ফারাক্কা বাঁধ এখন উত্তরাঞ্চল-পশ্চিবঙ্গের প্রধান দুঃখ

একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলসহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ অঞ্চলের প্রধান দুঃখ দাড়িয়েছে ফারাক্কা বাঁধ। প্রতি বছর ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার প্রায় ৪০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে অব্যাহত রয়েছে নদী ভাঙ্গন। আর উত্তরাঞ্চলের ১২টি জেলাও এ সমস্যায় আক্রান্ত। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে নদীর পাড় রক্ষা বাঁধ নির্মান করেও কোন লাভ হচ্ছেনা। ফলশ্রুতিতে ফারাক্কা এখন মরন ফাঁদ হয়ে দাড়িয়েছে বলে পদ্মা পাড়ে বসবাসরত মানুষের অভিযোগ। গত ৪২ বছরে পশ্চিমবঙ্গ অঞ্চলের ও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ঘরবাড়ি হারিয়েছে এই রকম পরিবারের সংখ্যা কয়েক লাখ। তবে এর সঠিক পরিসংখ্যান সংশ্লি­ষ্ট দপ্তরেও মেলেনা।

বাঁধ নির্মানের পর সত্তর দশকের শেষের দিক থেকে বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলসহ ভারতের পশ্চিম বঙ্গের লালগোলা, মালদহসহ পাশ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকায় নদী ভাঙ্গন শুরু হয়। প্রথম দিকে বিষয়টি তেমন ভাবে আমলে না নেয়ায় আজ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে বলে ভুক্তভোগিদের অভিযোগ। বিষয়টি নিয়ে ভারতেও চলছে দীর্ঘদিন থেকে আন্দোলন সংগ্রাম। কিন্ত এখনও তেমন কোন কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহন করেনি সরকার। ফলে নদী ভাঙ্গন অব্যাহত থাকায় ভূমিহীনের সংখ্যা বাড়ছে। এ ঘটনা কলকাতা হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়।

ফারাক্কা বাঁধের কারনে বাংলাদেশে পানি শূন্যতার কারনে এক চতুর্থাংশ উর্বর কৃষিজমি চাষাবাদের অনুপযোগি হয়ে পড়ছে। তিন কোটি মানুষের জীবনে পরিবেশগত বিপর্যয় নেমে আসে। কৃষি, মৎস, সেচ ও শিল্পখাতে আনুমানিক বছরে বাংলাদেশের ক্ষতি হচ্ছে ৫০কোটি ডলার।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ফারাক্কা বাঁধ গঙ্গা নদীর উপর অবস্থিত একটি বাঁধ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় এই বাঁধটি অবস্থিত। ১৯৬১ সালে এই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। সেই বছর ২১ এপ্রিল থেকে বাঁধ চালু হয়। ফারাক্কা বাঁধ ২ হজার ২৪০ মিটার (৭ হাজার ৩৫০ ফুট) লম্বা। যেটা প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার সহায়তায় বানানো হয়েছিল। বাঁধ থেকে ভাগীরথী-হুগলি নদী পর্যন্ত ফিডার খালটির দৈর্ঘ্য ২৫ মাইল (৪০ কি:মি:)। ফারাক্কা বাঁধ ভারত তৈরি করে কলকাতা বন্দরকে পলি জমা থেকে রক্ষা করার জন্য। তৎকালীন বিভিন্ন সমীক্ষায় বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেন যে গঙ্গা/পদ্মার মত বিশাল নদীর গতি বাঁধ দিয়ে বিঘ্নিত করলে নদীর উজান এবং ভাটি উভয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য মারাত্মকভাবে নষ্ট হতে পারে। এ ধরণের নেতিবাচক অভিমত সত্ত্বেও ভারত সরকার ফারাক্কায় গঙ্গার উপর বাঁধ নির্মাণ ও হুগলী-ভাগরথীতে সংযোগ দেয়ার জন্য ফিডার খাল খননের কাজ শুরু করে । পরবর্তীতে যা মূলত বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার রাজ্যে ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনে। এটি প্রায় ১৮ কি.মি লম্বা এবং মনহরপুরে অবস্থিত।

আজ সেই ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ১৯৭৬ সালে এই দিনে মরনফাঁদ ফারাক্কা ভেঙ্গে দাও, গুড়িয়ে দাও শ্লোগানের মাধ্যমে মরহুম মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ডাকে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের লাখো মানুষ সেদিন জড়ো হয়েছিলেন রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দানে। জনসভা শেষে ভারতের ফারাক্কা অভিমুখে লং মার্চ আন্তর্জাতিক বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। এর পরেও আজও এর সুষ্ঠু সমাধান হয়নি। বরং ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে আজ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় পানির আধার কমে যাচ্ছে।

দিনটি ছিল ১৬মে রোববার। দেশের মানুষ পায়ে হাটার কষ্ট, রাত যাপন আর খাবার সমস্যাকে স্বীকার করেই মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে এই দীর্ঘ পদযাত্রাকে মেনে নেয় সকলে হাসিমুখে। বিভিন্ন স্থানে যাত্রা বিরতী কালে খারারের সম্বল বলতে ছিল কোথাও চিড়া-মুড়ি, আর কোথাও সামান্য গুড়-পানি। খিচুড়ি ছিল দুপুরের একমাত্র খাবার। তাও উপচে পড়া ভীড়ের কারণে সে খাবার পাওয়া থেকেও বঞ্চিত হয়েছিল কেউ কেউ।

তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, এই লংমার্চ আরম্ভের পূর্বে মাওলানা ভাসানি মাদ্রাসা ময়দানে সকাল ১০ টা ১৫ মিনিটে মঞ্চে উপস্থিত হন। জনসমুদ্রে বক্তব্য রাখেন ১০ মিনিট। তার এই বক্তব্য কেবল জ্বালাময়ী ছিল না, তাতে ছিল দিক নির্দেশনাও। বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন আমরা আপোষে ফারাক্কা সমস্যার সমাধানে আগ্রহী। ভারত যদি আমাদের শান্তিপূর্ণ প্রস্তাবে সাড়া না দেয় বিশ্বের শান্তিকামী জনগনও ভারতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করবে। বক্তৃতা শেষে তিনি মিছিলের পুরোভাগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এ সময় তার সহচর হিসেবে ছিলেন মরহুম মশিউর রহমান যাদু মিয়া, কাজী জাফর আহমদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।

লং মার্চের মিছিলটি রাজশাহী কোট পৌছানো মাত্র শুরু হয় ধুলিঝড় আর মুষুলধারে শিলাবৃষ্টি। দুপুর ২টা মিছিলটি ১৮ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে মধ্যহ্ন বিরতী করে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর প্রেমতলীতে। সন্ধ্যা ৬ টায় মিছিল পৌঁছায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে। নবাবগঞ্জ সরকারী কলেজ মাঠে সমবেত জনতা বিশ্রাম নেয়। এ সময় জনতার উদ্যেশ্যে ভাসানী ঘোষণা করেন ভারত ফারাক্কা সমস্যার সমাধান না করলে তিনি ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলন শুরু করবেন। ফারাক্কা বাংলাদেশের জন্য অভিশাপ বলে জনতাকে জানান, এ বছর প্রায় ৩ শ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে স্বচক্ষে ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের দুরাবস্থা দেখারও আহবান জানান। রাত্রী যাপন করেন এখানেই।

পরদিন ১৭ মে সোমবার সকাল ৮ টায় লংমার্চ পুনরায় যাত্রা শুরু করে। মহানন্দা নদী পাড়ি দেবার জন্য নৌকা দিয়ে তৈরী করা হয়েছিল সেতু। বর্তমানে যেখানে বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতু রয়েছে। নদী পার হয়ে শিবগঞ্জ অতিক্রম করে বিকেল সোয়া ৪টায় মিছিল পৌছায় কানসাট গ্রামে। কানসাট হাই স্কুল মাঠে বিশাল জনসভায় সমাপনী ভাষন দেন তিনি। এই লং মার্চের ঐতিহাসিক ঘটনার ৬মাস পরেই মাওলানা ভাসানী ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর মার যান।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ব ও খনি বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, ফারাক্কার বাঁধের কারনে এ অঞ্চলের পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়ার পাশাপাশি তুলনামুলকভাবে বৃষ্টিপাত কমেছে। যার কারনে পুকুর, খালবিল শুকিয়ে গেছে। সেচ কাজে ভূগর্ভস্থের পানির ব্যবহার বেড়ে যাবার কারনে পানির স্তরও ক্রমশই নেমে যাচ্ছে। আর ভারত ফারাক্কার বাঁধের মাধ্যমে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় উত্তরাঞ্চলের খালবিল, নদীনালা, পুকুর, দিঘি এখন পানিশূণ্য হয়ে পড়েছে।

এসএইচ-০৭/১৬/১৯ (সুমন হাসান)