নির্বাচনি আচরণবিধির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন

জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠছে৷ আর এই অভিযোগ প্রধানত সরকারি দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিরদ্ধেই বেশি৷ এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার সমালোচনা হচ্ছে৷

জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে ৩০ ডিসেম্বর৷ আর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয় ৮ নভেম্বর৷ তফসিল ঘোষণার পর থেকেই আচরণবিধি কার্যকর হয়ে যায়৷ প্রচার-প্রচারণা শুরু করা যায় নির্বাচনের ২১ দিন আগে থেকে৷ এরই মধ্যে মনোনয়ন দাখিল শেষ হয়েছে, বাছাই করা হয়েছে ২ ডিসেম্বর রোববার৷ ৯ ডিসেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন৷ ১০ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পর থেকেই নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণা শুরু হবে৷ চলবে নির্বাচনের দিন, অর্থাৎ ৩০ ডিসেম্বরের ৪৮ ঘণ্টা আগ পর্যন্ত৷ কিন্তু মনোয়নপত্র বাছাই এরই মধ্যে প্রশ্নের মুখে পড়েছে৷

নির্বাচনের আচরণবিধি শুধু প্রচার-প্রচারণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়৷ এর সম্পর্ক পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে৷ এক্ষেত্রে প্রশাসনের ভূমিকা কী হবে? সরকারের আচরণ কেমন হবে? কারা সরকারি সুবিধা ভৈাগ করতে পারবেন? কারা পারবেন না? প্রার্থীদের আচরণ, দলগুলোর আচরণ, সংসদ সদস্য, মন্ত্রিসভার সদস্য– সবার ব্যাপারেই এই আচরণবিধি প্রযোজ্য৷ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সরকারের যেকেনো সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, সিদ্ধান্ত সবই নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকে৷ নির্বাচন কমিশন তার সিদ্ধান্তে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে৷

এ সংক্রান্ত মোট ১৯টি সুনির্দিষ্ট আইন আছে৷ আর তাতে নির্বাচন, নির্বাচনি প্রচার,সরকারি সুযোগ-সুবিধা, বক্তব্য-বিবৃতি সব কিছু কেমন হবে তা বলে দেয়া আছে৷ এসব আইনের লংঘন হলে শাস্তিসহ আরো কী ব্যবস্থা নেয়া যাবে তারও উল্লেখ আছে৷

নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে নির্বাচনি তথ্যকনিকা-৯ নামে একটি প্রচারপত্রের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণবিধিমালা তুলে ধরা হয়েছে৷ তাতে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, নির্বাচনের তিন সপ্তাহ আগে কোনো প্রচার-প্রচারণা চালানো যাবে না৷

আরো যা বলা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে রকারি রেস্ট হাউজ, ডাকবাংলো, সার্কিট হাউজ কোনো দল বা প্রার্থীর পক্ষে-বিপক্ষে প্রচারের জন্য ব্যবহার করা যাবে না৷ সরকারি যানবাহন ব্যবহার করা যাবে না৷ প্রচারণায় সবাই সমান সুযোগ পাবে৷ রাস্তাঘাট বন্ধ করে প্রচারসভা করা যাবে না৷ প্রচারসভা বা র‌্যালির জন্য ২৪ ঘণ্টা আগে অনুমতি নিতে হবে৷ কোনো প্রকার উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়া যাবে না৷

কিন্তু প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়মী লীগ ও বিএনপি তফসিল ঘোষণার পর থেকেই নির্বাচনি আচরণ বিধি লংঘন করছে বলে অভিযোগ৷ এই অভিযোগ শাসক দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেই বেশি৷ মনোনয়ন পত্র বিক্রি, মনোনয়নের চিঠি বিতরণ এবং নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র দাখিল সবক্ষেত্রেই দেখা গেছে শো-ডাউন৷ এ নিয়ে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে৷

নির্বাচন কমিশন মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় সর্বোচ্চ সাত জনকে একসঙ্গে যাওয়ার নির্দেশ দিলেও দুই প্রধান দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা কেউ এটা মেনেছেন বলে তথ্য নেই৷ বরং তাঁরা এই নীতি ভাঙতে কৌশলী হয়েছেন৷ কেউ কেউ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন,‘‘আমার সঙ্গে সাত জনই এসেছেন৷ বাকি যারা এসেছেন তাদের আমি চিনি না৷”

সংবাদ মাধ্যমে প্রতিদিনই এখন সম্ভাব্য প্রার্থীদের গণসংযোগ ও প্রচার-প্রচারণার প্রচুর খবর চোখে পড়ছে৷ অথচ আইন অনুযায়ী প্রচার-প্রচারণা শুরু হওয়ার কথা ১০ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে৷ শুধু তাই নয়, এখনো যেহেতু প্রার্থী চূড়ান্ত হয়নি, জোটের আসন ভাগাভাগি ঠিক হয়নি, তাই এক আসনে এক দলের একাধিক প্রার্থী আছেন৷ তাঁরা তাঁদের অবস্থান শক্ত করতে প্রতিদিনই নিজ এলাকায় শো-ডাউন করছেন৷ বর্তমান সংসদ সদস্য যাঁরা আবারো নির্বাচন করছেন, তাঁরা সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা নিয়েই এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন৷

বিএনপির পক্ষ থেকে প্রশাসনিক কর্মবর্তাসহ সরকারে মন্ত্রী, এমপিদের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লংঘনের একাধিক অভিযোগ করা হয়েছে৷ তবে নির্বাচন কমিশন এখনো ওইসব অভিযোগের সত্যতা পায়নি৷

ঢাকাসহ সারাদেশে নির্বাচনি পোস্টারে ভরে গেছে৷ দেয়ালগুলো সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে৷ তফসিল ঘোষণার পর পোস্টার সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়া হলেও তাতে সাড়া মেলেনি৷ কেউ দোয়া ও ভোট চাওয়ার ওইসব পোস্টার বা প্রচারপত্রের দায়িত্ব নিচ্ছেন না৷

নির্বাচন নিয়ে কাজ করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমরা আশা করি, সবাই আচরণবিধি মানবেন৷ কিন্তু আমাদের দেশে সেটা হয় না৷আর আচরণবিধি রাজনৈতিক দল, প্রার্থী সবার জন্য৷ এটা তফসিল ঘোষণার পর থেকেই কার্যকর৷ নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণার নিয়ম এই আচরণবিধির মধ্যেই আছে৷ কিন্তু এবার তফসিল ঘোষণার পর থেকেই যেন কেউ আচরণবিধির তেমন তোয়াক্কা করছেন না৷”

তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ৷ বাংলাদেশে সবার জন্য সমান সুযোগ দিয়ে একটি অংশগ্রণমুলক ও গ্রহণযোগ্য যে নির্বাচন আয়োজনের কথা, আমরা এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের ভূমিকায় সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছি না৷ নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন অভিযোগের ব্যাপারে কার্যকর আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছে না৷ আর যা নিচ্ছে, তাতে সরকারি দলের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠছে৷”

তিনি আরো বলেন,‘‘নির্বাচন কমিশনকে আরো শক্ত, সতর্ক এবং নিরপেক্ষ হতে হবে৷ যদি এখনকার অবস্থা চলতেই থাকে, তাহলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে৷”

ব্রতী’র নির্বাহী পরিচালক শারমীন মুরশীদ বলেন,‘‘শুরুতেই নির্বাচনি আচরণবিধির মৌলিক জায়গায় লঙ্ঘন হয়েছে৷ নির্বাচনে খরচের তো একটা সীমা বেঁধে দেয়া থাকে, তা কি মানা হচ্ছে? তফসিল ঘোষণার আগে থেকেই তো নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়ে গেছে৷ আর সরকারি দলের অনেকে পদে থেকেও তো প্রচারণা চালাচ্ছেন৷ নির্বাচন কমিশনের এটা আরো ভালোভাবে দেখা উচিত৷ তারা এটা করছেন না৷”

তিরি বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশনের এখন পুলিশকে নিয়ন্ত্রণে আনা উচিত৷ তারা এত যে গ্রেপ্তার করছে, তাতে নির্বাচনের পরিবেশ অন্যরকম করে দিচ্ছে৷ নির্বাচন কমিশন যে এগুলো আমলে নিচ্ছে না, সেটা তো সবাই বলছে৷ স্বাভাবিভাবেই এগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠছে৷”

এদিকে এবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নির্বাচনি প্রচারণায় বড় জায়গা দখল করে আছে৷ সেখানে প্রচার-প্রচারণা চলছে পুরো মাত্রায়৷ নিয়ম নীতি মানছে না কেউই৷

এসএইচ-০৮/০৪/১২ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)