সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধু

বাংলা ও বাঙালীর কাছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামটি চিরজাগরূক হয়ে থাকবে। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এ বাঙালীর অবদানের পাশাপাশি তাঁর জন্মের তিথিও চিরজাগরূক থাকবে বাঙালীর প্রাণের স্পন্দনে। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বাঙালীর জন্য আশীর্বাদের একটি দিন। আনন্দের দিনও বটে। এদিন হাজার বছরের শৃঙ্খলিত বাঙালীর মুক্তির দিশা নিয়ে জন্ম নিয়েছিল মুজিব নামের এক দেদীপ্যমান আলোক শিখার।

এ আলোক শিখা ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র, নিকষকালো অন্ধকারের মধ্যে পরাধীনতার আগল থেকে মুক্ত করতে পথ দেখাতে থাকে পরাধীন জাতিকে। অবশেষে বাংলার পুব আকাশে পরিপূর্ণ এক সূর্য হিসেবে আবির্ভূত হয় স্বাধীনতা, বাঙালী অর্জন করে মুক্তি। স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আজ নেই, কিন্তু সে সূর্যের প্রখরতা আগের চেয়েও বেড়েছে অনেকগুণ। তাঁর অবস্থান এখন মধ্যগগনে। সেই সূর্যের প্রখরতা নিয়েই বাঙালী জাতি আজ এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে।

আজ সেই ১৭ মার্চ। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৯ তম জন্মবার্ষিকী, জাতীয় শিশু দিবস। ১৯২০ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জের অজপাড়াগাঁ মধুমতি আর বাইগার নদীর তীরে এবং হাওড়-বাঁওড়ের মিলনে গড়ে ওঠা বাংলার অবারিত গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় শেখ পরিবারে জন্ম নেয়া খোকা নামের শিশুটি কালের আবর্তে হয়ে উঠেছিলেন নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালীর ত্রাণকর্তা ও মুক্তির দিশারী। গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ এবং জনগণের প্রতি মমত্ববোধের কারণে পরিণত বয়সে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা। এক বর্ণাঢ্য সংগ্রামবহুল জীবনের অধিকারী এই নেতা বিশ্ব ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার হিসেবে।

একাত্তরের এই দিনে জনৈক এক বিদেশী সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে জানতে চান, আজ ৫২তম জন্মদিনে আপনার সবচেয়ে বড় কামনা কী? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, জনগণের সার্বিক মুক্তি। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি জন্মদিন পালন করি না। আমার জন্মদিনে মোমবাতি জ্বালাই না, কেকও কাটি না। বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, আমি জনগণেরই একজন। আমার জন্মদিনই কি, আর মৃত্যুদিনই কি! আমার জনগণের জন্যই আমার জীবন ও মৃত্যু। আপনারা জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যেকোন মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে।

দু’শ’ বছরের পরাধীনতার জিঞ্জির ছিঁড়ে এই বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্বেই ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাকামী বাঙালীর দীর্ঘ নয় মাস মৃত্যুপণ জনযুদ্ধের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে অর্জিত হয়েছিল মহামূল্যবান স্বাধীনতা। ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান এবং অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাঙালী জাতি অর্জন করে তাদের হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন প্রিয় স্বাধীনতা। বিশ্বের মানচিত্রে স্থাপন করে সার্বভৌম বাংলাদেশ, নিজস্ব লাল-সবুজ পতাকায় আচ্ছাদিত হয় বাঙালীর হৃদয়। বঙ্গবন্ধুর আজীবন সংগ্রাম ও দূরদর্শী নেতৃত্বেই পৃথিবীর মানচিত্রে সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। পূর্ণতা পায় ভাষাভিত্তিক বাঙালী জাতীয়তাবাদ।

পাকিস্তানী শাসকদের শোষণ-বঞ্চনা, ঔপনিবেশিক লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, নিপীড়ন-নির্যাতন থেকে বাঙালী জাতিকে মুক্ত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তানী জল্লাদরা কারাবন্দী রেখে কবর খুঁড়েও যাঁকে হত্যা করার সাহস পায়নি; অথচ স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় সেই হিমালয়সম ইস্পাতদৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একাত্তরের পরাজিত শক্তির পেতাত্মা নরপিশাচ ঘাতকরা হত্যা করে ক্ষমতার পালাবদল করেছিল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের হয়ে কাজ করা ঘাতকচক্রের বুলেটে সেদিন ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের হৃদপি-। কিন্তু তারপরও একটি জাতি ও অবহেলিত মানুষের মুক্তির অগ্রদূত হিসেবে বঙ্গবন্ধু শুধু দেশে নয়, সারা বিশ্বেই ইতিহাস হয়ে রয়েছেন।

নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ ও দেশের মানুষের প্রতি মমত্ববোধের কারণে বাঙালীর ‘জাতির জনক’ উপাধি অর্জন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য বিংশ শতাব্দীতে যাঁরা মহানায়ক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সাম্য, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার বিরামহীন সংগ্রামে অবিস্মরণীয় ভূমিকার কারণে বঙ্গবন্ধু ভূষিত হয়েছিলেন নোবেলখ্যাত বিশ্বশান্তি পরিষদের ‘জুলিওকুরি’ পদকে। বিশ্বের কোটি কোটি বাঙালীর হৃদয়ের মণিকোঠায় বঙ্গবন্ধু যে অমলিন, তার প্রমাণ মেলে সারা বিশ্বের বাঙালীর ওপর পরিচালিত বিবিসির জরিপে। সারাবিশ্বের বাঙালীর শ্রদ্ধাঞ্জলিতে বঙ্গবন্ধু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠতম বাঙালী হিসেবে নির্বাচিত হন।

টুঙ্গিপাড়া গ্রামেই খোকা থেকে জাতির পিতায় পরিণত হওয়া শেখ মুজিবুর রহমান ধন ধান্য পুষ্পে ভরা শস্য শ্যামলা রূপসী বাংলাকে দেখেছেন। আবহমান বাংলার আলো-বাতাসে লালিত ও বর্ধিত হয়েছেন। তিনি শাশ্বত গ্রামীণ সমাজের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ছেলেবেলা থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। শৈশব থেকে তৎকালীন সমাজজীবনে বঙ্গবন্ধু জমিদার, তালুকদার ও মহাজনদের অত্যাচার, শোষণ ও প্রজাপীড়ন দেখেছেন। গ্রামের হিন্দু, মুসলমানদের সম্মিলিত সামাজিক আবহে তিনি দীক্ষা পান অসাম্প্রদায়িকতার। বস্তুতপক্ষে সমাজ ও পরিবেশ তাঁকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম করতে শিখিয়েছে। তাই পরবর্তী জীবনে কোন শক্তির কাছে, যে যত বড়ই হোক, আত্মসমর্পণ করেননি, মাথানত করেননি।

চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়রা খাতুনের তৃতীয় সন্তান। ৭ বছর বয়সে তিনি পার্শ্ববর্তী গিমাডাঙ্গা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরবর্তীতে তিনি মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুল, গোপালগঞ্জ সরকারী পাইলট স্কুল ও পরে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে লেখাপড়া করেন। মাধ্যমিক স্তরে পড়াশোনার সময় বঙ্গবন্ধু চোখের রোগে আক্রান্ত হলে কলকাতায় তাঁর চোখের অপারেশন হয়। এই সময়ে কয়েক বছর তাঁর পড়াশোনা বন্ধ থাকে।

১৯৪২ সালে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে কলকাতায় গিয়ে বিখ্যাত ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন এবং সুখ্যাত বেকার হোস্টেলে আবাসন গ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি বিএ পাস করেন। শেখ মুজিবুর রহমান এই সময়ে ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই সময়ে তিনি শীর্ষ রাজনীতিক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমের মতো নেতাদের সংস্পর্শে আসেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং এদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের একমাত্র চাওয়া-পাওয়া। যার জন্য জীবনে তিনি জেল-জুলুম-হুলিয়া কোনকিছুই পরোয়া করেননি। দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রামে তিনি শত যন্ত্রণা, দুঃখ, কষ্ট-বেদনা সহ্য করেছেন, ফাঁসির মঞ্চও যাঁর কাছে ছিল তুচ্ছ; তিনি হচ্ছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী শেখ মুজিবুর রহমান।

’৭৫-পরবর্তী ইতিহাসের এই রাখাল রাজার নাম মুছে ফেলার অনেক ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের সকল ষড়যন্ত্রই ব্যর্থ হয়েছে। কারণ বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব। ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে ‘জাতীয় শিশু দিবস’ এবং সরকারী ছুটি ঘোষণা করে। কিন্তু ২০০১ সালে যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতায় এসেই বিএনপি ছুটি বাতিল করে দেয়। ২০০৯ সালে ভূমিধস মহাবিজয় নিয়ে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার আবারও সরকারী ছুটি ঘোষণা করে। সেটি এখনও অব্যাহত। তাই আজ সরকারী ছুটির দিন। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

 এসএইচ-০২/১৭/১৯ (অনলাইন ডেস্ক)