নব্য নেতাকর্মীদের নিয়ে বিপাকে আওয়ামী লীগ

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগে যোগদানের হিড়িক পড়েছিল৷ সেই যোগদান এখনো চলছে৷ কিন্তু ‘নব্য আওয়ামী লীগারদের’ নিয়ে এখন বিপাকে আছে দলটি৷ তাই তাদের তালিকা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷

আওয়ামী লীগে ‘হাইব্রিড’ ও ‘কাউয়া’ শব্দ দু’টি বহুল পরিচিত৷ এই দু’টি শব্দ কয়েক বছর আগে সামনে নিয়ে আসেন বর্তমানে চিকিৎসার জন্য সিংগাপুরে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের৷ মূলত যারা সুযোগ সুবিধার জন্য বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন তাদেরই তিনি ওই দুই নামে অভিহিত করেছেন৷ এই নব্য আওয়ামী লীগের কারণে কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে এখন৷

বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনের আগে যেমন ‘পরিস্থিতি’ আঁচ করতে পেরে বিএনপি ও জামায়াত থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন অনেকে, তেমনি দল ভারী করার জন্যও আওয়ামী লীগের অনেক সংসদ সদস্য প্রার্থী ও নেতা তাদের আওয়ামী লীগে যোগদানে বাধ্য করেছেন৷ দেশের তৃনমূল পর্যায়ে এখন বিএনপি জামায়াত খুঁজে পাওয়া ভার৷

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এবার টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় পর্যায়ে যেন সবাই আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে৷ পরিস্থিতি এমন যে কোথাও কোথাও নব্য আওয়ামী লীগারদের হাতে আওয়ামী লীগ বা তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মার খাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে৷

অভিযোগ আছে, গত ২৬ মার্চ লালমনিরহাটে ‘নব্য’ আওয়ামী লীগ হামলা চালায় ‘আসল’ আওয়ামী লীগের ওপর৷ তাদের হামলায় স্থানীয় সাংবাদিক শাহাজান সাজুও আহত হন৷ সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ওই হামলার সময় রিপন নামে একজনকে বলতে শোনা যায় , ‘‘আমি এখন শিবির করি না, আওয়ামী লীগ করি৷”

গত ১০ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে বিদ্যালয় এলাকায় প্রকাশ্য ধূমপানে নিষেধ করায় ছাত্রদল থেকে সদ্য আওয়ামী লীগে যোগ দেয়া তানভীর আহমেদের নেতৃত্বে স্থানীয় যুবলীগের আহ্বায়ক উত্তম কুমার বিশ্বাসের বাড়িতে হামলা চালানো হয়৷

আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, এরকম আরো অনেক ঘটনার খবর পাওয়া যাচ্ছে৷ বিশেষ করে যেসব এলাকায় আওয়ামী লীগের মূল স্রোতের বাইরে থেকে মনোনয়ন নিয়ে যারা সংসদ সদস্য হয়েছেন তারা বিভিন্ন দল থেকে লোক ভিড়িয়ে আওয়ামী লীগ বিরোধী আরেকটি আওয়ামী লীগ তৈরি করেছেন স্থানীয় পর্যায়ে৷ আর তাদের মধ্যে টেন্ডার, ব্যবসা বণিজ্যসহ নানা বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে৷

ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সহসম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির বলেন, ‘‘আমার নির্বাচনি এলাকা রাজাপুর- কাঠালিয়া৷ এখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে যিনি এমপি হয়েছেন তিনি মূলধারার আওয়ামী লীগ নন৷ ফলে তিনি আওয়ামী লীগের বাইরের লোকজনকে দলে ভিড়িয়েছেন৷ জামায়াত শিবিরের লোকজনকেও সাথে নিয়েছেন৷ ফলে আমার এলাকার এখন বিভিন্ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগ বিরোধীদের দাপট৷ আমরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছি৷”

লালমনিরহাটের একজন সাংবাদিক জানান, ‘‘পাটগ্রাম ও হাতিবান্ধা এলাকায় বিএনপি ও জামায়াত এখন আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রক৷ নেতাদের ডানে বায়ে সব সময় তাদেরই দেখা যায়৷ আর এখানে আছে ভোটের হিসেব৷ ফলে যারা মূল আওয়ামী লীগ কর্মী তারা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে৷”

পরিস্থিতি যে ভালো নয় তা বোঝা যায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিমের কথায়৷ গত ১৯ মার্চ তিনি ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘‘নব্য আওয়ামী লীগাররা বিএনপি জামায়াতের চেয়েও ভয়ঙ্কর৷ এরা সুযোগসন্ধানী৷ এদের চিনে রাখতে হবে৷ এখন দেশের সবাই আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে৷ যাদের কখনও আওয়ামী লীগের সভা-সমাবেশ দেখিনি তারাও এখন আওয়ামী লীগ করে৷ এদের থেকে সাবধান ও সর্তক থাকতে হবে৷”

দেশের কয়েকটি এলাকার স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে দলে দলে আওয়ামী লীগে যোগদানের যে কারণ জানা গেছে তা হলঃ

১. নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি বুঝে অনেকেই নিজেদের বাঁচাতে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন৷

২. একটি অংশকে যোগদানে বাধ্য করা হয়েছে হামলা মামলার ভয় দেখিয়ে৷

৩. ভোটের হিসেবের কারণে জামায়াতকেও সাথে নেয়া হয়েছ৷

৪. নির্বাচনের পরে সুযোগ সন্ধানীরা নানা পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতার সূত্রে আওয়ামী লীগে ভিড়েছেন৷

৫. স্থানীয় আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্বের কারণে দল ভারী করতে গ্রুপগুলো বিএনপি জামায়াতকে দলে জায়গা দিয়েছে৷

৬. কেউ কেউ ব্যবসা বাণিজ্য বা অবস্থান টিকিয়ে রাখতে আওয়ামী লীগের আশ্রয়ে চলে গেছেন৷

আওয়ামী লীগের আশ্রয়ে যাওয়ার এই সময়ে আলোচিত উদাহরণ ফেনীর সোনাগাজী মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও নুসরাত হত্যা মামলার আসামি সিরাজ উদ দৌলা৷ তিনি তিন বছর আগে জামায়াত থেকে বহিস্কৃত হওয়ার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সুবিধা দিয়ে আওয়ামী লীগের আশ্রয়ে চলে যান এবং আওয়ামী লীগ হয়ে যান৷

রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. রেজাউল করিম রাজু বলেন, ‘‘কিছু লোক আছেন যারা সবসময় সরকারি দল করেন৷ আবার কিছু লোক আছেন যারা তাদের ব্যবসা বাণিজ্য ও নানা সুবিধা টিকিয়ে রাখতে চান৷ তাদের কোনো আদর্শ নেই৷ এরা বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী লীগের আদর্শে বিশ্বাসী নন৷ তারা সুবিধা নেয়ার জন্যই আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছেন৷ তারা আওয়ামী লীগের দুর্নামেরও কারণ হচ্ছেন৷ বিভিন্নজন তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে তাদের দলে ঢোকার সুযোগ করে দিচ্ছেন৷ ফলে ত্যাগী নেতা-কর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন৷”

গত ৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে ‘নব্য আওয়ামী লীগার’ নিয়ে আলোচনা হয়৷ বৈঠকে আগামী সেপ্টেম্বরে দলের কাউন্সিলের আগেই তাদের তালিকা প্রস্তুত করা এবং তাদের তৎপরতার ব্যাপারে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে বলা হয়েছে৷

আওযামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এমপি বলেন, ‘‘আমাদের নেতাদের সরলতার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কিছু সুযোগ সন্ধানী ঢুকে পড়েছে৷ তাদের আমরা চিহ্নিত করছি৷ আওয়ামী লীগ একটি বড় দল৷ আমরাতো দরজা বন্ধ করে রাখাতে পারিনা৷ যারা দলের নাম ভাঙ্গিয়ে অনৈতিক ও অবৈধ সুযোগ সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করছেন তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া হবেনা৷ আর সামনের কাউন্সিলে তারা দলের কোনো পর্যায়ের কমিটিতে যাতে ঢুকতে না পারে সেজন্য সতর্ক করে দেয়া হয়েছে৷”

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘জামায়াত হয়তো স্থানীয় পর্যায়ে দলে ঢুকতে পারে৷ এমনিতে আওয়ামী লীগে তাদের অনুপ্রবেশের সুযোগ নেই৷ তারপরও কেউ ঢুকে পড়লে তা চিহ্নিত হয়ে যাবে৷”

তিনি আরো বলেন, ‘‘বিভিন্ন দল থেকে হয়তো কৌশলে অনেকে আওয়ামী লীগে ঢোকার পর এখন তাদের আসল চরিত্র প্রকাশ পাচ্ছে৷ আওয়ামী লীগে আদর্শবিরোধী কারুর জায়গা হবেনা৷ আর আওয়ামী লীগের না ভাঙ্গিয়ে কোনো কিছু করে পার পাওয়া যাবেনা৷”

এসএইচ-০৯/২২/১৯ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)