তরুণ ভোটারদের নিয়ে টানাটানি

বাংলাদেশে এবারের নির্বাচনে তরুণ ভোটাররাই প্রাধান্য বিস্তার করবেন৷ সোয়া কোটির মতো তরুণ ভোটার এবারই প্রথম ভোট দেবেন৷ রাজনৈতিক দলগুলো তরুণ ভোটারদের গুরুত্বের কথা বললেও তাঁদের নিয়ে কর্মসূচি কী?

সম্প্রতি ‘লেটস টক উইথ শেখ হাসিনা’ নামে একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তরুণদের তাঁর জীবনের গল্প শোনান৷ গল্প শোনান মুক্তিযুদ্ধের, ভাষা আন্দোলনের, তাঁর জীবন সংগ্রামের৷ তরুণদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন৷ জবাব দেন দেশের উন্নয়ন নিয়ে নানা প্রশ্নের৷ তিনি সেখানে তরুণদের নিয়ে তাঁর স্বপ্নের কথা বলেন৷

বলেন, ভবিষ্যৎ নেতাদের জীবন কেমন হবে তা নিয়ে৷আগে ধারণ করা এই অনুষ্ঠান কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচার করা হয় ১৩ ডিসেম্বর রাতে৷ তিনি তরুণদের নিয়ে এই অনুষ্ঠানে প্রাণবন্ত এবং সাবলীল ছিলেন৷ তরুনরাও তাঁকে তাদের প্রশ্ন করেছেন অকপটে৷ তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সময় কাটান যেন গল্পে গল্পে৷ তাঁরাও ছিলেন উচ্ছ্বসিত৷ প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে কখনো তাঁরা হেসে ওঠেন, কখনো করতালিতে ফেটে পড়েন৷

শেখ হাসিনা নির্বাচনের আগে এরকম ঘরোয়া পরিবেশে আর কাউকে সময় দেননি৷ সময় দিয়েছেন শুধু তরুণদেরই৷ আর এ থেকেও ধারণা করা যেতে পারে তরুণরা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, কতটা কেন্দ্রে রয়েছেন তাঁরা৷ এবার শুধু আওয়ামীলীগই নয়, সব রাজনৈতিক দলই তরুণদের গুরুত্ব দিচ্ছে৷ যাঁরা এবার নতুন ভোটার হয়েছেন, তাঁদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে৷ কারণ, তরুণ ভেটাররাই এবার নির্বাচনে নিয়ামক ভূমিকা পালন করবেন৷ তাঁরা যেদিকে যাবেন, ভোটের ফল সেদিকেই যাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা৷ সাবাই তাই চাইছেন তারুণ্যের প্রথম ভোট যেন তাদের পক্ষে আসে৷

চলতি বছরেই তরুণরা বড় দু’টি সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন৷ আন্দোলন গড়ে তুলেছেন৷ কোটা সংস্কার আন্দোলন যেমন জনসমর্থন পেয়েছে, তেমনি নিরাপদ সড়ক আন্দোলন দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে৷ দু’টি আন্দোলনের প্রতিই সব শ্রেণির মানুষ সমর্থন দিয়েছে৷ সমর্থন দিয়েছে এই কারণে যে, তারা ব্যক্তিগত নয়, সবার স্বার্থে মাঠে নেমেছিলেন৷ এর আগে ঢাকা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চও ছিল তারুণ্যের সৃষ্টি৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগ আন্দোলনও দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে৷ কিন্তু এই তরুণরা সব সময় যে ভালো থেকেছেন তা নয়, তাঁরা সামাজিক আন্দোলন করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷ জেলে গিয়েছেন৷ তারুণ্য অপমানিত হয়েছে৷ তারুণ্যের অবমাননা আর দেখতে চায় না এই প্রজন্ম৷ তারা চায়, তরুণবান্ধব এক দেশ, তারুণ্যবান্ধব সরকার ও রাজনীতি৷

৩১ জানুয়ারি সর্বশেষ ভোটার তালিকা প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন৷ আর তাতে মোট ভোটার ১০ কোটি ৪১ লাখ ৪২ হাজার ৩৮১ জন৷ তাতে নতুন ভোটার যোগ হয়েছে ৪৩ লাখ ২০ হাজার৷ তবে নবম সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা করার পর থেকে ১০ বছরে দেশে তরুণ ভোটার বেড়েছে দুই কোটি ২৫ লাখের মতো৷ তাঁদের অধিকাংশের বয়স এখন ১৮ থেকে ২৮ বছর৷ তাঁদের মধ্যে ১ কোটি ২১ লাখ ৩৪ হাজারেরও বেশি ভোটার এবারই প্রথম জাতীয় নির্বাচনে ভোটাধিকার পেয়েছেন৷

আর বাংলাদেশের মোট জনসংখার ৬৮ শতাংশ মানুষের বয়স ১৫ থেকে ৫৯-এর মধ্যে৷ জনমিতির পরিভাষায়, এরা হলেন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট জনগোষ্ঠী৷ তার মানে হলো, বাংলাদেশে এখন নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর চেয়ে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বেশি৷ এটা জনসংখ্যার সুসময়ের কাল৷

এই ডেমেগ্রাফিক ডিভিডেন্টকে ব্যবহারের মধ্যে বাংলাদেশের সমৃদ্ধি ও উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন নির্ভর করে৷ আর তা ব্যবহারের মানে হলো কর্মক্ষম জনগোষ্ঠিকে দক্ষ করে তুলে কাজে লাগাতে হবে৷ তার জন্য দরকার শিক্ষা সংস্কার এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মস্থান৷

সরকারি হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিবছর নতুন করে ২২ লাখ কর্মক্ষম লোক চাকরি বা কাজের বাজারে প্রবেশ করে৷ কিন্তু কাজ পায় মাত্র সাত লাখ কর্মক্ষম মানুষ৷ দুই তৃতীয়াংশ কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ পায় না৷ আর সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, এ বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই বেশি৷

তরুণ ভোটার সাইফুল বাতেন টিটো বলেন, ‘‘সবাই তরুণ ভোটারদের কথা বললেও নির্বাচনের আগে কোনো রাজনৈতিক দল তরুণদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি বা পরিকল্পনার কথা বলছে না৷ সবাই সাধারণ ও গতানুগতিকভাবে কর্মসংস্থান, শিক্ষার উন্নয়নের কথা বলছে৷ বলছে, আত্মকর্মসংস্থানের কথা৷ কিন্তু সেটা কিভাবে হবে, তা আমরা জানতে পারছি না৷ চটকদার স্লোগান আছে৷ যেমন, আওয়ামী লীগ বলছে, তারুণ্যের প্রথম ভোট নৌকায় হোক, তারুণ্যের প্রথম ভোট মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে হোক৷ বিএনপি হয়ত তরুণদের জন্য আরেকটি স্লোগান দেবে৷ কিন্তু সেটা আমার কাছে কার্যকর কিছু মনে হয় না৷”

টিটো বলেন, ‘‘একজন তরুণ ভোটার হিসেবে আমি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থারআমূল পরিবর্তন চাই৷ চাই নকল ও প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ হোক৷ আমি চাই কাজের নিশ্চয়তা৷ কথা বলার স্বাধীনতা চাই৷ তরুণরা নানা অনিয়য়ম-অব্যবস্থা নিয়ে আন্দোলন করেছে৷ তারা হয়রানি ও গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছে৷ এটা যেন আর না হয়৷”

তবে রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, তরুণদের জন্য তাদের অনেক পরিকল্পনা আছে, নির্বাচনি ইশতাহারেও তা থাকছে৷ তরুণদের প্রাধান্য দিয়েই তারা তাদের বড় বড় পরিকল্পনা করছেন৷ শিক্ষার উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, আত্মকর্মসংস্থান আর সৃজনশীল কাজের জন্য সহায়ক নানা প্রকল্প নেবেন তারা৷ প্রধানমন্ত্রী তাঁর ‘লেটস টক উইথ শেখ হাসিনা’ অনুষ্ঠানে বলেন, ‘‘আমরা যা করছি, তা তরুণদের জন্যই করছি, কারণ তারাই দেশের ভাবিষ্যৎ৷ তারা শুধু চাকরি করবে না, চাকরি দেবে৷”

ওই অনুষ্ঠানেই কয়েক তরুণ নিজে প্রধানমন্ত্রী হলে কী করবেন– এমন প্রশ্নের জবাবে, ‘‘প্রধানত শিক্ষার উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, আত্মকর্মসংস্থান ও মানসিক চাপ মুক্তির কথা বলেছেন৷”

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের ইশতাহারে এবার প্রচলিত প্রকল্পগুলোর সঙ্গে তরুণদের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে দু’টি প্রকল্প থাকছে৷ তার মধ্যে শিক্ষিত বেকারদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উপযুক্ত কর্মসস্থানের একটি প্রকল্প এবং যাঁরা স্বল্পশিক্ষিত বেকার, তাঁদেরও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে লোন দিয়ে প্রধানত আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার ব্যাপারটিও রয়েছে৷

আওয়ামী লীগের ইশতাহার প্রনয়ন কমিটির সদস্য ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, ‘‘আমাদের ইশতেহারে তরুণদের জন্য চমক থাকছে৷ তবে তা এখন প্রকাশ করা যাচ্ছে না৷ প্রধানমন্ত্রী যখন ইশতাহার প্রকাশ করবেন, তখনই কেবল জানা যাবে৷ তবে আমি কিছু ইঙ্গিত দিতে পারি৷ তথ্য প্রযুক্তির অগ্রগতি প্রমাণ করে, বাংলাঅদেশের তরুণরা মেধাবী৷ একটি পরিবারের একটি তরুণ চাকরি পেলে একটি পরিবারের লাভ হয়৷ কিন্তু একজন তরুণ উদ্যোক্তা হলে অনেক পরিবারের লাভ হয়, অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়৷ আমাদের এখন যে উন্নয়নের ধারা, সেটা আরো গতি পাবে৷ আর সেটা হবে তরুণদেরকে কেন্দ্র করে৷ আমরা উদ্যোক্তায় পরিণত হতে চাই৷ তরুণদের নিয়ে সেই পরিকল্পনাই নিয়ে আসা হচ্ছে৷”

বিএনপিও ইশতাহারে তরুণদের গুরুত্ব দিচ্ছে৷ তারাও তরুণদের আকৃষ্ট করতে নানা কৌশল নিচ্ছে৷ আর তাদের এই কৌশলে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে কোটা সংস্কার এবং নিরপাদ সড়ক চাই আন্দোলনের ইস্যুগুলোকে৷ বিএনপি’র প্রাধান্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দাবিগুলোর মধ্যে এই দু’টি ঘটনায় যাঁরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, আটক হয়েছে, তাঁদের মুক্তি এবং ক্ষতিপূরণের কথা বলা হয়েছে৷ বলা হয়েছে, তাঁদের দাবিগুলো বাস্তবায়নের কথা৷ বিএনপির ইশতাহার প্রনয়ন কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘চাকরিতে কোটা মেধা বিকাশের পথে অন্তরায়৷ আমরা তাই দু-একটি ক্ষেত্র ছাড়া আর সব ক্ষেত্রে কোটা রাখার বিরুদ্ধে ছিলাম৷ তরুণরাও তাই চেয়েছে৷”

তিনি বলেন, ‘‘তরুণরা যেন অপমানের শিকার না হয়, তাঁরা যাতে নিগ্রহের শিকার না হয় আমাদের নজর সেদিকেই৷ তাঁরাই সমাজ পরিবর্তন করে৷ আর এটা করতে গিয়ে তাঁরা যেন বাধার মুখে না পড়ে আমরা সেই পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছি৷ তরুণদের সম্মান করতে হবে৷ আমরা তাঁদের সম্মান করতে চাই৷”

তিনি বলেন, ‘‘ইশতাহারে আমরা তরুণদের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার কথা বলছি৷ তাঁদের শিক্ষার জন্য ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তাঁদের শিক্ষার খরচ কমানো, সৃজনশীল কাজ ও উচ্চশিক্ষায় সহায়তার প্রকল্প থাকছে৷ আর তাঁদের কর্মসংস্থানই শুধু নয় , তাঁরা যাতে নিজেরা উদ্যোক্তা হতে পারে, আত্ম কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে, সেজন্য বিশেষ প্রকল্প থাকবে৷ তরুণদের গবেষণা এবং সৃজনশীল কাজে আমরা অর্থসহ নানাভাবে সহায়তা করব, প্রয়োজন অনুযায়ী উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে পাঠাবো৷”

আওয়ামী লীগের এবার নির্বাচনি প্রচারের মূল সুর উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা৷ আর বিএনপি’র গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা৷ আওয়ামীলীগ উন্নয়নের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রাধান্য দিচ্ছে৷ বিএনপি বলছে, গণতান্ত্রিক চেতনার কথা৷ আর এর মধ্যে তরুণদের আকৃষ্ট করার উপাদান আছে বলে উভয় দলই মনে করে৷

এসএইচ-০৯/১৭/১২ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)