দেশে সম্প্রতি বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মায়ের দেখভালের জন্য সন্তানদের দায়িত্ব বাধ্যতামূলক করে একটি খসড়া বিধিমালা তৈরি করেছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়।
সেখানে মা-বাবার উপযুক্ত পরিচর্যা নিশ্চিত করতে ছেলের পাশাপাশি পুত্রবধূর ওপরও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
বিধিমালায় পুত্র সন্তান এবং পুত্রবধূর দায়িত্বের বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও, মেয়ের বাবা-মায়ের প্রতি জামাতা দায়িত্ব পালন করবে কিনা সেইসঙ্গে বাবা-মায়ের দেখাশোনায় মেয়েদের দায়িত্ব কেমন হবে সে প্রসঙ্গে স্পষ্ট করে কিছুই বলা হয়নি।
যাকে ‘বৈষম্যমূলক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ। সমালোচনা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমেও।
বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে অদিতি পাল এই বিধিমালার নিন্দা জানিয়েছেন।
মিজ পাল বলেন,”আমি বিবাহিত এবং শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে থাকছি। তাদের প্রতি অবশ্যই আমার দায়িত্ব আছে। তবে আমিও আমার বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে।”
“আমি যদি আমার বাবা-মা আর শ্বশুর-শাশুড়ীকে সমানভাবে দেখি, দায়িত্ব পালন করি। আমার স্বামীরও দায়িত্ব আমার বাবা-মাকে সমান গুরুত্ব দেয়া।”
“যে নীতিনির্ধারকরা এই বিধিমালা তৈরি করেছেন, তারা নিজেরা কি কন্যাসন্তানদের থেকে কিছু আশা করেন না?” এমন প্রশ্ন রাখেন মিজ পাল।
বিধিমালার ধারাগুলো নিয়ে আপত্তি তুলেছেন মায়েরাও।
যেমন লুৎফুন নাহার এবং সাহানা ইসলাম। এ দুজনের কোন ছেলে সন্তান নেই। তাদের মতে, সন্তান ছেলে বা মেয়ে যাই হোক, বাবা-মায়ের প্রতি সবারই সমানভাবে দায়িত্ব বর্তায়।
এক্ষেত্রে যেমন পুত্রবধূর প্রসঙ্গ এসেছে তেমনি জামাতার বিষয়টি আসাও জরুরি বলে তারা মনে করেন।
লুৎফুন নাহার বলেন, “ছেলে মেয়ে সবারই বাবা-মায়ের প্রতি সমান দায়িত্ব আছে। তাই এই নিয়ে যদি আইন করতেই হয় তাহলে দুইদিকই বিবেচনা করতে হবে। আমার সব সন্তান মেয়ে। আমাকে যেমন মেয়েরা দেখবে তেমনি মেয়ের জামাইয়েরও দেখা উচিত। কারণ আমার মেয়েরা তো তার শ্বশুর-শাশুড়িকে সেবা করছে।”
তিন মেয়ের মা শাহানা ইসলাম বলেন, “ছেলে-মেয়ে বলে কোন কথা নাই। সন্তান সন্তানই। বাবামায়ের প্রতি একটা ছেলের আর ছেলের বউয়ের যেমন দায়িত্ব আছে, তেমনি মেয়ে আর মেয়ের জামাইয়েরও দায়িত্ব আছে। যাদের শুধু মেয়ে সন্তান তাদেরকে কি সেই মেয়েরা দেখবে না?”
বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সেবার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করে ২০১৩ সালে একটি আইন পাস করা হয়েছিল।
সেই আইনের আওতায় সম্প্রতি এই বিধিমালার খসড়াটি তৈরি করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়।
সেখানে বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক সন্তানকে তার বাবা-মায়ের পরিচর্যা নিশ্চিত করতে হবে। সন্তান নিজে উপস্থিত থাকতে না পারলে তার পুত্রবধূ বা পরিবারের অন্য সদস্যদের দিয়ে এই পরিচর্যা নিশ্চিত করতে হবে।
এই ধারাকে সম্পূর্ণ বৈষম্যমূলক বলে আখ্যা দিয়েছেন অ্যাকশন এইডের উইমেন রাইটস এবং জেন্ডার ইকুইটির ব্যবস্থাপক কাশফিয়া ফিরোজ।
তিনি বলেন, “এই বিধিমালা আমাদের সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতারই একটি বহি:প্রকাশ। যদি পুত্রবধূর কথা বলতেই হয় তাহলে জামাতার কথাও বলতে হবে। আর যদি জামাতার দায়িত্বের কথা বলা না হয়, তাহলে পুত্রবধূর প্রসঙ্গও বাদ দিতে হবে।”
খসড়া বিধিমালাটির যে বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠছে সেগুলো খতিয়ে দেখে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সংশোধন আনা হবে বলে জানিয়েছেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব জুয়েনা আজিজ।
তিনি নিজেও মনে করেন বাবা-মায়ের দেখাশোনায় পুত্রবধূর যেমন দায়িত্ব আছে, তেমনি রয়েছে জামাতারও।
মিজ আজিজ বলেন, “স্টেকহোল্ডার থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে এই খসড়া বিধিমালাটি চূড়ান্ত করা হবে। সাধারণ মানুষের মতামতও নেয়া হবে। এখনও এটা চূড়ান্ত হয়নি”
“বিধিমালা সংশোধন করে এই সব বিষয়গুলোকে যুক্ত করা হবে। যেন প্রবীণ বাবা-মায়ের দায়িত্ব সবার ওপরেই বর্তায়।”
এই বিধিমালা আইনে রূপ নিলে মা-বাবারা নতুন করে সন্তানের কাছ থেকে ভরণপোষণ লাভের আইনি অধিকার লাভ করবেন। যা ক্ষুণ্ণ হলে তারা আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন।
এসএইচ-৩০/০১/১৯ (সানজানা চৌধুরী, বিবিসি)