জামায়াতে ইসলামীর সংস্কারপন্থী একটি অংশের নেতারা আগামী কয়েক মাসের মধ্যে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের কথা ঘোষণা করেছেন।
ঢাকায় একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করে জামায়াত থেকে বহিস্কৃত নেতা মজিবুর রহমান মঞ্জু তাদের এই নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরুর কথা আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরেছেন।
তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর বিরোধিতা বা রাজনৈতিক অবস্থানের বোঝা ‘৭১ পরবর্তী প্রজন্মের’ বহন করা উচিত নয়।
এখন সংস্কারপন্থীদের নতুন এই দল গঠনের উদ্যোগ জামায়াতে ইসলামীর উপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে-সেই প্রশ্ন উঠেছে।
মাঠ পর্যায়ের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, তাদের দলে তরুণ প্রজন্মের মাঝে নতুন এই দলটি প্রভাব ফেলতে পারে।
কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ডা: শফিকুর রহমান বলেছেন, তাদের সাবেক নেতার নতুন দল জামায়াতে ইসলামীর উপর কোন প্রভাব ফেলবে না বলে তিনি মনে করেন।
মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং দলে সংস্কার প্রশ্নে সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীতে বিরোধ তীব্র হয়।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে দলটির প্রভাবশালী একজন নেতা সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিষ্টার আব্দুর রাজ্জাক দল থেকে পদত্যাগ করেন।
একই ইস্যুতে দলে প্রকাশ্য অবস্থান নেয়ায় জামায়াত থেকে বহিস্কৃত হন মজিবুর রহমান মঞ্জু।
ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি মি: মঞ্জু পরে জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সদস্য হয়েছিলেন। তিনি এখন একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছেন।
‘জন আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’ – এই শ্লোগান নিয়ে দল গঠনের জন্য ১৯টি ইস্যু তুলে ধরা হয়েছে। মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের রাজনৈতিক অবস্থানের বোঝা ‘৭১ পরবর্তী প্রজন্মের’ বহন করা উচিত নয়।
“মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী একমাত্র দল না হলেও পরবর্তী সময়ে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান এবং ভূমিকা নিয়েই বেশি প্রশ্ন আর বিতর্ক তৈরি হয়েছে।”
তিনি বলেন, “দল হিসেবে জামায়াত মুক্ত ও স্বাধীন বাংলাদেশে সক্রিয় হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ভূমিকার জন্য দায় দায়িত্ব স্বীকার এবং ঐতিহাসিক ক্ষত উপশমের জন্য আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণের দাবিকে বরাবরই অগ্রাহ্য করেছে। এই রাজনৈতিক অবস্থানের বোঝা ৭১ পরবর্তী প্রজন্মের বহন করা উচিত নয় বলে আমরা বিশ্বাস করি।”
নতুন দলের রাজনৈতিক ভিত্তি, কৌশল বা সাংগঠনিক কাঠামো কি হবে, কী হবে দলের নাম- এসব বিষয়ে প্রস্তাব তৈরির জন্য পাঁচটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেছেন, তারা ধর্মভিত্তিক কোন রাজনৈতিক দল গঠন করছেন না। তাদের দল হবে একট উন্মুক্ত প্লাটফরম।
“আমরা প্রত্যেক নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। আমরা কোন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন করবো না। আমরা যে রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছি, তা হবে ধর্ম, জাতি,লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য উন্মুক্ত একটি প্লাটফরম। এটা সম্পূর্ণ স্বাধীন উদ্যোগ এবং একটি স্বতন্ত্র ধারা। জামায়াতে ইসলামীসহ বিদ্যমান কোন রাজনৈতিক দলের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।”
দলটির সেক্রেটারি জেনারেল ডা: শফিকুর রহমান বলেছেন, তাদের সাবেক নেতার দল গঠনের উদ্যোগ জামায়াতে ইসলামীর উপর কোন প্রভাব ফেলবে না।
তিনি উল্লেখ করেছেন, মজিবুর রহমান মঞ্জু এক সময় জামায়াতের সাথে ছিলেন এবং একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এসেছেন। এখন মঞ্জু যে দল গঠন করছেন, এমন অনেক দল বাংলাদেশে থাকতে পারে।
তিনি বলেছেন, কেউ দল গঠন করতে চাইলে, সে অধিকার তার আছে।
তবে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়ার ইস্যু বা সংস্কার নিয়ে যে বিরোধের কথা আসছে, সেই প্রশ্নে ডা: শফিকুর রহমান বলেছেন, “আমাদের দলে সংস্কারপন্থী বলে কিছু নেই। কাউকে সেভাবে চিহ্নিতও করা হয় না। কোন ইস্যুতে ভিন্নমত আসতে পারে, সে ধরনের মতামতকে আমরা সম্মান করে এগুচ্ছি।”
তবে কয়েকটি জেলার নেতাদের সাথে কথা বলে মনে হয়েছে, তাদের একজন সাবেক নেতার দল গঠনের বিষয়কে তারা গুরুত্ব দিচ্ছেন। এর একটা প্রভাব তাদের দলে তরুণ প্রজন্মের উপর পড়তে পারে বলেও তারা মনে করছেন।
তবে তারা এবিষয়ে সতর্ক রয়েছেন বলে উল্লেখ করছেন।
৭১-এ যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে বেশ আগে। তাদের একজন মুহাম্মদ কামারুজ্জামান দলে সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।
এছাড়াও বিভিন্ন সময় দলটিতে মুক্তিযুদ্ধ ইস্যু এবং সংস্কারের পক্ষে অনেকে অবস্থান নিয়েছেন। এখন এই একই ইস্যুতে আলাদা একটি দল গঠিত হচ্ছে।
জামায়াতের ঘনিষ্ট পর্যবেক্ষক শাহ আব্দুল হান্নান বলছিলেন, জামায়াতে বড় কোনো প্রভাব পড়বে না বলে তার মনে হয়েছে।
“যদি তিন চারজন বা পাঁচ সাতজন লোক বেরিয়ে যায়, তাতে জামায়াতের কোন সমস্যাই হবে না। আমার জানা মতে, তারা এটুকুই সতর্ক তাদের লোক যেনো না যায়। তারা তাদের কর্মীদের বলে দিয়েছে, তোমরা মজিবুর রহমান বা এ রকম দু’চারজন থাকলে তাদের সাথে যোগাযোগ করো না। এই সতর্কতার বাইরে আর কিছুই তারা করেনি।”
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচার কার্যক্রমে তাদের পক্ষে অন্যতম আইনজীবী ছিলেন তাজুল ইসলাম। তিনি এই নতুন দল গঠনের সংবাদ সম্মেলনে মি: মঞ্জুর পাশে ছিলেন।
তাজুল ইসলাম অবশ্য বলেছেন, তিনি পেশাগত কারণে সেই দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং তিনি কখনও জামায়াতের রাজনীতির সাথে ছিলেন না। তবে এখন তিনি নতুন দল গঠনের এই প্রক্রিয়ায় রয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরও যারা ছিলেন, তারা এক সময় জামায়াতের সাথে ছিলেন, কিন্তু তারা তেমন পরিচিত নন।
ব্যারিষ্টার রাজ্জাক বা জামায়াতের প্রভাবশালী আর কোন নেতা এই উদ্যোগে আছেন কিনা, সে ব্যাপারে সংবাদ সম্মেলনে পরিস্কার করে কিছু বলা হয়নি।
এছাড়া আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলার চৌধুরী এবং নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ছোটনসহ কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন।
অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেছেন, নতুন দলের প্রভাব জামায়াতের উপর পড়বে বলে তিনি মনে করেন।
“এই গ্রুপটার কথা শুনে আমার মনে হলো যে, তারা মূলত মধ্য ডানপন্থী দল হিসেবে দাঁড়াতে চাইছে। এতে জামায়াত কিছুটা হুমকি অনুভব করবে। প্রথম কথা হলো, বাংলাদেশের সবাই চাইছে যে জামায়াত মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকার জন্য মাফ চাক। এরাতো পরিস্কার করে দিয়েছে যে, তারা মাফ চাওয়ার পক্ষে ছিল। ফলে জামায়াতে সংকট আরও ঘনীভূত হবে।”
সংস্কারপন্থীদের অনেকে অভিযোগ করে আসছেন, সংস্কারের কথা উঠলেই একটা কমিটি করে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কোন সংস্কার আর হয় না।
তারা আরও বলেছেন, এবারও মুক্তিযুদ্ধ এবং সংস্কার ইস্যুতে বিরোধ যখন তীব্র হয়, তখনও একটি কমিটি করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর নাম পরিবর্তন করার কথাও বলা হয়েছে।
এসএইচ-০৬/২৮/১৯ (কাদির কল্লোল, বিবিসি)