূর্ণ আমলও বটে।

কোনো কোনো বর্ণনায় রয়েছে, রাস্তায় ইসমাইলের সঙ্গে শয়তানের তর্ক হয়। তিনি শয়তানকে অভিশম্পাত করেন এবং আল্লাহর জন্য কোরবানি হতে নিজেকে উৎসর্গিত করেন। মিনায় পৌঁছে ইবরাহিম (আ.) যখন জবাই করতে পুরোপুরি প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন, তখন ইসমাইল (আ.) পিতাকে বলে দিলেন, ‘আপনি আমাকে উপুড় করে শুইয়ে দিন এবং আপনার চোখ দুটো বেঁধে নিন। যাতে আমার মুখম-ল দেখে আপনার অন্তরে পিতৃস্নেহ উথলে না ওঠে। আর আমিও ছুরি দেখে ঘাবড়ে না যাই। পিতা-পুত্রের এ আচরণ আল্লাহপাক এতটাই পছন্দ করেছেন যে, পবিত্র কোরআনে তা উল্লেখ করে চিরদিনের জন্য সংরক্ষিত করেছেন। এরশাদ হয়েছেÑ ‘যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইবরাহিম তাকে জবাই করার জন্য মাটিতে উপুড় করে শুইয়ে দিল, তখন আমি ডেকে বললাম, হে ইবরাহিম, তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে। আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই এটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে জবাই করার জন্য দিলাম এক মহান জন্তু।’ (সূরা সাফফাত : ১০৩-১০৭)।

‘এক মহান জন্তু’ বলতে ছিল বেহেশতি দুম্বা। আল্লাহর নির্দেশে ইবরাহিম (আ.) পুত্র ইসমাইলের পরিবর্তে সেই বেহেশতি দুম্বা জবাই করেন। এরই অনুকরণে যুগে যুগে মুসলমানরা আল্লাহর জন্য জীবনের সবকিছু উৎসর্গ করার চেতনা নিয়ে কোরবানির পশু জবাই করে থাকেন। তারই অনুসরণে মুসলিম জাতি কোরবানির দিন পশু জবাই করে।

আরএম-০৫/০৮/০৮ (ধর্ম ডেস্ক)