নির্বাচনি প্রচারণায় সংঘাত-সংঘর্ষ-হামলা

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণার শুরুতেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংঘাত ও সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে৷ ঠাকুরগাওঁয়ে বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গাড়ি বহরে হামলা হয়েছে৷

সংঘর্ষের অভিযোগ উঠেছে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের নির্বাচনি এলাকাতেও৷ মঙ্গলবার প্রতীক বরাদ্দের পরপরই সারাদেশে নির্বাচনি প্রচারণা শুরু হয়৷ বিশেষ করে বড় দু’টি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র প্রার্থীদের আগাম প্রস্তুতি ছিল৷ প্রতীক পেয়েই মিছিল-শোভাযাত্রা শুরু করেন প্রার্থীরা৷ এরইমধ্যে ঢাকাসহ সারাদেশ নির্বাচনি পোস্টারে ছেয়ে গেছে৷ নির্বাচনি শোভাযাত্রাগুলোতে ব্যাপক মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷

বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফখরুল ইসলাস আলমগীর ঠাকুরগাঁও থেকে বুধবার আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু করেছেন৷ এরপর তিনি বগুড়া যাবেন৷ কিন্তু দুপুরে ঠাকুরগাঁওয়ে তাঁর গাড়ি বহর হামলার শিকার হয়৷ তিনি সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকে গাড়ি বহর নিয়ে তাঁর নির্বাচনি এলাকা ঠাকুরগাঁও-১ আসনের দানার হাট এলাকায় যান৷ ওই এলাকায় তাঁর গাড়িবহরে হামলা হয় বলে অভিযোগ৷ হামলাকারীরা বহরের ৪-৫টি গাড়ি ভাঙচুর করে৷ তবে মির্জা ফখরুলের গাড়ি অক্ষত আছে বলে জানা গেছে৷ তবে হামলায় বিএনপি’র কয়েকজন নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন৷

এদিকে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদের নির্বাচনি এলাকা নোয়াখালীর কবিরহাটে তাঁর একটি নির্বাচনি সভাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে৷ সকালের দিকে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে৷ এতে উভয় পক্ষের ৩০-৩৫ জন আহত হয়েছে৷ জানা গেছে, নোয়াখালীর জিরো পয়েন্ট এলাকায় বুধবার সকালে নোয়াখালী-৫ আসনের বিএনপি প্রার্থী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের পথসভা করার কথা ছিল৷ সকাল থেকেই সেখানে বিএনপি’র নেতা-কর্মীরা জড়ো হচ্ছিলেন৷ সকাল ১১টার দিকে বিএনপির একটি মিছিল আসার সময় কবিরহাট দক্ষিণ বাজারে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে৷ সংঘর্ষ পুরো বাজারে ছড়িয়ে পড়ে৷ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও হামলা হয়৷

এদিকে ঢাকা-৮ আসনের বিএনপি প্রার্থী মির্জা আব্বাস মঙ্গলবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে নিরপত্তাহীনতা ও পুলিশি হয়রানির অভিযোগ করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘বাসার সামনে পুলিশ কখনো সাদা পোশাকে আবার কখনো ইউনিফর্ম পরে অবস্থান করছে৷ বাসায় আমার আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে কোনো নেতা-কর্মী আসতে পারছে না৷ সোমবার থেকে থেকে ২০-২৫ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷”

সোমবার প্রতীক বরাদ্দের পরপরই সারাদেশে নির্বাচনি প্রচারণা শুরু হয় আর সেই সঙ্গে শুরু হয় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘাত, সংঘর্ষ ও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া৷ সোমবার এ ধরনের সংঘাত ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে কুমিল্লা, খুলনা, রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গাসহ আরো কয়েকটি এলকায়৷

কুমিল্লা-৬ সদর আসনে সোমবার বিএনপি’র প্রার্থীর শোভাযাত্রায় হামলারঅভিযোগ পাওয়া গেছে৷ অভিযোগ পাওয়া গেছে ককটেল হামলারও৷ একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষ থেকেও৷ হামলা ও সংঘর্ষে কমপক্ষে ৩০ জন আহত হয়েছেন৷

রাজশাহী-২ আসনে মহাজোটের প্রার্থী ফজলে হোসেন বাদশার কিরুদ্ধে নির্বাচনি আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ করেছেন বিএনপি প্রার্থী মিজানুর রহমান মিনু৷ মিনুর অভিযোগ, বাদশাহ নির্ধারিত আকারের চেয়ে বড় ফেস্টুন টানিয়েছেন৷

জামালপুর-৪ আসনে বিএনপি প্রার্থী ফরিদুল কবীর তালুকদার শামীমের নির্বাচনি প্রচারের মাইক ও ইজিবাইক ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে৷

চুয়াডাঙ্গা-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী শরীফুজ্জামান শরীফের গাড়িবহরে হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা৷ সোমবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে আলমডাঙ্গা উপজেলার মুন্সিগঞ্জ পশুহাট এলাকায় এ হামলার ঘটনা ঘটে৷ দুর্বৃত্তরা শরীফুজ্জামানের দুটি মাইক্রোবাসও ব্যাপক ভাঙচুর করে৷ এতে দুইজন আহত হন৷

চুয়াডাঙ্গা-২ আসনে বিএনপির প্রার্থী মাহমুদ হাসান খান বাবুর নির্বাচনি মিছিলে হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে৷ সোমবার সন্ধ্যায় জীবননগর উপজেলা শহরের চার রাস্তার মোড়ে এ হামলার ঘটনা ঘটে৷

এছাড়া খুলনায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের প্রচার মিছিলে পুলিশের বাধা দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে৷

মঙ্গলবার ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে বাম জোটের নির্বাচনি প্রচার শুরু হয়েছে৷ সকাল ১১টার দিকে শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্য দিয়ে নির্বাচনি প্রচার শুরু করে বাম গণতান্ত্রিক জোট৷ এই জোটের নেতা জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘‘একটি প্রতিকুল অবস্থার মধ্যে আমরা নির্বাচন করছি৷ আমরা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করেছি৷ সারাদেশেও আমাদের প্রার্থীরা শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে তাঁদের প্রচারণা শুরু করবেন৷”

আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার জিয়ারত শেষে কোটালিপাড়ায় জনসভার মাধ্যমে নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করবেন৷ দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে জানান, ‘‘তিনি সড়কপথে মঙ্গলবার সকালে টুঙ্গিপাড়ায় উপস্থিত হবেন এবং গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া ও টুঙ্গিপাড়ার বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করবেন৷ বৃহস্পতিবার তিনি সড়কপথে ঢাকা ফেরার পথে ফরিদপুরের ভাঙ্গা মোড়, ফরিদপুর মোড়, রাজবাড়ী রাস্তার মোড়, পাটুরিয়া ঘাট, মানিকগঞ্জ বাস স্ট্যান্ড, ধামরাই রাবেয়া মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল প্রাঙ্গণ ও সাভার বাসস্ট্যান্ডে নির্বাচনি প্রচার কর্মসূচিতে অংশ নেবেন৷”

সিলেট থেকে নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করবেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন৷ তিনি বুধবার সিলেট থেকে পথসভার মাধ্যমে নির্বাচনি প্রচার শুরু করছেন৷ প্রচার শুরুর আগে তিনি সিলেটে হযরত শাহজালালের মাজার জিয়ারত করবেন৷ তাঁর সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের কেন্দ্রীয় নেতারাও থাকবেন৷

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা মঙ্গলবার বলেছেন, ‘‘এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নির্বাচনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে৷ তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, উত্তাপের এই পরিবেশ যেন উত্তপ্ত না হয়৷ উত্তপ্ত হয়ে নির্বাচনি পরিবেশ যেন ব্যাহত না হয়, ব্যাঘাত না ঘটে৷” মঙ্গলবার সকালে আগারগাঁয় নির্বাচন ভবনের অডিটোরিয়ামে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটদের ব্রিফিংকালে তিনি একথা বলেন৷

তিনি আরো বলেন, ‘‘আমাদের কাজ শুধু ৩০ তারিখ৷ সেদিন ভোট হবে৷ আমাদের কাজ হলো সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ করা, যেন কোনো সংঘাত না হয়, ভুল বোঝাবুঝি না হয়৷ সবাই যেন নির্বাচনি আচরণবিধি মেনে চলেন, সেটা বুঝিয়ে দেয়া৷”

তিনি ম্যাজিষ্ট্রেটদের বলেন, ‘‘একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, নির্বাচনের আগের দিন ও নির্বাচনের দিন যেন সংঘাত না হয়৷ নির্বাচনের পরের সময়ও খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ ভোটের দিনের থেকে বেশি সংঘাত হয় পরের দিন৷”

প্রচারণার শুরুতেই যে পারিস্থিতি দেখা যাচ্ছে তাতে নির্বাচনে সহিংসতা এবং শক্তি প্রয়োগের আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা৷ সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন-এর প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি নির্বাচনে সংঘাতের আশঙ্কা করছি৷ কারণ, নির্বাচন প্রক্রিয়া তো ভেঙে পড়েছে৷ বল প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা আছে৷ ফলে সংঘাত সহিংসতা এড়ানো কঠিন হবে৷”

তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশন তো চরমভাবে পক্ষপাতদুষ্ট৷ নারায়ণগঞ্জে বিতর্কিত এসপিকে নিয়োগ করে তা আবারো প্রমাণ করলো৷ তারা মুখে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলে৷ কাজে কিছুই করে না৷ তারা যদি নিরপেক্ষ আচরণ শেষ পর্যন্ত না করতে পারে, তাহলে তো ঠুটো জগন্নাথে পরিণত হবে৷”

আর মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, ‘‘নির্বাচনে সরকারি দলের শক্তি প্রয়োগের যে একটা মানসিকতা থাকে তা প্রকাশিত হচ্ছে৷ নির্বাচনে নিরাপত্তা এবং নিরপেক্ষতার বিষয়টি হামলার কারণে বিঘ্নিত হবে৷”

তিনি বলেন, ‘‘এবারের নির্বাচনে আমি ব্যাপক সহিংসতার আশঙ্কা করছি৷ নির্বাচনের আগে গায়েবি মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে৷ আর এখন শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে একটা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টির আশঙ্কা আছে৷ এর মাধ্যমে সরকারি দল নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের পক্ষে আনতে চাইতে পারে৷”

এদিকে মঙ্গলবার ঢাকায় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠকের পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট মুলার সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আলোচনায় আমরা বলেছি, সব দল যেন অবাধে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার এবং রাজনীতি করার সুযোগ পায়৷ তারা যেন শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনি প্রচার চালাতে এবং সভা-সমাবেশ করতে পারে৷ সবাই যেন সহিংসতা থেকে দূরে থাকে, কেননা, সহিংসতা গণতন্ত্রের পথে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে৷ যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, সহিংসতা শুধু তাদের উদ্দেশ্য পূরণ করে৷”

এসএইচ-০৭/১২/১২ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)