সহিংসতা-বর্জন-অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ ভোটগ্রহণ শেষ, চলছে গণণা

দেশের বিভিন্ন জেলায় সহিংসতা, প্রার্থীদের ভোট বর্জন, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মধ্যদিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। রোববার সকাল ৮টায় বিরতিহীনভাবে শুরু হওয়া ভোট শেষ হয় বিকেল ৪টায়। এখন চলছে ভোট গণণা।

রোববার নির্বাচন চলাকালে বিভিন্ন জেলায় সহিংসতায় এ পর্যন্ত ১৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া ভোট কারচুপি, অনিয়ম, পোলিং এজেন্টদের মারধর, ভোটারদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগে নির্বাচন শেষ হওয়ার কয়েকঘণ্টা আগে ১৭ প্রার্থী ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।

যদিও নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন নির্বাচনকালীন সরকার। তবে ভোটের পরিবেশে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপি। এছাড়া দলীয় মনোনয়ন না পাওয়া বেশ কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীও অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে।

ভোট গ্রহণের শুরুতে ঢাকা সিটি কলেজে ভোট দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভোট দেওয়া শেষে নৌকা প্রতীকের জয়ের ব্যাপারে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মানুষ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভোট দেবে। সাধারণ মানুষ নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আমাদের জয়যুক্ত করবে। নৌকার জয় সুনিশ্চিত।’

এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও বোন শেখ রেহানা। ভোট দেওয়া শেষে উন্নত বাংলাদেশের প্রত্যাশা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জনগণ যে রায় দেবে তা আমরা মাথা পেতে নেব। নৌকার জয় হবেই হবে। নৌকার জয় হলে, বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে এবং এগিয়ে যাবে। আমরা বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ থেকে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। সেটা বাস্তবায়ন করতে হলে নৌকাকে জয়যুক্ত করতে হবে।’

এদিকে আওয়ামী লীগের প্রধান বিরোধী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন ভোটের সার্বিক পরিবেশে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর এই দৃশ্য দেখতে হলো। আজ জনগণের ভোটাধিকার নেই। অথচ এই রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। জনগণকে ঝড়, তুফান পেরিয়ে তার মালিকানার প্রমাণ দিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। লাঠিয়াল বাহিনী, পুলিশ বাহিনী দেশের মালিকানায় আঘাত করেছে।’

তবে নির্বাচন আয়োজনকারী সাংবিধানিক সংস্থা নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, নির্বাচন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে।

সশস্ত্র বাহিনী
সংস্থাটির প্রধান কে এম নুরুল হুদা বলেছেন, ‘চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর মতো দুই এক জায়গায় বিচ্ছিন্ন ঘটনার কথা শুনেছি। ঢাকায় বসে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া আছে। তারপরেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করে দেওয়া হবে।’

বেশিরভাগ কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্ট নেই সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, এজেন্ট যদি না আসে সে বিষয়ে আমরা কিছু করতে পারবো না। এজেন্ট যদি না আসে সে ক্ষেত্রে আমরা কী করতে পারি? পাল্টা প্রশ্ন রাখেন তিনি।

অনেক নির্বাচনি কেন্দ্রে ভোট বুথের পর্দা সরিয়ে ভোট দেওয়া হচ্ছে এমন অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, ‘এরকম কোনো ঘটনাই ঘটেনি। ঢাকা শহরের প্রতিটি কেন্দ্রেই ভোট সুষ্ঠু হচ্ছে। ঢাকায় কোনো বিশৃঙ্খলা ঘটেনি।’

যেমন ছিল প্রস্তুতি

ভোট উপলক্ষে আগেই সব প্রস্তুতি শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রতিটি জেলার কেন্দ্রে কেন্দ্রে পৌঁছে যায় নির্বাচনি সামগ্রী। নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়। কেন্দ্র ও কেন্দ্রের আশেপাশে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশের উপস্থিতি ছিল। ভোট উপলক্ষে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বিভিন্ন কেন্দ্রে আসতে শুরু করেন ভোটাররা। কেন্দ্রগুলোয় ভোটারদের ছোট ছোট লাইন দেখা যায়। তবে শীতের সকাল হওয়ায় ভোটারদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটারদের উপস্থিতি বাড়তে থাকে।

এবারের নির্বাচনটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রথম নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে দলীয় সরকারের অধীনে। এছাড়া এই নির্বাচন পুরোপুরি অংশগ্রহণমূলক। ফলে ব্যালট-বাক্সের মাধ্যমে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হয় রাজনৈতিক দলগুলোকে।

যা বলল পুলিশ-র‌্যাব: বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী।

তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো কেন্দ্র থেকে পোলিং এজেন্ট বের করে দেওয়ার মতো অভিযোগ পায়নি পুলিশ। কেন্দ্রে পোলিং এজেন্টদের নিরাপত্তার দায়িত্ব পুলিশের।

আইজিপি বলেন, বিচ্ছিন্নভাবে চট্টগ্রামে একটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, ময়মনসিংহে একটি কেন্দ্রে হামলায় পুলিশ আহত হয়েছে ও পুলিশের দুটি অস্ত্র লুট হয়েছে, ভৈরবে হামলা হয়েছে, নোয়াখালীর দুটি কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা হয়েছে, একটি কেন্দ্রে ব্যালট পেপার লুট হয়েছে। এ ঘটনাগুলো ছাড়া নির্বাচন শান্তিপূর্ণ উৎসবমুখর পরিবেশে হচ্ছে।

এদিকে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিস্থিতি খুব ভালো, কোথাও কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

মহাপরিচালক বলেন, ‘দেশবাসী শান্তিপূর্ণভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করছে। অতীতের নির্বাচনগুলোর চেয়ে অনেক ভালো নির্বাচন হচ্ছে। ভোটকেন্দ্রে ঢলে ঢলে মানুষ যাচ্ছে। পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে তারা নিরাপদে বাড়ি ফিরছে।’

সন্তুষ্ট আওয়ামী লীগ: দু-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া প্রতিটি কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হয়েছে বলে দাবি করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

তিনি বলেন, ‘জনগণ যে রায় দেবেন, তা তিনি মেনে নেবেন।’

ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোটের বিজয়ের ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী।’

এটা একটা সহিংস নির্বাচন। মানুষ যাচ্ছে কিন্তু ভোট দিতে পারছে না।’

যা বলল বিএনপি: বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, বিভিন্ন আসনের কেন্দ্রে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা সন্ত্রাস করছে। এখন পুলিশ, র্যাব, বিজিবি একসঙ্গে এই তাণ্ডবটা করছে। কোনো কোনো জায়গায় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা নেই। তারা গিয়ে ভোটারদের বলছে, ভোট কেন্দ্রে যাওয়া যাবে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধানরা বলেছেন শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হবে। এই হচ্ছে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের নমুনা।’

ভোট বর্জন
১৭ প্রার্থীর ভোট বর্জন: ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ১৭ জন প্রার্থী নির্বাচন বর্জন করেছেন। ভোট শুরু হওয়ার আড়াই ঘণ্টা পর প্রথম ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া খুলনা-৫ আসনে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মিয়া গোলাম পরওয়ার। ওই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ।

একই সময়ে ফরিদপুর-২ (নগরকান্দা-শালথা) আসনে বিএনপির প্রার্থী শামা ওবায়েদ ইসলাম নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেন, ওই আসনের ১২৩টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ১০০টি কেন্দ্রে গতকাল শনিবার রাতেই ভোট দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আজ সকালে যেসব কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ শুরু হয়েছে, সেসব কেন্দ্রে বিএনপির কোনো পোলিং এজেন্টকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এর প্রতিবাদে নিজেও ভোট দেননি শামা ওবায়েদ ইসলাম। ওই আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী।

ঢাকা-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সালমা ইসলাম ভোট জালিয়াতির অভিযোগে নির্বাচন বর্জন করেছেন। আজ দুপুর ১২টায় নবাবগঞ্জ উপজেলার কামারখোলায় নিজ বাসভবনে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তিনি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। ঢাকা-১ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী রয়েছেন সালমান এফ রহমান।

ঢাকা-১৭ আসনে নির্বাচন বর্জন করেছেন বিজেপি প্রার্থী আন্দালিভ রহমান পার্থ। এই আসনে পার্থের প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের প্রার্থী চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান ফারুক।

ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া বাগেরহাট-৩ আসনে জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির মোহাম্মদ আবদুল ওয়াদুদ ও বাগেরহাট-৪ আসনে জেলা জামায়াতের শুরা সদস্য মো. আবদুল আলীম বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে ভোট বর্জন করেন। বাগেরহাট-৩ আসনে খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের স্ত্রী হাবিবুন নাহার আওয়ামী লীগের প্রার্থী। আর বাগেরহাট-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন।

দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে খুলনা-১ আসনের বিএনপির প্রার্থী আমির এজাজ খান, খুলনা-৩ আসনে রকিবুল ইসলাম বকুল, খুলনা-৪ আসনের আজিজুল বারী হেলাল ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁরা তিনজনই বিএনপির প্রার্থী। খুলনা-১ আসনে বিএনপির পর জাতীয় পার্টির প্রার্থী সুনীল শুভ রায় নির্বাচন বর্জন করেছেন। খুলনা-৬ আসনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া জামায়াতের খুলনা মহানগর আমির আবুল কালাম আজাদ ভোট বর্জন করেন। গাইবান্ধা-১ আসনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মো. মাজেদুর রহমান ভোট বর্জন করেছেন। ওই আসনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছেন জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারী। গাইবান্ধা-৪ আসনে জাতীয় পার্টির কাজী মশিউর রহমান ভোট বর্জন করেছেন। এ আসনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন আওয়ামী লীগের মনোয়ার হোসেন চৌধুরী। সাতক্ষীরা-২ আসনে মুহাম্মদ আবদুল খালেক ও সাতক্ষীরা-৪ আসনে জি এম নজরুল ইসলাম নির্বাচন বর্জন করেছেন। তারা দুজনেই জামায়াত নেতা।

বরিশাল-৪ আসনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া নাগরিক ঐক্যের জে এম নুরুর রহমান জাহাঙ্গীর ভোট বর্জন করেন। তিনি অভিযোগ করেন, নিজ কেন্দ্রে বাধার মুখে ভোট দিতে পারেননি। দিনাজপুর-৬ আসনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া জেলা জামায়াতের আমির মো. আনোয়ারুল ইসলাম ভোট বর্জন করেছেন। শরীয়তপুর-২ আসনে বিএনপির সফিকুর রহমান কিরণ ভোট বর্জন করেছেন।

প্রাণ গেছে ১৫ জনের: নির্বাচনি সহিংসতায় সারাদেশে অন্তত ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই আওয়ামী লীগ-যুবলীগ নেতাকর্মী। রোববার বিকেল পর্যন্ত এসব ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে রোববার সকাল ৮টায় ভোটগ্রহণ শুরুর কিছু পরেই রাঙ্গামাটি কাউখালী উপজেলার ঘাগড়ায় আওয়ামী লীগ-বিএনপির সংঘর্ষে বাছির উদ্দীন নামে এক যুবলীগ নেতার মৃত্যু হয়েছে। সকালে ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার আগে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। রাজশাহীতে বিএনপি সমর্থকদের লাঠির আঘাতে আওয়ামী লীগ কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। নাটোরে বিএনপি নেতাকর্মীদের হামলা ও ছুরিকাঘাতে এক আওয়ামী লীগ কর্মী নিহত হয়েছে।

এদিকে কুমিল্লায় নির্বাচনী সহিংসতায় তিনজন নিহত হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের রাজঘর প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে গুলিতে নিহত হয়েছে এক আওয়ামী লীগ কর্মী, আহত হয়েছে দুইজন। কক্সবাজারের পেকুয়া ও চট্টগ্রামের পটিয়ায় আওয়ামী লীগ-বিএনপি’র সংঘর্ষে দুইজন নিহত হয়েছে।

এছাড়া টাঙ্গাইলে এক ওয়ার্ড বিএনপি সভাপতির লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। বগুড়ার কাহালুতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি’র সংঘর্ষে নিহত হয়েছে একজন। নরসিংদীর শিবপুরে একজনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা এবং বিএনপির নেতাকর্মীদের হাতে বগুড়ায় মৃত্যু হয়েছে আরও একজনের।

রোববার দুপুরে ভোট দেওয়া শেষে বগুড়ার বাঘুইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের কাছে একটি চায়ের দোকানে বসে গল্প গুজব করছিলেন স্থানীয় ইউপি সদস্য সোহেলসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এসময় লাঠিসোটাসহ ‍দুই তিনশ বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মী ওই কেন্দ্রে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তাদের বাধা দেন সোহেল। এতে তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে হামলা চালায় বিএনপি-জামায়াত সদস্যরা। এ সময় ওই পথ দিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছিলেন স্থানীয় আজিজুল। তার ওপরেও হামলা করা হয়। এতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার।

সকালে রাজশাহীতে ভোট দেওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের সংঘর্ষে মেরাজুল ইসলাম নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। রাজশাহী-৩ আসনের মোহনপুরের পাকুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে এই ঘটনা ঘটে। এছাড়া রাজশাহীর তানোরে একজন মারা গেছেন।

রাঙ্গামাটির কাউখালী উপজেলার ঘাগড়ায় আওয়ামী লীগ-বিএনপির সংঘর্ষে বাছির উদ্দীন (৩৫) নামে এক যুবলীগ নেতার মৃত্যু হয়েছে। সকালে ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার আগে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। নিহত বাছির উদ্দীন ঘাগড়া ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক বলে নিশ্চিত করেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এরশাদ মিয়া।

চট্টগ্রামের পটিয়া ও বাঁশখালী উপজেলায় দুটি পৃথক নির্বাচনি সংঘাতের ঘটনায় এক কিশোরসহ দুজনের মৃত্যু হয়েছে।

পটিয়া উপজেলার জিরি ইউনিয়নের পশ্চিম মালিয়ারা ভোটকেন্দ্রে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নৌকা এবং ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। এসময় দুই পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে আবু সাদেক (১৫) নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়। তবে সে রাজনৈতিক কর্মী নয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। এর আগে শনিবার রাত আড়াইটার দিকে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় ভোটকেন্দ্র দখল নিয়ে ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। গুলিতে একজন নিহত হয়েছেন। নিহত আহমদ কবির (৪৫) কাথারিয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা বলে জানিয়েছে পুলিশ।

কুমিল্লায় নির্বাচনি সহিংসতায় তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সকাল ১০টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টার মধ্যে চান্দিনা, নাঙ্গলকোট ও দাউদকান্দিতে এসব ঘটনা ঘটে। এদের মধ্যে একজন বিএনপি কর্মী বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ।

কক্সবাজারের পেকুয়ায় বিএনপি সমর্থকরা কুপিয়ে হত্যা করেছে আব্দুল্লাহ আল ফারুক নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মীকে। বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে উপজেলার রাজাখালী ইউনিয়নের মাতব্বর পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রের পাশে এ হামলার ঘটনা ঘটে।

পর্যবেক্ষকদের চোখে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন: ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নিরাপত্তাসহ ভোটের সার্বিক পরিস্থিতি সন্তোষজনক।’ ভোট পর্যবেক্ষণে আসা বিদেশি পর্যবেক্ষকরা রোববার দুপুরে ঢাকার রেসিডেন্সিয়াল মডেল হাই স্কুলে সঙ্গে আলাপকালে এমন মন্তব্য করেন।

নির্বাচন কমিশন (ইসি) এর আমন্ত্রণে এবারের ভোট পর্যবেক্ষণ করতে ১৫০ জন বিদেশি পর্যবেক্ষক এবং ৬৫ জন বিদেশি সাংবাদিক এসেছেন। এর বাইরে ২৫ হাজার ৯০০ জন স্থানীয় পর্যবেক্ষক ভোট পর্যবেক্ষণ করবেন।

ভারত থেকে আসা কমল ভট্টাচার্য সারাবাংলা’কে বলেন, ‘আমি এখন পর্যন্ত ৫টি ভোট কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেছি। সার্বিক পরিস্থিতি দেখে খুবই ভালো লেগেছে। শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হচ্ছে। বেশি ভালো লেগেছে মহিলাদের অবাধভাবে ভোট কেন্দ্রে আসার দৃশ্য দেখে।’

নেপালের মো. আলী বলেন, ‘নিরাপত্তার বিষয় দেখে ভালো লেগেছে, কোনো ঘাটতি নেই। সহিংসতার কোনো ঘটনা দেখিনি।’

শ্রীলঙ্কার মো. এহসান বাদল বলেন, ‘আমি ৪ টি কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেছি। শান্তিপূর্ণ এবং আনন্দঘন পরিবেশে ভোট হচ্ছে।’

কানাডার টেরিডন ফসটার বলেন, ‘আমি ৫টি কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেছি। খুবই ভালো ভোট হচ্ছে। কানাডার ভোটের সঙ্গে বাংলাদেশের ভোটের বেসিক কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য বলতে কানাডায় নারী-পুরুষ একসঙ্গে ভোট দিতে ঢোকে, আলাদা লাইন ধরতে হয় না।’

নির্বাচনে প্রার্থীর সংখ্যা

এবার ৩০০ আসনের পরিবর্তে ২৯৯টি আসনে এবার ভোটগ্রহণ চলে। গাইবান্ধা-৩ আসনে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীর মৃত্যুজনিত কারণে ভোটগ্রহণ পিছিয়ে ২৭ জানুয়ারি নির্ধারণ করা হয়েছে। ২৯৯ আসনে ১ হাজার ৮৬১ জন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এরমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে ১ হাজার ৭৩৩ জন এবং অবশিষ্ট ১২৮ জন স্বতন্ত্র হিসেবে অংশ নিচ্ছেন।

মোট ভোটার, কেন্দ্র ও ভোট কক্ষের সংখ্যা

একাদশ সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৭৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৫ কোটি ২৫ লাখ ৭২ হাজার ৩৬৫ জন, মহিলা ভোটার ৫ কোটি ১৬ লাখ ৬৬ হাজার ৩১২ জন। এর মধ্যে নতুন প্রায় ১ কোটি ২৩ লাখ ভোটার প্রথমবারের মতো জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেবেন। নির্বাচনে মোট ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৪০ হাজার ১৮৩ টি এবং ভোট কক্ষের সংখ্যা ২ লাখ ৭ হাজার হাজার ৩১২ টি।

৬টি সংসদীয় আসনে ইভিএমে ভোট

প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৬টি সংসদীয় আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহার করে ভোট গ্রহণ করা হচ্ছে। আসন ছয়টি হলো : ঢাকা-৬, ঢাকা-১৩, চট্টগ্রাম-৯, রংপুর-৩, খুলনা-২ এবং সাতক্ষীরা-২। এসব আসনে ৪৮ জন প্রার্থী নির্বাচন অংশ নেন। আসনগুলোতে মোট ভোটার ২১ লাখ ২৪ হাজার ৫৪৪ জন। পুরুষ ভোটার ১০ লাখ ৮৫ হাজার ৫২জন, মহিলা ভোটার ১০ লাখ ৩৯ হাজার ৫০২ জন। এসব ভোটার ইলেকট্রোনিক ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে (ইভিএম) ভোট দেন।

নির্বাচনি কর্মকর্তার সংখ্যা

নির্বাচনে ঢাকা ও চট্রগ্রামে দুইজন বিভাগীয় কমিশনারসহ ৬৬ জন রিটানিং করমকর্তা দায়িত্বে ছিলেন। নির্বাচনে এক্সকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ১ হাজার ৩২৮ জন। এর মধ্যে আচরণবিধি প্রতিপালনের জন্য ৬৫২ জন এবং বাকি ৬৭৬ জন থাকবে অইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মোবাইল ও স্টাইকিং ফোর্সের সঙ্গে নিয়োজিত।

এছাড়াও নির্বাচনে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ৬৪০ জন। ইলেকট্রোরাল ইনকোয়ারি কমিটি রয়েছে ১২২টি (২৪৪ জন)। প্রিজাইডিং অফিসার ৪০ হাজার ১৮৩ জন। সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ২ লাখ ৭ হাজার ৩১২ জন। পোলিং অফিসার থাকছে ৪ লাখ ১৪ হাজার ৬২৪ জন।

নির্বাচনে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক

এবারের সংসদ নির্বাচনে ৮১টি দেশি প্রতিষ্ঠানের ২৫ হাজার ৯০০ জন পর্যবেক্ষক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন।

অন্যদিকে বিদেশি ১০২ জন পর্যবেক্ষক নির্বাচন পর্যেবক্ষণ করেন। এর মধ্যে ওআইসি, ফেম্ভোসা, এএইএ এবং কমনওেয়লথ থেকে ৩৮ জন পর্যবেক্ষক নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ছিলেন। বিদেশি কূটনৈতিক ও বিদেশি মিশনের কর্মকর্তা ছিলেন ৬৪ জন। অন্যদিকে, বাংলাদেশ দূতাবাস/হাইকমিশন এবং বিদেশি সংস্থায় কর্মরত আরও ৬১ জন প্রতিনিধি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন। ফলে এবার সংসদ নির্বাচন দেশি-বিদেশি মোট ২৬ হাজার ৬৩ জন পর্যবেক্ষণ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন।

এসএইচ-০৫/৩০/১৮ (অনলাইন ডেস্ক)