মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন

মহান মে দিবস আজ। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। দিনটি শ্রমিকদের, মজুরের, মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন। অবিচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জোর সংগ্রামের শপথ গ্রহণের দিন। শুধু অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন নয়, তাদের আন্দোলন সংগ্রামের অনুপ্রেরণার উৎস এই দিন। যাদের ঘামের বিনিময়ে সচল রয়েছে অর্থনীতির চাকা সেই শ্রমিকদের শোষণ বঞ্চনার অবসান ঘটার স্বপ্ন দেখার দিনও বটে। শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার এই দিন এমনি আসেনি। দিনটি প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে রক্তঝরা ইতিহাস। তাই ইতিহাসের পাতায় এর গুরুত্ব অপরিসীম।

প্রতিবছর মে দিবস এলেই মেহনতি শ্রমজীবী মানুষের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবির কাছে মাথা নোয়াতে হয়। শ্রমিকের আন্দোলনের কারণে আজ ৮ ঘণ্টা কাজ করার স্বীকৃতি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা আইএলও প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই শ্রমিকের এ দাবিকে আইনে পরিণত করেছে। তবে দুঃখের বিষয় যাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন আজ বাংলাদেশের সেইসব শ্রমজীবী মানুষের কাছে দিনটির তাৎপর্য আজও ভালভাবে পৌঁছায়নি। অনেক দিনমজুর, গৃহশ্রমিক জানে না মে দিবস কি। মে মাসের প্রথম দিনটিকে পৃথিবীর অনেক দেশে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয়।

এই দিনটি মে দিবস নামেও পরিচিত। বেশকিছু দেশে মে দিবসকে ‘লেবার ডে’ হিসেবে পালন করা হয়। দিনটি সরকারীভাবে ছুটির দিন। মে দিবস যথাযথ মর্যাদায় পালনে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে কর্মসূচী। দিনটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপ্রতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী ও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। দিনটি যথাযথ পালনের বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে নানা কর্মসূচী।

বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আজ মঙ্গলবার পালন করছে মহান মে দিবস। বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামে অনুপ্রেরণার উৎস এই দিন। বিশ্বের কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও দাবি আদায়ের মহান দিবস এটি। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা উপযুক্ত মজুরি আর দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।

মে দিবস প্রতিষ্ঠার আগে কল-কারখানায় অসহনীয় পরিবেশে প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা কাজ করতে হতো শ্রমিকদের। বিপরীতে মজুরি মিলত নগণ্য, শ্রমিকরা খুবই মানবেতর জীবনযাপন করত। ক্ষেত্রবিশেষে তা দাসবৃত্তির পর্যায়েও পড়ত। ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। তাদের এ দাবি কার্যকর করার জন্য তারা সময় বেঁধে দেয় ১৮৮৬ সালের ১ মে। কিন্তু কারখানা মালিকরা এ দাবি মেনে নেয়নি। ৪ মে ১৮৮৬ সালে সন্ধ্যাবেলা হাল্কা বৃষ্টির মধ্যে শিকাগোর হে-মার্কেট নামক এক বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকরা মিছিলের উদ্দেশে একত্রে জড়ো হয়। ১৮৭২ সালে কানাডায় অনুষ্ঠিত এক বিশাল শ্রমিক শোভাযাত্রার সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়েই এটি করা হয়েছিল। আগস্ট স্পীজ নামে এক নেতা জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশে কিছু কথা বলছিলেন। হঠাৎ দূরে দাঁড়ানো পুলিশ দলের কাছে এক বোমার বিস্ফোরণ ঘটে।

এতে এক পুলিশ নিহত হয়। পুলিশবাহিনী তৎক্ষণাৎ শ্রমিকদের ওপর অতর্কিতে হামলা শুরু করে যা সংঘাতের রূপ নেয়। ১১ জন শ্রমিক এতে শহীদ হয়। পুলিশ হত্যা মামলায় আগস্ট স্পীজসহ আটজনকে অভিযুক্ত করা হয়। প্রহসনমূলক বিচারের পর ১৮৮৭ সালের ১১ নবেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। লুইস লিং নামে একজন একদিন পূর্বেই কারাভ্যন্তরে আত্মহত্যা করেন। অন্য একজনের পনেরো বছরের কারাদ- হয়। ফাঁসির মঞ্চে আরোহনের পূর্বে আগস্ট স্পীজ বলেছিলেন, আজ আমাদের এই নিঃশব্দতা, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে। ২৬ জুন, ১৮৯৩ ইলিনয়ের গবর্নর অভিযুক্ত আটজনকেই নিরপরাধ বলে ঘোষণা দেন। এ আন্দোলনের ফলেই শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার দাবি স্বীকৃতি পায়। এরপর থেকেই মে দিবস প্রতিষ্ঠা পায় শ্রমিকদের দাবি আদায়ের দিন হিসেবে। পরবর্তীতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার।

১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৮৯০ সাল থেকে ১ মে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে ‘মে দিবস’ বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। বিশেষজ্ঞদের মতে মে দিবস আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভের মাধ্যমে সারা বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণীর মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের ওপর এ দিবসের প্রভাব সুদূর প্রসারী। এর প্রভাবে শ্রমিকদের দৈনিক কাজের সময় ১৬ ঘণ্টা থেকে নেমে আসে ৮ ঘণ্টায়। বিশ্বের সব দেশের শ্রমিক এর মাধ্যমে তাদের শ্রমের উপযুক্ত মর্যাদা পেতে শুরু করে। নিজেদের অধিকার আদায়ে তারা এগিয়ে যায় সামনে। মেহনতি মানুষ মুক্তি পেতে শুরু করে তাদের শৃঙ্খলিত জীবন থেকে। বিশ্বের ইতিহাসে সংযোজিত হয় সামাজিক পরিবর্তনের আরেকটি নতুন অধ্যায়। এ কারণে মে দিবস হচ্ছে গোটা পৃথিবীর শ্রমজীবী সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচনা করার দিন।

এসএইচ-১/১/১৯ (অনলাইন ডেস্ক)