আইরন লেডি ছিলেন মার্গারেট থ্যাচার

ব্রিটেনের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসে একটা বিপ্লব এনেছিল ১৯৭৯-এর সাধারণ নির্বাচন।

চৌঠা মে ১৯৭৯-এর ঐ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে পশ্চিম ইউরোপের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন মার্গারেট থ্যাচার।

তখন তিনি বিশ বছর ধরে ডানপন্থী কনজারভেটিভ দলের এমপি- যেটা সেসময় ছিল বেশ বিরল। তখন ব্রিটেনের রাজনীতিতে হাতে-গোণা যে কয়েকজন নারী ছিলেন তাদের “ব্যতিক্রমী” বলে গণ্য করা হতো।

এমনকি মিসেস থ্যাচার নিজেও কখনও ক্ষমতায় তার এই উত্থানের সম্ভাবনা ভাবতে পারেননি।

তিনি নিজেই একসময় মন্তব্য করেছিলেন, “আমার জীবদ্দশায় মনে হয় না ব্রিটেনে কোন নারী প্রধানমন্ত্রী হবেন।”

পরে মিসেস থ্যাচারের ব্যক্তিগত সচিব হয়েছিলেন ক্যারোলাইন স্লোকক – ১৯৭৯-এর নির্বাচনের সময় যিনি ছিলেন স্নাতোকত্তর ছাত্রী এবং নির্বাচনী লড়াই তিনি বেশ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন ।

সেসময় তিনি কিন্তু মোটেই মার্গারেট থ্যাচারের ভক্ত ছিলেন না। বরং তার মনে হতো ‘হাবভাবে ও আচরণে মিসেস থ্যাচার বড়ই সেকেলে’।

“তার চেহারাটা বেশ আকষর্ণীয় ছিল- কিন্তু তাকে অনেক কারণে বেশ সেকেলে মনে হতো- সময়ের সঙ্গে বেমানান। তিনি পুরোন স্টাইলের টুইডের পোশাক পরতেন, তিনি টুপি পরতেন আর কথা বলতেন খানিক কৃত্রিমভাবে- যেটা আমরা পছন্দ করতাম না,” বলেন ক্যারোলাইন স্লোকক।

১৯৭৯-এর নির্বাচনী প্রচারণায় মিসেস থ্যাচারের বক্তৃতা মোটেই পছন্দ করেন নি ক্যারোলাইন স্লোকক।

“টিভিতে মিসেস থ্যাচারকে দেখলেই টিভি আমি বন্ধ করে দিতাম- তার কথার ধরন আমার বিরক্তিকর লাগত।”

ক্যারোলাইনের মত, নারীবাদী মেয়েদের মিসেস থ্যাচারকে পছন্দ হওয়াটাই কিন্তু ছিল স্বাভাবিক।

তবে ক্যারোলাইন স্লোককের এখন মনে হয় তিনি আসলে সেসময় মিসেস থ্যাচার বিদ্বেষী ছিলেন।

“ক্ষমতাশালী নারী বললেই মানুষের মনে যেসব নেতিবাচক বিষয় চলে আসত – মিসেস থ্যাচারের মধ্যে সেগুলো ছিল বলে আমার মনে হতো। আমার চোখে তিনি ছিলেন অনেকটা স্কুল হেডমিস্ট্রেসের মত- নারীবাদী- আক্রমণাত্মক।”

যমজ সন্তানের মা, অক্সফোর্ড থেকে দুদুটো অনার্স ডিগ্রিধারী মার্গারেট থ্যাচার চ্যালেঞ্জ পছন্দ করতেন। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি কনজারভেটিভ দলের মধ্যে তখন একটা বিভেদ চলছে। তার সুযোগ নিয়ে তিনি দলের নেত্রী পদে জয়ী হলেন। নানা ধরনের প্রতিকূলতা অবশ্যই ছিল। বিষয়টা অনেককেই অবাক করেছিল।

“তার জয়টা ছিল অভাবনীয়,” বলেছেন ক্যারোলাইন স্লোকক: “কনজারভেটিভ পার্টির মত রক্ষণশীল দল যে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রীর জন্য দরজা খুলে দেবে তা কেউ ভাবতে পারেনি। তার চারপাশে অনেক পুরুষ কিন্তু পরিস্থিতিটা মেনে নিতে পারেন নি, অনেকে তার নেতৃত্ব মানতে চান নি, অনেকেই ভেবেছিলেন ক্ষমতায় তিনি বেশিদিন টিকবেন না।”

সত্তরের দশকে শিক্ষামন্ত্রী হিসাবে বড়ধরনের ব্যয় সঙ্কোচন করে মিসেস থ্যাচার তখন ইতিমধ্যেই বিতর্কিত হয়ে উঠেছেন। এরপর ৭৯ সালে তার আমূল সংস্কারবাদী নীতি ব্রিটেনের মানুষকে দুই বিপরীত মেরুতে ভাগ করে ফেলল।

ব্রিটেনে তখন “অসন্তোষের হাওয়া” চারদিকে। বেকারত্ব বাড়ছে, ঘন ঘন বিদ্যুৎ সঙ্কট, একের পর এক ধর্মঘটে নাজেহাল দেশ। নানা কারণে দেশের মানুষ দ্বিধাবিভক্ত, ক্ষুব্ধ এবং তারা চাইছিল নতুন কিছু।

“মানুষ চাইছিল বড় ধরনের পরিবর্তন। মার্গারেট থ্যাচার জনগণের মনোভাব ধরতে পেরেছিলেন। তিনি শুধু যে একজন নারী ছিলেন তাই নয়, রক্ষণশীলতাকে তিনি একটা নতুন মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন।”

মিসেস থ্যাচার ক্ষমতায় আসার কয়েক বছরের মধ্যে ক্যারোলাইন তার পড়াশোনা শেষ করে সরকারি চাকরিতে ঢোকেন। ওই চাকরিতে তাকে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হতো। এসময় ক্যারোলাইন রীতিমত অবাক হয়ে যান যখন মার্গারেট থ্যাচারের ব্যক্তিগত সচিব হিসাবে তার নাম প্রস্তাব করা হয়।

“শুরুতে আমি বেশ ঘাবড়ে ছিলাম। জানতাম মিসেস থ্যাচার মেয়েদের সঙ্গে কাজ করতে ভালবাসেন না,” বলছিলেন ক্যারোলাইন।

“কিন্তু প্রথমদিন দেখা হওয়ার পর আমি বেশ অবাকই হয়েছিলাম। তিনি যখন সিঁড়ি দিয়ে নেমে আমার দিকে আসছেন, প্রথমেই চোখ পড়ল তার পায়ের দিকে- তার হিলতোলা জুতোর দিকে। তার হাতে ছিল ফুলদানিতে নীল রঙের ফুল। আমাকে বললেন- ‘ক্যারোলাইন তোমার জন্য ফুলগুলো নিয়ে এলাম- মনে হল তোমার ভাল লাগবে’। ব্যাপারটা আমায় বেশ মুগ্ধ করেছিল।”

ক্যারোলাইন বলছেন, মার্গারেট থ্যাচার সবসময় কাজ করেছেন পুরুষদের সঙ্গে।

“আমার ধারণা তিনি সব পুরুষের মধ্যে মাত্র একা নারী হয়ে থাকতে পছন্দ করতেন। তিনি নারীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পরিবেশে কাজ করতে অপছন্দ করতেন। কিন্তু যেখানে মেয়েরা তার থেকে কম ক্ষমতাশালী সেখানে মেয়েদের সঙ্গে তিনি বন্ধুসুলভ আচরণ করতেন। কাজেই নারী মাত্রই যে তিনি অপছন্দ করতেন বিষয়টা তা নয়।”

ক্যারোলাইন স্লোকক ছিলেন কোন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর প্রথম মহিলা ব্যক্তিগত সচিব।

“মার্গারেট থ্যাচারের সঙ্গে কাজ করতে আমার কোন সমস্যা হয়নি, তবে তার পুরুষ ব্যক্তিগত সচিব যারা ছিলেন, তাদের সঙ্গে কাজের ক্ষেত্রে তার যে সম্পর্ক ছিল, আমার সঙ্গে সেটা ছিল না।”

জনগণের সামনে তিনি নিজেকে একজন পুরুষ রাজনীতিবিদের মত করেই উপস্থাপন করতে চাইতেন- অবশ্য সেটা কিছুটা পুরুষ সহকর্মীদের পরামর্শেই, বলছেন ক্যারোলাইন, সেটা তিনি কণ্ঠে, পোশাকে প্রকাশের চেষ্টা করতেন। “যদিও অতটা কঠিন তিনি আসলেই ছিলেন না।”

অনেকেই তার উচ্চগ্রামে কথা বলার স্টাইলের সমালোচনা করতেন। কিন্তু ক্যারোলাইন বলছেন যখনই তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংসদে – হাউস অফ কমন্সে -গেছেন -তিনি দেখেছেন চারপাশে পুরুষ পরিবৃত পরিবেশে- মার্গারেট থ্যাচারকে তার বক্তব্য তুলে ধরার জন্য কীভাবে পুরুষদের ওপর গলা চড়িয়ে কথা বলতে হচ্ছে ।

“তবে আমি এটাও দেখেছি বক্তৃতা দেওয়ার আগে তিনি খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে প্রস্তুতি নিতেন, সব তথ্য রপ্ত করতেন যাতে কোথাও সামান্য ভুলত্রুটিও না হয়।”

সেটাই ছিল মিসেস থ্যাচারের কৌশল। পুরুষদের ছাপিয়ে একজন নারী হিসাবে নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি যে বিষয়ে কথা বলতেন তার খুঁটিনাটি সব রাখতেন নিজের নখদর্পণে। যাতে ঘরে যারা তার সঙ্গে আছেন, তাদের সবার থেকে বেশি জ্ঞান রাখেন তিনি।

“খুবই কর্মঠ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মার্গারেট থ্যাচার। তিনি একমাত্র মানুষ, যাকে দেখেছি হাতে হুইস্কির গেলাস নিয়ে একটা বাক্যের মাঝখানে ঘুমিয়ে পড়েছেন- তারপর জেগে উঠে সেই অসমাপ্ত বাক্যটা- যেখানে থেমেছিলেন সেখান থেকে আবার শুরু করছেন।”

মার্গারেট থ্যাচার পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন “আয়রন লেডি” – “লৌহ মানবী” নামে।

ট্রেড ইউনিয়নগুলোর মোকাবেলা করেছেন তিনি কঠিন হাতে, অজনপ্রিয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার করেছেন, সামরিক টাস্ক ফোর্স পাঠিয়েছেন দক্ষিণ আটলান্টিকে এবং সশস্ত্র গোষ্ঠি আর্য়াল্যাণ্ড রিপাব্লিকান আর্মির বোমা হামলা থেকে প্রাণে বেঁচেছেন।

থ্যাচার নীতির কারণে যারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন, আশির দশকে তারা থ্যাচারের পতনে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। এসময় আবাসিক এলাকার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পোল-ট্যাক্স নামে তিনি নতুন এক করব্যবস্থা চালু করলে লণ্ডনের রাস্তায় রাস্তায় শুরু হয় সহিংস বিক্ষোভ।

ক্রুদ্ধ জনতা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে চড়াও হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। সরকারের ভেতর কিছুটা একঘরে হয়ে পড়েন মার্গারেট থ্যাচার। একমাত্র তার দপ্তরে যারা কাজ করতেন তারাই তখন ছিলেন তার সমর্থক। এদের মধ্যে ছিলেন ক্যারোলাইন স্লোকক।

এ ঘটনার ফলশ্রুতিতে তার রাজনৈতিক জীবনে যবনিকা নেমে আসে। তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা এক এক করে সবাই তাকে পদত্যাগ করতে বলেন।

“তার পদত্যাগ ছিল একটা ঐতিহাসিক ঘটনা – সেই হিসাবে আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম,” বলছিলেন ক্যারোলাইন।

“তার পদত্যাগের ঘোষণা ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। পড়তে গিয়ে তার গলা কেঁপে গেল। তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। একজন মন্ত্রী বললেন – আপনাকে আর পড়তে হবে না। কিন্তু তিনি পুরোটা পড়ে শেষ করলেন। আর শেষ করার মুহূর্তে আমিও কেঁদে ফেলেছিলাম।”

মার্গারেট থ্যাচার রানির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে এসে যখন ডাউনিং স্ট্রিটে তার বাসভবন ছেড়ে বেরিয়ে যান তখন সেখানে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।

“তিনি হাঁটতে পারছিলেন না। তার দেহরক্ষীরা বুঝতে পারছিলেন না কী করবেন। মিসেস থ্যাচার এটাকে চরম একটা অপমান হিসাবে নিয়েছিলেন।”

“তার কাছে এটা ছিল মন্ত্রিসভার সদস্যদের দিক থেকে বিশ্বাসঘাতকতা, যা মেনে নেওয়া তার জন্য কঠিন হয়েছিল। যা কিছু তিনি অর্জন করেছিলেন, তার এধরনের সমাপ্তি তিনি আশা করেন নি,” বলছিলেন তার ব্যক্তিগত সচিব ক্যারোলাইন স্লোকক।

মার্গারেট থ্যাচারের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে ক্যারোলাইন একটি বই লিখেছেন – ‘পিপল্ লাইক আস- মার্গারেট থ্যাচার অ্যাণ্ড মি’।

এসএইচ-১২/০২/১৯ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্য সূত্র : বিবিসি)