বিভিন্ন ধর্মে নারীর প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি

বিভিন্ন ধর্মে

জাহেলি যুগে নারীদেরকে মানুষ ও পশুর মাঝামাঝি একটি জীব বিশেষ মনে করা হতো। যার উদ্দেশ্যে হলো মানুষের বংশ বৃদ্ধি এবং পুরুষের সেবা করা। আর এ জন্যই কন্যা সন্তানের জন্মগ্রহণ লোক সমাজে শরম ও লজ্জার কারণ ছিল। ভূমিষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে জীবন্ত কবর দিতো এবং এটাকেই গৌরব ও আভিজাত্যের বস্তু হিসেবে মনে করা হতো।

সর্বত্র অবলা নারীদের ওপর জুলুম নির্যাতন চালানো হতো। জোর যবরদস্তি করে তাদের সঙ্গে সহবাস করা হতো। তাদের ধারণা ছিল এটা যে, নারীরা হলো ভোগের সামগ্রী। নারীদেরকে তাদের নির্দিষ্ট ঋতুবর্তী সময়ে গবাদি পশুর মতো গোয়াল ঘরে বা আস্তাবলে বেঁধে রাখা হতো। মানুষ হিসেবে তাদেরকে অধিকার দিতো না।

জীব-জন্তু অন্যান্য প্রাণী ও নারীদের মাঝে কোনো পার্থক্য ছিল না। এই বর্বর জাতিদের অবস্থা স্বয়ং আল কোরআন থেকেই জানা যায়।  নারী জন্মের পর পিতাদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে স্বয়ং কোরআন বর্ণনা-

وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُمْ بِالْأُنْثَى ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًّا وَهُوَ كَظِيمٌ () يَتَوَارَى مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوءِ مَا بُشِّرَ بِهِ أَيُمْسِكُهُ عَلَى هُونٍ أَمْ يَدُسُّهُ فِي التُّرَابِ أَلَا سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ

অর্থাৎ : ‘তাদের কাউকে যখন কন্যা সন্তান জন্মনোর সুসংবাদ দেয়া হয় তখন তার চেহারা কালো হয়ে যায় এবং এক অসহনীয় মর্মাহতর ন্যায় ভূগতে থাকে। তাকে যে কন্যা জন্মানোর সংবাদ দেয়া হয়েছে, তার লজ্জায় সে মানুষ থেকে লুকিয়ে থাকত। সে চিন্তা করে, হীনতা সত্তেও সে তাকে রেখে দেবে না মাটিতে পুঁতে ফেলবে?। (সূরা: নাহল, আয়াত: ৫৮-৫৯)।

আল কোরআনের হুঁশিয়ারি

এ ব্যাপারে আল কোরআনের হুশিয়ারি হলো-

وَإِذَا الْمَوْءُودَةُ سُئِلَتْ () بِأَيِّ ذَنْبٍ قُتِلَتْ

অর্থাৎ : যখন জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে কি অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। (সূরা তাকভির, আয়াত: ৮-৯)।

যে সব পিতা-মাতারা অপমানের গ্লানি নিয়ে সন্তান হত্যার অপরাধে লিপ্ত তাদের হুঁশিয়ারি করে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন,

وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلَاقٍ نَحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَإِيَّاكُمْ إِنَّ قَتْلَهُمْ كَانَ خِطْئًا كَبِيرًا

অর্থাৎ : ‘দারিদ্র্যতার ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না। আমিই তোমাদেরকে ও তাদেরকে জীবিকা দিয়ে থাকি।’ (সূরা: বানি ইসরাইল, আয়াত: আয়াত: ৩১)।

অন্যত্রে বলেন,

َلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلَاقٍ نَحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَإِيَّاكُمْ إِنَّ قَتْلَهُمْ كَانَ خِطْئًا كَبِيرًا

অর্থাৎ : ‘নিশ্চয়ই তাদের (অবলা শিশু সন্তানদের) হত্যা করা মহাপাপ।’

বিভিন্ন ধর্মে নারী

আরবের বাহিরে কোন দৃষ্টিতে নারীদের দেখা হতো। এ সম্পর্কে জনৈক প্রখ্যাত অমুসলিম ডা. গুস্তাওলিবনের উক্তি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি বলেন, গ্রীকরা সাধারণত নারীদেরকে নীচু স্তরের মনে করতো। কোনো স্ত্রীলোকের অস্বাভাবিক সন্তান জন্মালে তাকে হত্যা করে ফেলা হতো। (তামাদ্দুনে আরব : ৩৭)। ‘প্রাচীন কালের’ বাগ্মী অধ্যায়ে লিখা আছে, আল্লাহর প্রিয় বান্দা মাত্রই নারীর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকবে। শহরের মধ্যে আমি একজন আল্লাহর প্রিয় পাত্র পেয়েছি কিন্তু সমগ্র পৃথিবীতেও আল্লাহর একজন প্রিয় পাত্রী পায়নি। (তামাদ্দুনে আরব : ৩৮)।

ইহুদি ধর্মে নারী

তাওরাতে লিখা আছে নারী মৃত্যুর চেয়েও বেশি তিক্ত। (তামাদ্দুনে আরব : ৩৭৩)।

ইয়াহুদিদের বিশ্বাস্য কিতাব ‘আহাদ নামায়ে আতিক’ নারী জাতি সম্পর্কে লেখা আছে- নারী সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য পুরুষকে আরাম পরিবেশন করা। নারী পাপের প্রবণ। প্যূজনক কাজ করার কোন যোগ্যতা নারীর মধ্যে নেই বলে সে মান সম্মানের যোগ্য হতে পারে না।

হিন্দু ধর্মে নারী

হিন্দু ধর্মে নারীদের অধিকারের ব্যাপারে কোনো লক্ষ্যই রাখেনি। এ ধর্মের মতো এতো কঠোর বিধান অন্য কোনো ধর্মে নেই। সতীদাহের মতো নির্মম অমানুষিক বিয়ে কিংবা স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আবার বিয়ে করার অনুমতি লাভ করতে পারে। কিন্তু নারী স্বামী হারানোর পর বেঁচে থাকাতো দূরের কথা, আরেক বিয়ে তো দূরের কথা, স্বামীর সঙ্গে জীবন্ত দগ্ধ না হলে মৃত স্বামীর সঙ্গে ছটফট করে পুড়ে মরতে না পারলে তার স্বর্গ লাভ হবে না। যদি কোনো নারী এই সতীদাহ হতে বেঁচেও যেত; ঘরে সমাজে বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়দের কাছে তার কোনো সম্মান থাকতো না। তাকে ঘৃণা ও লাঞ্ছনায় এমনভাবে বিদ্ধ করা হতো, যার ফলে তার বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই শ্রেয় মনে হতো।

হিন্দু ধর্মে স্বামী সৎ হলে তো স্ত্রীর জীবন সুখের কিন্তু অসৎ হলে তার জুলুম নির্যাতন থেকে নারীকে মুক্তি দেবার কোনো পথ রাখেনি। এমনকি স্ত্রীর সঙ্গে ‘অসদাচরণ করা পাপ’ এ কথাও বলে দেয়নি স্বামীকে বরং উল্টো বলা হয়েছে, নারী দিন রাত্রীর কোনো সময় স্বাধীন থাকতে পারবে না, সমস্ত ক্ষমতা স্বামীর থাকবে। (মনু) নারী স্বাধীন হওয়ার উপযুক্ত নয়। (মনু) বাবা মেয়েকে যার সঙ্গে বিয়ে দেবেন সেখানেই আজীবন থাকতে হবে এবং স্বামীর মৃত্যুর পর অন্য কোনো পুরুষের ঘর সংসার করতে পারবে না। অর্থাৎ আজীবন বিধবা হয়ে থাকতে হবে। হিন্দু আইনে আছে- অদৃষ্ট নরক, বন্য ও বিষধর সর্প এর কোনোটাই নারীর সমান ক্ষতিকর নয়।

খৃস্টান ধর্মে নারী

তারতুলিয়ান নামে খৃস্টান ধর্মের প্রাথমিক যুগের ধর্মগুরু ছিলেন। তিনি নারী সম্বন্ধীয় খ্রিস্টীয় চিন্তাধারা নিম্নভাষায় ব্যক্ত করেছেন।

‘সে শয়তান আগমনের দ্বার স্বরূপ, সে নিষিদ্ধ বৃক্ষের আকর্ষণকারিণী আল্লাহর আইন ভঙ্গকারিণী এবং আল্লাহর প্রতিমূর্তি পুরুষের ধ্বংসকারিণী। ক্রাই সোসটাম নামে একজন বড় ধর্মগুরু রয়েছে; তিনি বলেন- নারী একটি অনিবার্য পাপ। একটি জন্মগত কু-প্ররোচনা, একটি আনন্দায়ক বিপদ, একটি পারিবারিক আশংকা, একটি ধ্বংসাত্মক প্রেমদায়িনী এবং একটি সজ্জিত দুর্ঘটনা।

নারী সম্পর্কে বিভিন্ন দেশের প্রবাদ-

রুশ প্রবাদ : দশটি নারীতে একটি আত্মা

ইটালীয় প্রবাদ : ঘোড়া ভালো হোক কি মন্দ, মারপিটের প্রয়োজন, নারী ভালো হোক কি মন্দ তার মারপিটের প্রয়োজন

স্পেনিশ প্রবাদ : কুৎসিত রমণী থেকে দূরে থাকা উচিৎ কিন্তু সুন্দর রমণীর ওপর ভরসা করা উচিৎ নয়। (তামুদ্দুনে আরব- ৩৭৮)।

ইসলামে নারী

ইসলাম এসে নারীদেরকে এ অন্ধাকার অমানিষা থেকে উদ্ধার করেছে। তাদের সম্মান ফিরিয়ে দিয়েছে। ফিরিয়ে দিয়েছে ইজ্জত আবরু রক্ষার অধিকার। নারী ফিরে পেয়েছে তাদের বেঁচে থাকার অধিকার। ফিরে পেয়েছে সত্যিকারের স্বাধীনতা। উত্তরাধিকার ও মহরের অধিকার দিয়েছে একমাত্র ইসলাম। যে নারী বেঁচে ছিল একাকী লজ্জা শরমের গ্লানী নিয়ে দুঃখে মরে ছিল নির্জনে। মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার জায়গা ছিল যখন সংকীর্ণ, ইসলাম সেই নারীকে শির উঁচু করে কথা বলার  সুযোগ দিয়েছে, দিয়েছে সম্মান ইজ্জতের গ্যারান্টি। সব বাড়াবাড়িকে খতম করে সাম্যের স্বাভাবিক কেন্দ্রবিন্দুতে ইসলাম মানব জাতিকে এনে দাঁড় করালো, যার যা প্রাপ্য ছিল তাকে তাই দেয়া হলো।

নারীর মর্যাদা রক্ষায় ঘোষণা

নারী অধিকার রক্ষায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেন-

يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً

অর্থাৎ: ‘হে মানব সম্প্রদায়! তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর; যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেন। আর যিনি দু’জন হতে নারী পুরুষ বিস্তার করেন।’ (সূরা: আন নিসা, আয়াত: ১)।

মোদ্দাকথা পুরুষ এবং নারী একই ঝরনার দু’টি তরঙ্গ মাত্র। মানুষ হিসেবে দুয়ের ভেতর বিশেষ পার্থক্য করা বাস্তবভিত্তিক নয়, বরং কল্পনাপ্রসূত। আল্লাহ অন্যত্রে বলেন-

يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ

অর্থাৎ: ‘হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে। পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট মর্যাদা সম্পন্ন যে অধিক সাবধানী।’ (সূরা: আন নিসা, আয়াত: ১৩)।

উপরোক্ত আয়াত থেকে একথাই স্পষ্ট বুঝা যায় যে, কোনো পুরুষই এমন নেই যার অস্তিত্বের ব্যাপারে নারী সমঅংশীদার নয়। নারী ব্যতীত শুধু পুরুষ দ্বারা জন্ম লাভের দাবিকে করতে পারে? তাহলে পুরুষের কি অধিকার আছে পুরুষকে সম্মানিত ও নারীকে ঘৃণিত ভাবার? মানবদেহে গঠনে পুরুষের চাইতে নারীর ভূমিকা কোনো অংশেই কম নয়। বরং চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে নারীর অবদানই সমধিক।

কন্যার প্রতি সদাচারণের নির্দেশ

ইসলাম নারীকে তার সঠিক স্থান দান করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং তাদের সঙ্গে সদাচারণ করার নির্দেশ দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি সাবালিকা হওয়া পর্যন্ত দু’টি কন্যা সন্তান প্রতিপালন করবে এবং দ্বীনি জ্ঞান শিক্ষা দেবে ও সৎ পাত্রস্থ করবে; আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করবেন। (রিয়াযুস সালেহীন পৃঃ ১৪৬)।

হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, একদা এক স্ত্রীলোক দু’টি কন্যা সন্তানসহ আমার নিকট আগমন করলো স্ত্রী লোকটি অসহায় ও নিঃস্ব ছিল। সে আমার নিকট ভিক্ষা প্রার্থনা করল। আমার নিকট তখন একটি মাত্র শুকনো খেজুর ছিল। আমি সেটা তাকে দান করলাম। সে খেজুরটি দু টুকরো করে দু সন্তানকে দিলো নিজে একটু খেলো না। তারপর উঠে চলে গেল। ইত্যবসরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্দরে প্রবেশ করলেন। আমি এ ঘটনা বর্ণনা করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে কেউ তার কন্যাদের জন্য কষ্ট সহ্য করবে, তাদের ভালো ব্যবহার করবে তার জন্য এ কন্যারা দোযখে ঢাল স্বরূপ হবে। (বুখারী মুসলিম) অর্থাৎ দোযখের আগুন কন্যা প্রতিপালনকারীদের স্পর্শ করবে না।

এ হচ্ছে ইসলামে নারীর মর্যাদা। নারীরা যখন ইসলাম মেনে চলবে তখনই তারা তাদের প্রকৃত মর্যাদা অনুধাবন করতে পারবে। আল্লাহ তায়ালা সবাইকে তাওফিক দিন। আমিন।

আরএম-২৪/১৫/০২ (ধর্ম ডেস্ক)