সংরক্ষিত নারী আসনের এমপিদের অজানা কথা

জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচনরে জন্য দলীয় মনোনয়ন বিক্রি করা শুরু করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ।

১৭ই জানুয়ারি একাদশ জাতীয় সংসদের ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে জানান নির্বাচন কমিশন সচিব।

সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ নির্বাচিত হন জাতীয় নির্বাচনে ৩০০ আসনে বিজয়ী হয়ে সাংসদ হিসেবে শপথ গ্রহণ করা প্রতিনিধিদের ভোটের মাধ্যমে।

বাংলাদেশের সংসদে, প্রথাগতভাবে, সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ হিসেবে ক্ষমতাসীন দলের মনোনিত প্রার্থীরাই নির্বাচিত হতেন; কখনো কখনো বিরোধী দলের নারী প্রার্থীদের কয়েকটা আসনে।

তবে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী অনুযায়ী, ২০০৪ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদের একাদশ অধিবেশনে নির্ধারণ করা হয় যে সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে (সেসময় ৪৫টি) একটি দল থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যক নারী সাংসদকে সুযোগ দেওয়া হবে; এবং তা হবে সংসদে ঐ দলের কতজন প্রতিনিধি রয়েছে তার অনুপাতে।

অর্থাৎ একটি রাজনৈতিক দলের ৬ জন যদি নির্বাচিত সাংসদ হন, তাহলে ঐ দল থেকে একজন প্রার্থী সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ হবেন।

তখন ঐ সংরক্ষিত আসনের নির্বাচনে ঐ বিশেষ রাজনৈতিক দল থেকে একাধিক নারী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন এবং সেই দলের নির্বাচিত সাংসদদের ভোটে বিজয়ী হয়ে সংরক্ষিত আসনের সাংসদ হতে পারবেন ঐ প্রার্থী।

সেই সমীকরণ অনুযায়ী, একাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি থাকবেন ৪৩ জন, জাতীয় পার্টির ৪ জন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ২ জন এবং স্বতন্ত্র এবং অন্যান্য দলের আরো ১ জন।

কিন্তু যখন সারাদেশের ৩০০টি নির্বাচনী আসন থেকে সাধারণ মানুষের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সংসদে থাকছেন তখন এই সংরক্ষিত নারী আসনের প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্ব আসলে কতটা?

সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদরা খুব একটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয় না।

“রাজনৈতিক বিবেচনায় বা রাজনৈতিক পরিবার থেকেই সাধারণত সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ নির্বাচন করা হয়। কাজেই রাষ্ট্র পরিচালনায় বা সংসদের কার্যক্রমে অবদান রাখতে পারবেন – এরকম বিবেচনায় সাধারণত সংরক্ষিত নারী আসনে সাংসদ নির্বাচন করা হয় না।”

তবে সংরক্ষিত আসনের সাংসদদের কার্যপরিধির ব্যপ্তি বা দায়িত্বের বিষয়ে বাংলাদেশের সংবিধানে আলাদাভাবে উল্লেখ নেই বলে জানান মি. মালিক।

“সংবিধানে শুধু বলা আছে সংরক্ষিত আসন থাকতে হবে, সেটির সংখ্যা বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে সংরক্ষিত আসনের সাংসদদের বিষয়ে আলাদা করে কিছু বলা নেই।”

মালিক বলেন, সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মতোই সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন সংরক্ষিত আসনের সদস্যরা।

তবে দশম জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের সাংসদ সাবিনা আক্তার তুহিন বলেন, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নির্বাচিত সাংসদদের মতো পেলেও সংরক্ষিত আসনে বরাদ্দ কম দেয়া হয়ে থাকে।

সাবেক সাংসদ সাবিনা আক্তার তুহিন বলেন, “সংসদে আইনপ্রণেতা হিসেবে একজন নির্বাচিত এমপি’র সমান অধিকার থাকে একজন সংরক্ষিত আসনের এমপি’র।”

মিজ, তুহিন বলেন সংরক্ষিত আসনের এমপি’কে কয়েকটি এলাকার উন্নয়ন কাজের দায়িত্ব দেন সংসদ নেতা। সাধারণত জেলার ভিত্তিতে এই দায়িত্ব দেয়া হয়ে থাকে।

“একজন সংরক্ষিত আসনের এমপি’কে সর্বোচ্চ দু’টি জেলার দায়িত্ব দেয়া হয়, কাউকে কাউকে একটি জেলারও দায়্ত্বি দেয়া হয়।”

একটি নির্বাচনী আসনে জনগণের ভোটে বিজয়ী এমপি’র পাশাপাশি ঐএলাকার জন্য নির্ধারিত সংরক্ষিত আসনের সাংসদও এলাকার বিভিন্ন ইস্যু সংসদে উপস্থাপন করার অধিকার রাখেন বলে জানান তুহিন।

পুরো বাংলাদেশে নির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমার ভিত্তিতে ভাগ করা ৩০০টি আসনের প্রত্যেকটিতে জনগণের ভোটে নির্বাচিত একজন সাংসদ থাকার পরও সংরক্ষিত আসনের তাৎপর্য কী?

আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ১৯৭২ সালে যখন এই আইনটি তৈরি করা হয় তখনকার প্রেক্ষাপটে তা ছিল যুক্তিসঙ্গত ও সময়োপযোগী।

নারীর ক্ষমতায়ন ও রাষ্ট্র পরিচালনায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সেসময় এই আইন তৈরি করা হয়েছিল জানিয়ে মি. মালিক বলেন, “সেসময় নারীরা তুলনামূলকভাবে ঘর থেকে কম বের হতো এবং নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, তেমন সামাজিক প্রেক্ষাপট ছিল না।”

কিন্তু বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে এই সংরক্ষিত আসন অনেকটাই অকার্যকর বলে মনে করেন তিনি।

“সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ যেই এলাকার দায়িত্বে থাকেন, সেই এলাকায় তো জনগণের ভোটে নির্বাচিত একজন এমপি থাকেন। কাজেই তাদের (সংরক্ষিত আসনের সাংসদদের) ভূমিকাটা সাধারণত থাকে গৌণ।”

মালিকের মতে, সংরক্ষিত আসনের সাংসদ হিসেবে কাকে মনোনয়ন দেয়া হবে তা রাজনৈতিক বিবেচনায় নির্ধারণ না করে মেধাভিত্তিক বা অভিজ্ঞতা ভিত্তিক বিবেচনায় নির্ধারণ করলে সংসদে অবদান রাখতে সক্ষম হবেন সংরক্ষিত আসনের নারী প্রার্থীরা।

“আইনজীবী বা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন যিনি বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞানের মতো বিষয়ের অধ্যাপক হিসেবে যে নারী দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন – এমন কোনো নারী সংরক্ষিত আসনে সাংসদ হলে সংসদীয় বিতর্কে বা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেন।”

“কিন্তু বাংলাদেশে সাধারণত সেরকম বিবেচনা করে সংরক্ষিত আসনের সাংসদ মনোনয়ন দেয়া হয়না।”

সংরক্ষিত আসনের সাবেক সাংসদ সাবিনা আক্তার তুহিনও বলেন, পরিবারতন্ত্রকে প্রাধান্য দিয়ে নারী সাংসদ নির্বাচন না করে একজন নারীর অতীত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সাংসদ নির্বাচন করলে সংরক্ষিত আসনের এমপি’রা সংসদে আরো গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারবে।

এসএইচ-২৯/১৫/১৯ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্য সূত্র : বিবিসি)