তথ্য প্রযুক্তির নতুন বাজার ধরতে চান বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা

প্রায় দুই দশকের পথ চলায় একটু একটু করে বিশ্বের তথ্য প্রযুক্তি অঙ্গনে জায়গা করে নিচ্ছে বাংলাদেশ৷ অ্যান্টি ভাইরাস, আইওটি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির মতো সেবা নিয়েও বিশ্ব বাজারে হাজির হচ্ছে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো৷

প্রযুক্তির ব্যবহার যত বাড়ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাইবার হামলা৷ বাড়ছে তাই অ্যান্টি ভাইরাসের মতো সাইবার নিরাপত্তা পণ্যের বাজারও, যা বিশ্বের বাঘা বাঘা সব প্রতিষ্ঠানের দখলে৷ দুই বছর হলো, এই বাজারে লড়ছে বাংলাদেশের রিভ সিস্টেমস নামের একটি প্রতিষ্ঠান৷ ভারত, নেপালের পর এ বছর তারা যাত্রা শুরু করেছে ইউরোপের বাজারেও৷ মোট আটটি দেশে তাদের এই নিরাপত্তা পণ্য রপ্তানি হচ্ছে৷ শুধু অ্যান্টি ভাইরাস নয়, বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আইওটি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি, ডিজিটাল মার্কেটিং, রাইড শেয়ারিংসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি সেবা সরবরাহ করছে বিশ্বের অনেক দেশে৷

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো সফটওয়্যার রপ্তানি শুরু করেছে দুই দশকের কিছু আগে৷ তখনকার একটি প্রতিষ্ঠান ডাটা সফট, যাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৯৮ সালে৷ ‘‘প্রস্তুতিটা শুরু হয়েছিল তারও তিন-চার বছর আগে৷ ১৯৯৬ থেকে সারা বিশ্বে ‘ওয়াইটু’ বা ২০০০ সালের পর কম্পিউটার ব্যবস্থার কী হবে তা নিয়ে আলোচনা শুরু হলো৷ ভারত তখন এ সংক্রান্ত সল্যুশন বের করে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিলো৷ তখন আমাদের এখানেও হাওয়া লাগল যে, ভারত যখন এত কিছু করছে আমরাও কিছু করতে পারি কিনা৷” বলছিলেন ডাটা সফটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব জামান৷ তিনি জানান, এর আগেও কিছু প্রতিষ্ঠান হার্ডওয়্যার আর তার সংশ্লিষ্ট কিছু সফটওয়্যার রপ্তানি করেছিল, কিন্তু শুধু সফটওয়্যার ডেভেলপার বা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ছিল না৷

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে সাথে নিয়ে তিনি চলে গেলেন ভারতের ব্যাঙ্গালোরে৷ সেখানে ইনফোসিসের কার্যালয় ঘুরে এসেই প্রতিষ্ঠা করলেন ডাটা সফট৷ তাদের প্রথম স্লোগান ছিল ‘উই মেক সফটওয়্যার, উই মেক ইউর কম্পিউটার মিনিংফুল’৷ জামান বলেন, ‘‘ তখন কম্পিউটার সায়েন্স ছিল শুধু বুয়েটে৷ সেখানকার ছাত্ররা পাস করার পর বিদেশে চলে যেতো৷ এজন্য আমরা সায়েন্স, অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রদের কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শিখিয়েছি, তিন দফায় প্রতি ব্যাচে ২৫ জন করে৷” তাদের নিয়েই পরবর্তীতে ডাটা সফট যাত্রা শুরু করে৷

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস বেসিসের সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির জানান, ৯০ দশকের শুরুতে বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিংয়ের কাজের মাধ্যমে তথ্য প্রযুক্তি সেবা রপ্তানি শুরু করে বাংলাদেশ৷ তবে পুরোপুরি সফটওয়্যার-নির্ভর রপ্তানি শুরু হয়েছে মূলত ১২-১৪ বছর আগে৷ ‘‘তখন মূলত ছোটখাটো সফটওয়্যার যেমন অ্যাকাউন্টিং, ইনভেন্ট্রি কন্ট্রোল সফটওয়্যার, পে-রোল সফটওয়্যার, পরবর্তিতে সেগুলোকে একসাথ করে ইআরপি সফটওয়্যার তৈরি করে বিক্রি করা হতো৷ এভাবেই ধীরে ধীরে সফটওয়্যারগুলো ডাইভারসিফাই হয়েছে৷”

১৯৯৭ সালে ১৭ টি প্রতিষ্ঠান নিয়ে যাত্রা শুরু করে বেসিস৷ বর্তমানে তাদের সদস্য সংখ্যা বেড়ে ১১৭১টিতে দাঁড়িয়েছে, যার মধ্যে ৪০০-রও বেশি প্রতিষ্ঠান বর্তমানে ৬০ টি দেশে প্রযুক্তি সেবা রপ্তানি করছে৷

২০১৬ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের বাজারে নিজেদের তৈরি অ্যান্টি ভাইরাস সফটওয়্যার ছাড়ে রিভ সিস্টেমস৷ রিভ অ্যান্টি ভাইরাসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (মার্কেটিং) ইবনুল করিম রূপেন জানান, ২০১৪ সালে কাজ শুরু করে ২০১৬ সালের শেষ দিকে এসে তারা অ্যান্টি ভাইরাসের একটি পরীক্ষামূলক সংস্করণ ছাড়েন দেশের বাজারে৷ ‘‘বাণিজ্যিকভাবে আমরা বাজারে ছাড়ি ২০১৭ সালের শুরুতে৷ ভালো ফিডব্যাক পাওয়ার পর ২০১৭ সালের মে থেকে আমরা রপ্তানি শুরু করি ভারতে৷ তারপরপরই শুরু করি নেপালে৷”

প্রতিষ্ঠানটির রিটেল এবং এন্টারপ্রাইজ দুই ধরনের অ্যান্টি ভাইরাস রয়েছে, যার মধ্যে রিটেল অ্যান্টি ভাইরাস নিয়ে তারা এখন ইউরোপের বাজারে যাত্রা শুরু করেছে৷ ‘‘ইন্ডিয়া ও নেপালের পরে এ বছর আমরা এক্সপোর্ট শুরু করেছি তাঞ্জানিয়া, কেনিয়াসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশে৷ এরপর আমাদের ইউক্রেন, বেলারুশ, মলদোভা– এই তিনটি দেশে এক্সপোর্ট শুরু হয়েছে৷ সেখানকার পার্টনার এবং অথরাইজড ডিস্ট্রিবিউটররা আমাদের প্রোডাক্ট ইম্পোর্ট করছে,” বলেন রুপেন৷ ৫০ টি দেশের গ্রাহক অনলাইনের মাধ্যমে তাদের অ্যান্টি ভাইরাস কিনে নিচ্ছে বলেও জানান তিনি৷

নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবে প্রযুক্তি সেবা রপ্তানি করে আসছে ডাটাসফট৷ তিন বছর হলো আফ্রিকার ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর একটি সেতুতে আইওটিভিত্তিক টোল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সরবরাহ করেছে তারা৷ প্রতিষ্ঠানটি এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও আইওটি প্রযুক্তির বিশ্ব বাজার ধরতে চায় বলে জানান মাহবুব জামান৷ এরই মধ্যে তারা জাপানে তাদের অফিস খুলেছে৷ কাজ করছে জনসন কন্ট্রোল হিটাচির আইওটি ডেভলপমেন্ট পার্টনার হিসেবে৷

‘‘এই ধরনের একটি কোম্পানির সাথে পার্টনারশিপে যাওয়ার সক্ষমতা অর্জন বাংলাদেশের জন্যেও গৌরবের ব্যাপার,” বলেন জামান৷ টোকিও অলিম্পিককে সামনে রেখে তাঁরা সেখানকার ১০ হাজার অ্যাপার্টমেন্টে আইওটি সল্যুশন দেয়ার একটি কার্যাদেশও পেয়েছেন৷ ফ্লোরিডার স্কুলে ফেস রিকগনিশন প্রযুক্তি নিয়েও হাজির হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি৷ সৌদি আরবের মক্কার বাসাবাড়িতে কেন্দ্রীয় পানি ব্যবস্থাপনার উপর একটি মনিটরিং প্রযুক্তিও তারা সরবরাহ করছে বলে জানান জামান৷

বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ‘টাইগার আইটি’ এরই মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার সরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন প্রকল্পে প্রযুক্তি সরবরাহ করে পরিচিতি পেয়েছে৷ ২০১৩ সালে তারা নেপালের ১ দশমিক ১ কোটি মানুষের ভোটার নিবন্ধন সিস্টেম ডেভেলপমেন্টের কাজ পায়৷ ২০১৬ সালে দেশটির ট্রান্সপোর্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম প্রকল্পের দায়িত্ব পায় তারা৷ এছাড়াও ভূটানের অভিবাসীদের জন্য বায়োমেট্রিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম, কেনিয়ায় ই পাসপোর্ট সিস্টেম, ভারতের রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বীমা যোজনা প্রকল্পের কাজও করেছে টাইগার আইটি৷

স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ‘পাঠাও’ গত বছরের সেপ্টেম্বরে নেপালের কাঠমান্ডুতে রাইড শেয়ারিং সেবা চালু করেছে৷ দেশটিতে তারা এ ধরনের দ্বিতীয় সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান৷

বেসিসের সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির জানান, বিশ্বে আগামী দিনে নতুন নতুন যেসব প্রযুক্তি আসছে সেগুলো নিয়ে এরইমধ্যে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো৷ ‘‘কিছু কিছু কোম্পানি আইওটি নিয়ে কাজ শুরু করেছে, আইওটি ল্যাব তৈরি হয়েছে৷ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে৷ ব্লক চেইন নিয়েও কাজ শুরু হয়েছে৷ তবে সবই নতুন পর্যায়ে রয়েছে৷” তাঁর মতে, সামনে নতুন এসব প্রযুক্তির চাহিদা ক্রমশ বাড়বে, কিন্তু এই বাজার ধরার জন্য খুব দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে পরিবর্তন আনতে হবে৷ ‘‘এখন প্রয়োজন হলো, যেসব ছেলে-মেয়েরা কম্পিউটার সায়েন্স মেজর নিয়ে পড়ছে, তাদের সিলেবাসে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা৷ বিষয়টি নিয়ে আমরা ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্ট কমিশনের সাথেও কথা বলছি,” বলেন কবির৷

এটি কার্নির ২০১৭ সালের একটি সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ আইটি আউটসোর্সিং, বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের গ্লোবাল সার্ভিস লোকেশন ইনডেক্সে ২১তম অবস্থান দখল করেছে৷ প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের বাইরে এখন অনেকে বিভিন্ন প্লাটফর্মে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমেও আয় করছেন৷ অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের হিসেবে ভারতের পর বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ফ্রিল্যান্সার এখন বাংলাদেশে৷

যেসব প্রতিষ্ঠান বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং করে, তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কলসেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিং বা বাক্ক৷ তাদের হিসাবে ৪০ হাজারের বেশি মানুষ এখন আউটসোর্সিংয়ের সাথে জড়িত, যারা বছরে সব মিলিয়ে ৩০ কোটি ডলারের বেশি আয় করছেন৷

বেসিসের হিসাবে সব মিলিয়ে তথ্য প্রযুক্তি খাত থেকে গত বছর আয় হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি ডলার৷ ২০২১ সালে তা ৫০০ কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার৷ আলমাস কবির বলেন, ‘‘তিন বছরে এই আয় ৫ গুণ করা সম্ভব৷” তাঁর মতে, আগামী বছরের মধ্যে ইউনিয়ন ও পরবর্তীতে গ্রাম পর্যায়ে সরকার ফাইবার অপটিক কেবেল নিয়ে গেলে ইন্টারনেট সহজলভ্য হবে৷

‘‘এটি বাস্তবায়ন হলে ফ্রিল্যান্সিং এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে সফটওয়্যার রপ্তানির পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে৷” পাশাপাশি চলতি বছরের মধ্যে হাইটেক পার্কগুলো যাত্রা শুরু করলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানে বিনিয়োগ করবে বলেও আশাবাদী তিনি৷ ‘‘এই পার্কগুলোতে যদি আমরা এলজি বা সনির মতো একটা বা দুটো বড় কোম্পানিকে নিয়ে আসতে পারি, তারা যদি বড় প্লান্ট বসায়, তাহলে এক্সপোর্টের মাধ্যমে বড় একটা উল্লম্ফন হবে৷”

রপ্তানি বাড়াতে ৫ টি নতুন সম্ভাবনাময় বাজারও চিহ্নিত করেছে বেসিস, যার মধ্যে রয়েছে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক এবং আফ্রিকার একটি দেশ৷ সরকারের সহযোগিতায় প্রচার চালানোর মাধ্যমে এসব দেশের প্রযুক্তি বাজার ধরতে চায় সংগঠনটি৷ ‘‘আমরা সরকারের কাছে প্রপোজাল দিয়েছি৷ জাপানে আমরা একটি বাংলাদেশি ডেস্ক তৈরি করতে চাই৷ এর মাধ্যমে সেখানকার স্থানীয়দের নিয়োগ দেয়া হবে, যাতে তারা বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর মার্কেটিং করে,” বলেন সৈয়দ আলমাস কবির৷

এসএইচ-০৫/১৯/১৯ (ফয়সাল শোভন, ডয়চে ভেলে)