রাজশাহীর ছয়টি আসনে চলছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জোর প্রচারনা। পাখি ডাকা ভোর থেকে রাত অবধি এলাকার এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ছুটে চলেছেন প্রার্থী ও সমর্থকরা। নিজের প্রতীকে সিলের আহ্বান করছেন ভোটারদের কাছে। এ সময় প্রার্থীরা যেমন তাদের চাহিদার কথা বলছেন, তেমনি প্রার্থীরা দিচ্ছেন প্রতিশ্রুতি। দুই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া জেলায় নির্বাচনি পরিবেশ এখন পর্যন্ত সুষ্ঠু ও সুন্দর রয়েছে। ভোটের মাঠে মূল লড়াইটা বিএনপি ও আওয়ামী লীগের হলেও ২৫ প্রার্থীর ভাগ্য ঝুলছে ১৯ লাখ ভোটারের হাতে।
রাজশাহী ছয়টি আসনে ভোটারদের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে কর্মসংস্থানের। এলাকার বন্ধ হয়ে থাকা শিল্পকারখানাগুলো নতুন করে চালু করার। কৃষকের উৎপাদিত ফসলের নায্য মূল্য পাবার নিশ্চয়তা। শুধু জঙ্গিবাদ আর যুদ্ধাপরাধিদের বিষয়ে মুখে ফুলঝুরি চান না। সাথে সর্বহারা ও চরমপন্থিদের চাঁদাদাবি বন্ধের দাবিতেও সোচ্চার ভুক্তভোগি এলাকার মানুষ। রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকায় মাদ্রকের সম্রাাজ্য গড়ে উঠেছে তা বন্ধেরও দাবি উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে। কিন্ত এ সব বিষয়ে সহসায় কোন প্রার্থী মুখ খলছেন না বলেও বলছেন ভোটাররা।
এলাকার ভোটাররা বলছেন বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে রাজশাহীতে কর্মসংস্থানের জন্য শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে। বাস্তবে হয়নি। রাজশাহীতে কৃষিভিত্তিক ইপিজেড গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে সেই ২০০২ সাল থেকেই। এত দিনেও তা অন্ধকারেই রয়েছে। তারা দাবি করছেন এই সকল বিষয় প্রার্থীরা নজরে নিয়ে আসুক এবং তা বাস্তবায়নের ব্যাপারে অঙ্গিকার করতে হবে।
ভোটের ক্ষেত্রে সকল প্রার্থীদের বিভিন্ন বিষয় খতিয়ে দেখছে। মার্কার ভোট হলেও প্রতিদ্বন্দ্বি মুল দুই দলের দীর্ঘকালের আমলনামাও বিশ্লেষন করছেন এলাকার জনগন। কেবল এলাকার বা দেশের সার্বিক উন্নয়ন নয় বিবেচনায় নিচ্ছেন গুম, খুন, নানাভাবে পুলিশি হয়রানি, স্থানীয় নেতাদের ওদ্ধৌত্বপূর্ণ আচরণ, প্রার্থীদের সাথে জনগনের সম্পৃক্ততার বিষয়গুলো উঠে আসছে ভোটারদের মুখে।
নির্বাচনে পবা-মোহনপুর ও পুঠিয়া-দূর্গাপুর আসনে খুব শক্তিশালী লড়াই না হলেও বাকি আসনগুলোতে লড়াইটা হবে জমজমাট। কারণ হিসেবে ভোটাররা বলছেন বিএনপি-আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
জেলা নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীর ছয়টি আসনে এবার মোট ভোটার ১৯ লাখ ৪২ হাজার ৫৬২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৯ লাখ ৬৭ হাজার ৭১০ জন এবং নারী ৯ লাখ ৭৪ হাজার ৮৫২ জন। রাজশাহীতে সাত জন প্রার্থী তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ২৫ জন প্রার্থী।
এবারের নির্বাচনে রাজশাহীর-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের বিএনপি প্রার্থী শফিকুল হক মিলন ও ৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনের বিএনপি প্রার্থী আবু সাঈদ চাঁদ এবং রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনে আওয়ামী লীগের ডা. মনসুর রহমান ছাড়া ভোটের মাঠে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বাকিরা হেভিওয়েট প্রার্থী। রাজশাহী সদর আসনের বিএনপি প্রার্থী মিজানুর রহমান মিনু এবং পবা-মোহনপুরের আওয়ামী লীগ প্রার্থী আয়েন উদ্দিন জয় পেয়েছিলেন।
রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনে আওয়ামী লীগের ওমর ফারুক চৌধুরী, বিএনপির সাবেক ও ডাক টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হক, ইসলামী আন্দোলনের আব্দুল মান্নান ও বাসদের আফজাল হোসেন।
গোদাগাড়ীর রাজাবাড়ী এলাকার ব্যবসায়ী সাদেকুল ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সরকারের আমলে এলাকার উন্নয়ন হয়েছে। তবে প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের ওমর ফারুক চৌধুরী ও বিএনপির ব্যারিস্টার আমিনুল হকের মধ্যে একটা পার্থক্য রয়েছে। ব্যারিস্টার আমিনুল হক সর্বস্তরের মানুষের সাথে কথা বললেও আওয়ামী লীগের ফারুক চৌধুরী দলের বাইরে তেমনটি নয়। এখন যেভাবে ভোটরদের সাথে সাধারণ মানুষের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন গেলো দশ বছরে তেমন দেখা যায়নি।
তানোরের কালিগঞ্জের অব্দুল আলীম বলেন, গেলো দশবছরে দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে। কিন্ত কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের নায্যমূল্য পায়নি। এমনকি ফসল কাটার শ্রমিক সঙ্কটের মুখে পড়তে হয়েছে প্রতিবছর। ফলে উৎপাদন খরচও উঠছেনা। এই সব বিষয়ে আমরা নিশ্চয়তা চায় প্রার্থীদের নিকট। এলাকার বহু রাস্তা এখন চলাচলের অনুপযোগি হয়ে পড়েছে। যার কোন উন্নয়ন হয়নি। এসবের বাস্তবায়ন চান তারা।
রাজশাহী-২ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের ফজলে হোসেন বাদশা, বিএনপির সাবেক মেয়র ও এমপি মিজানুর রহমান মিনু, ইসলামী আন্দোলনের ফয়সাল হোসেন ও সিপিবির এনামুল হক।
রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনে আওয়ামী লীগের আয়েন উদ্দিন, বিএনপির শফিকুল হক মিলন, ইসলামী আন্দোলনের ফজলুর রহমান, যুক্তফ্রন্টের মনিরুজ্জামান ও সাম্যবাদী দলের সাজ্জাদ আলী। এই আসনে বিএনপি প্রার্থী মিলন এই প্রথমবার সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী হয়েছেন।
পবার মুরারিপুর এলাকার সেলিম হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন থেকে রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকায় মাদকব্যবসা জমজমাট। প্রতিদিন কমবেশী বিজিবি ও পুলিশ তল্লাশি চালায়। আটকও হয় অনেকে। কিন্ত তা বন্ধ হচ্ছে না একেবারই। এ পরিস্থিতির উন্নতি চান তিনি।
রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনে আওয়ামী লীগের প্রকৌশলী এনামুল হক, বিএনপির সাবেক এমপি আবু হেনা ও ইসলামী আন্দোলনের তাজুল ইসলাম খান।
বাগমারার ভবানিগঞ্জ এলাকার বজলুর রশীদ বলেন, এই এলাকা সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে অনেক আগে থেকে চিহ্নিত। একটা সময় সর্বহারা ও চরমপন্থিদের আখড়া হিসেবে বিবেচিত হত। পরে জঙ্গি সংগঠনের উত্থান হয়। এখনও মাঝে মধ্যে পুলিশের হাতে জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সদস্যরা ধরা পড়লেও সর্বহারা বা চরমপন্থি সদস্যরা থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। প্রার্থীরদের কাছে এই সকল বিষয় তুলে ধরা হচ্ছে।
রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনে আওয়ামী লীগের ডা. মনসুর রহমান, বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাদিম মোস্তফা, জাতীয় পার্টির আবুল হোসেন, ইসলামী আন্দোলনের রুহুল আমিন ও জাকের পার্টির শফিকুল ইসলাম। মুল প্রতিদ্বন্দ্বির দুই দলের প্রার্থীর মধ্যে আওয়ামী লীগের ডা. মনসুর রহমান এবার প্রথম সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
রাজশাহী-৬ (চারঘাট-বাঘা) আসনে আওয়ামী লীগের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, বিএনপির আবু সাঈদ চাঁদ, ইসলামী আন্দোলনের আব্দুস সালাম সবুজ ও জাতীয় পার্টির ইকবাল হোসেন। বিএনপি প্রার্থী চাঁদ প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মত ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন। তিনি উপজেলা ভোটে পরপর দুবার চারঘাটের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। সংসদ নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তবে আবু সাঈদ চাঁদ কারাগারে থাকার কারনে নির্বাচনী প্রচারনায় অংশ নিতে পারছেন না। তার ছেলেসহ দলের সমর্থক কর্মীরা প্রাচরনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
চারঘাটের ইউসুফপুর এলাকার অনিল কুমার বলেন, এলাকায় নির্বাচনের সুষ্ঠু পুরিবেশ রয়েছে এখন পর্যন্ত। প্রার্থীরা বিভিন্ন ধরনের প্রতিশ্রতি দিচ্ছেন। আগামীতে আরো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারিকরন করা, রাস্তা ঘাট নির্মানসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ করা হবে বলে প্রার্থীরা বলছেন।
এসএইচ-১০/১৭/১২ (সুমন হাসান)