দুঃস্থ মানবতার সেবায় মানুষের করণীয়

প্রাণঘাতী বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপে বিপর্যস্ত মানবতা। অধিকাংশ মানুষই অসহায় দারিদ্রপীড়িত। করোনার কারণে এ অসহায়ত্ব বেড়ে গেছে অনেকগুণ। কর্ম বন্ধ হওয়ায় সাধারণ মানুষের অভাবও বেড়ে গেছে। অভাবের তাড়নায় চিন্তিত অস্থির মানুষ স্বাভাবিক কাজ তথা জীবন-যাপনে গতি হারিয়ে ফেলেছে। মানবতার উপকারে আসে এমন চিন্তাভাবনাও লোপ পেয়েছে।

বৈশ্বিক মহামারি করোনায় দুঃস্থ মানবতার সেবায় মানুষের রয়েছে অনেক করণীয়। হাদিসে পাকে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ঈমানের ৭৭টি শাখা রয়েছে। তন্মধ্যে একটি হলো রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরানো। এক কথায় যাকে বলা হয় মানবসেবা। হাদিসের আলোকে বুঝা যায়, মানব সেবাও ইসলামের অন্যতম একটি শাখা।

মানব সেবায় যারা জড়িত তাদের সবার মাঝে এ কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধকারী হিসেবে যে শক্তি কাজ করে, সেটা হচ্ছে মানুষের মানবতাবোধ। যার মাঝে মানবতাবোধ আছে সেই মানবসেবার একাজে এগিয়ে আসে। প্রাণঘাতী মহামারি করোনায় এ মানবতাবোধের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।

কারো প্রতিবেশি যদি পেটে ক্ষুধা নিয়ে রাত যাপন করে, কেউ যদি কোনো পথশিশুকে ক্ষুধার তড়নায় কাতরাতে দেখে আর সে যদি ক্ষুধার্ত প্রতিবেশি কিংবা ক্ষুধার্ত পথশিশুর পাশে এসে না দাঁড়ায়, তাহলে বুঝতে হবে তার মাঝে মানবতার লেশমাত্রও নেই।

যার মাঝে মানবতাবোধ আছে সে অবশ্যই অসহায় দুঃস্থ মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবে। তার সামর্থ অনুযায়ী এগিয়ে আসবে সহযোগিতা করবে। আর এটাইতো মানবতার সেবা। এটা মহান আল্লাহ তাআলার গুণসমূহের মধ্যে অন্যতম গুণ।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা সর্বোত্তম উপমা দিয়ে মানুষের স্মরণে রাখার মতো নসিহত ঘোষণা করেছেন-
أَلَمْ يَجِدْكَ يَتِيمًا فَآوَى – وَوَجَدَكَ ضَالًّا فَهَدَى – وَوَجَدَكَ عَائِلًا فَأَغْنَى – فَأَمَّا الْيَتِيمَ فَلَا تَقْهَرْ – وَأَمَّا السَّائِلَ فَلَا تَنْهَرْ – وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ
তিনি কি আপনাকে (আল্লাহ তাআলা প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে) ইয়াতিম রূপে পাননি? অতপর তিনি আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি আপনাকে পেয়েছেন পথহারা, অতপর পথপ্রদর্শন করেছেন। তিনি আপনাকে পেয়েছেন নিঃস্ব, অতপর অভাবমুক্ত করেছেন। সুতরাং আপনি ইয়াতিমের প্রতি কঠোর হবেন না। সওয়ালকারীকে ধমক দেবেন না। এবং আপনার পালনকর্তার নেয়ামতের কথা প্রকাশ করুন।’ (সুরা দোহা : আয়াত ৬-১১)

এ আয়াতগুলোতে উঠে এসেছে মানবতার সেবার প্রতি উদ্বুদ্ধকারী নসিহতগুলো। যেভাবে আল্লাহ তাআলা বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তার অসহায়ত্বের সময় আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন এবং মানুষের অসহায়ত্বের সময় করণীয় কী হবে তা বর্ণনাও করেছেন।

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা দুঃস্থ মানবতার সেবায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করতে নসিহত পেশ করে বলেন-
وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَى حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا – إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ لَا نُرِيدُ مِنكُمْ جَزَاء وَلَا شُكُورًا

তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত, এতীম ও বন্দীকে আহার্য দান করে। তারা বলে, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না। (সুরা দাহর : আয়াত ৮-৯)

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা অসহায় ইয়াতিম মিসকিন এবং বন্দীদের খাবার দান করাকে মুমিনের অন্যতম গুণ বা বৈশিষ্ট্য হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। অসহায়দের পাশে না দাঁড়ানো, তাদের খোঁজ-খবর না রাখা, তাদের বিপদে এগিয়ে না আসা; এগুলো কোনো মুমিনের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। বরং মুমিনগণ দুঃস্থ মানবতার সেবায় সদা তৎপর। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের উদ্দেশ্যে বলেন-

وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ – وَالَّذِينَ هُمْ لِلزَّكَاةِ فَاعِلُونَ

মুমিন তারাই যারা অসাড় কাজ-কর্ম বা কথা-বার্তা থেকে বিরত থাকে এবং যারা জাকাত প্রদানে সক্রিয় হয়।’ (সুরা মুমিনুন : আয়াত ৩-৪)

এ আয়াতের সমর্থনে অন্য আয়াত দ্বারা দুঃস্থ মানবতার সেবায় সহযোগিতার খাত বিস্তারিত বর্ণনা করেন। তাতে ওঠে এসেছে কারা পাবে এ সহযোগিতা। আর কারা দুঃস্থ এবং অসহায়, যাদের সহযোগিতা করা আবশ্যক। দুঃস্থদের সহযোগিতায় বিধান জারি করে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-

إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاء وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللّهِ وَابْنِ السَّبِيلِ فَرِيضَةً مِّنَ اللّهِ وَاللّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
জাকাত হল কেবল ফকির, মিসকিন, জাকাত আদায়কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক এবং তা দাস-মুক্তিতে ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জেহাদকারীদের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য, এই হল আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরাতাওবা : আয়াত ৬০)

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা প্রথমেই ফকির ও মিসকিনের কথা উল্লেখ করেছেন। জাকাতের আটটি খাতের প্রথমেই রয়েছে ফকির। ফকির হলো সেই ব্যক্তি যারা ইয়াতিম শিশু, বিধবা নারী, উপার্জনহীন বেকার এবং এমন সব লোক যারা সাময়িক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন।

বর্তমান মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবের এ সময়ে যারা কাজ-কর্মহীন হয়ে বেকার জীবন-যাপন করছে, জীবন-যাপনে নেই কোনো সহায় সম্বল তারাও দুঃস্থ ও অসহায়। তাদের সহযোগিতার জন্যই কুরআনের আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের জন্য বিধান জারি করেছেন। হাদিসে এসেছে-

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিনিয়ত আল্লাহর কাছে দারিদ্র থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। আল্লাহর কাছে এভাবে দোয়া করতেন-

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল কুফরি ওয়াল ফিকরি।’
অর্থ : হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি আপনার কাছে কুফর এবং দারিদ্র থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

তারপর মিসকিনের কথা বলতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ-সম্পদ পায় না, যাকে সাহায্য করার জন্য চিহ্নিত করা যায় না এবং নিজে দাাঁড়িয়ে কারো কাছে সাহায্যও চায় না ওই ব্যক্তি মিসকিন। অর্থাৎ মিসকিন হলো একজন সম্ভ্রান্ত ভদ্র গরিব অসহায় মানুষ। সুতরাং দ্বিধাহীনভাবে এ কথা বলা চলে যে, ইসলাম দুঃস্থ মানবতার সেবার অনন্য ও সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম।

কুরআন-সুন্নাহর আলোকেও এ কথা প্রতিয়মান হয় যে, ইসলাম দুঃস্থ মানবতার সেবায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করতে জোর নির্দেশনা দেয়। শুধু তাই নয়, ধনীর ব্যক্তির জন্য গরিব-অসহায় দুঃস্থ ব্যক্তিদের সহযোগিতা করা কিংবা জাকাত দেয়াকে আবশ্যক করে দিয়েছে ইসলাম।

করোনার এ দুঃসময়ে সমাজের বিত্তবানদের জন্য দুঃস্থ মানবতার সেবায় এগিয়ে আসা একান্ত আবশ্যক। নিজ প্রতিবেশি থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে সমাজের সর্বস্তরের দুঃস্থ মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া ঈমানের একান্ত দাবি।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনের শুরুতে নবুয়ত লাভের আগে যৌবনে দুঃস্থ ও অসহায় মানবতার সেবায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পৃথিবীর ইতহাসের শ্রেষ্ঠ সংগঠন হিলফুল ফুজুল’। হিলফুল ফুজুল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকে বুঝা যায়, প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুঃস্থ ও অসহায় মানুষের প্রতি কতটা ব্যথিত ও উদার ছিলেন তা বিশ্বনবির দিকে তাকালেই এ প্রমাণ পাওয়া যায়।

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ওই ব্যক্তি পরিপূর্ণ মুমিন নয়, যে তৃপ্তি সহকারে আহার করে আর তার প্রতিবেশি ক্ষুধার্ত ও অনাহারে অভূক্ত থাকে।’

পৃথিবীর ইতিহাসে ইসলামই মানবতার এক জীবন্ত ধর্ম, যে ইসলামের অনুসারীরা যুগে যুগে দুঃস্থ মানবতার সেবায় কৃতিত্ব ও গৌরবের স্বাক্ষর রেখেছে। তাই প্রাণঘাতী মহামারি করোনাভাইরাসের এ বৈশ্বিক সংকটের সময় কুরআন-সুন্নাহর আমল নিজেদের মধ্যে বাস্তবায়ন করে দুঃস্থ ও অসহায়দের সহযোগিতায় এগিয়ে আসা ঈমানদার মুসলমানদের একান্ত করণীয় কাজ।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে করোনার এই প্রাদুর্ভাবের সময় নিজ নিজ উদ্যোগে দুঃস্থ ও অসহায় মানুষকে সহযোগিতা করে সমাজে অবদান রাখার তাওফিক দান করুন। কুরআন-সুন্নাহর উপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।