নাগরিকত্ব তালিকায় নাম না থাকায় আত্মহত্যা বাড়ছে!

আসামে ৪০ লাখ মানুষের ভারতীয় নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছে। রাজ্যটিকে অবৈধ অভিবাসীমুক্ত করার কর্মসূচীর আওতায় এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

এর ফলে প্রত্যাবাসনের মুখে পড়ার ভয়ে অনেকেই আত্মহত্যা করেছেন, এমনটা বলছেন ভুক্তভোগীদের স্বজন এবং অ্যাক্টিভিস্টরা।

গত মে মাসের কোন একদিন, ৮৮ বছর বয়সী আশরাফ আলি তার পরিবারের সদস্যদের বলেন যে, রোযা ভাঙার জন্য খাবার সংগ্রহ করতে যাচ্ছেন তিনি।

তার পরিবর্তে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।

এর আগে মি. আলি এবং তার পরিবারের সদস্যরা নিজেদের ভারতীয় প্রমাণ করতে সক্ষম হন এবং ভারতীয় নাগরিকদের একটি তালিকায় নামও তোলা হয় তাদের।

কিন্তু তার এক প্রতিবেশী এই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করেন।

আলিকে তলব করা হয় তার নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য।

যা না পারলে তাকে আটকের হুমকি দেয়া হয়।

“তিনি ভয় পাচ্ছিলেন যে তাকে আটকের পর একটি আটক কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হবে এবং চূড়ান্ত তালিকা থেকে তার নাম বাদ দেয়া হবে,” মোহাম্মদ ঘানি নামে তার এক গ্রামবাসী একথা বলেন।

দ্য ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস বা এনআরসি নামে পরিচিত এই তালিকাটি ১৯১৫ সালে তৈরি করা হয়েছিলো এটা জানতে যে, কারা জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিক এবং কারা প্রতিবেশী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে এসেছে।

এই প্রথমবারের মত ঐ তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে।

যাতে, যারা ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চ পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার আগে থেকেই নিজেদের আসামের বাসিন্দা প্রমাণ করতে পারে তাদেরকে ভারতের নাগরিক হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়।

ভারতের সরকারের দাবি, রাজ্যে অবৈধ অভিবাসী সনাক্ত করতে এই তালিকা দরকারি।

গত জুলাইতে সরকার চূড়ান্ত খসরা প্রস্তাব প্রকাশ করে যা অনুযায়ী আসামে বসবাসরত প্রায় ৪০ লাখ মানুষের নাম বাদ পড়ে, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই হিন্দু ও মুসলিম বাঙালি।

চলতি সপ্তাহের শুরুতে এক ঘোষণায় কর্তৃপক্ষ জানায়, গত বছরের এনআরসি তালিকাসহ আরও প্রায় এক লক্ষ বাসিন্দার নাম তালিকা থেকে বাদ পড়বে যাদেরকে আবারো নিজেদেরকে ভারতীয় নাগরিক প্রমাণ করতে হবে।

এদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ৩১ জুলাই এনআরসি’র চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের আগে নিজেদেরকে তালিকা থেকে বাদ দেয়ার বিরুদ্ধে আপিল করেছেন।

এই রেজিস্ট্রেশন কর্মসূচীর কারণে ১৯৮০’র দশক থেকেই দেশে বেশ কিছু ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা হয়েছে।

যারা নিয়মিতভাবেই বিদেশিদের “সন্দেহজনক ভোটার” এবং “অবৈধ অনুপ্রবেশকারী” হিসেবে সনাক্ত করে প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করে।

নাগরিকত্বের রেজিস্টার এবং এই ট্রাইব্যুনাল দুটোই আসামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক অভিযান পরিচালনায় মদদ দেবে কিনা এমন প্রশ্ন উঠেছে। ।

আসামের এই সংকটের মূলে রয়েছে একটি বিতর্ক যা বহিরাগতদের কথিত “অনুপ্রবেশকারী” হিসেবে গণ্য করাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে।

এই বিতর্ক আসামের আদিবাসী জনগোষ্ঠী এবং বাঙালি অভিবাসীদের মধ্যে জাতিগত দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে।

পরিবর্তনশীল জনসংখ্যার চিত্র, ভূমি এবং জীবিকার অভাব, রাজনৈতিক শক্তি হস্তগত করার প্রতিযোগিতা, কে নাগরিকত্ব পাবে – এমন সংকটে ঘি ঢেলেছে।

অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, ২০১৫ সালে নাগরিকত্বের তালিকা হালনাগাদ শুরু হওয়ার পর থেকে তালিকা থেকে বাদ পরে নাগরিকত্ব হারিয়ে আটক হওয়ার ভয়ে আত্মহত্যা করেছে অনেক বাঙালি মুসলিম ও হিন্দুরা।

“সিটিজেন ফর জাস্টিস এন্ড পিস” সংস্থার সংগঠক জমশের আলি এ ধরণের ৫১টি আত্মহত্যার তালিকা দিয়েছেন।

তিনি বলেন, নাগরিকত্ব হারানোর ভয় থেকে মানসিক আঘাত ও চাপের মধ্যে ছিলেন এসব মানুষ।

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে হালনাগাদ তালিকার প্রথম খসড়া প্রকাশিত হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।

আরেক অ্যাক্টিভিস্ট প্রসেনজিত বিশ্বাস এই তালিকাকে “মানবিক বিপর্যয়” বলে উল্লেখ করেছেন যা “প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারকে উপেক্ষা করে লাখ লাখ প্রকৃত নাগরিককে রাষ্ট্রহীন করেছে।”

আসামের পুলিশ এসব মৃত্যুকে অস্বাভাবিক বললেও প্রমাণের অভাবে এগুলোকে নাগরিকত্বের তালিকা হালনাগাদের সাথে সম্পর্কিত বলে স্বীকার করেনি।

গবেষক আব্দুল কালাম আজাদ ২০১৫ সালে তালিকা হালনাগাদ শুরু হওয়ার পর থেকে এসব আত্মহত্যার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে আসছেন।

“গত বছর তালিকার চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে,” তিনি দাবি করেন।

“এসব মানুষের স্বজনদের সাথে সাক্ষাৎ করেছি আমি। যারা আত্মহত্যা করেছেন তাদেরকে হয় সন্দেহজনক ভোটার ঘোষণা করা হয়েছে কিংবা তালিকা থেকে নাম বাদ দেয়া হয়েছে। এটা খুবই দু:খজনক,” তিনি বলেন।

রাইট অ্যাক্টিভিস্ট জমশের আলি বলেন, নিজের স্ত্রী মালেকা খাতুনের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়ায় গত নভেম্বরে আসামের বারপেতা জেলার ৪৬ বছর বয়সী সামসুল হক আত্মহত্যা করেন।

২০০৫ সালে মিস মালেকাকে সন্দেহজনক ভোটার বলে উল্লেখ করা হয়।

এবিষয়ে স্থানীয় ট্রাইব্যুনালের মামলায় মালেকা জয় পেলেও ভোটার তালিকা কিংবা এনআরসি-তে নাম তুলতে পারেননি তিনি।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরবর্তী প্রজন্মের উপরও প্রভাব ফেলে এনআরসি’র এই তালিকা।

চলতি বছরের মার্চে উদলগিরি জেলার ৪৯বছর বয়সী দিনমজুর ভাবেন দাস আত্মহত্যা করেন।

তার স্বজনরা জানান, আইনি প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের ঋণ শোধ করতে না পারায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় সে।

মিস্টার দাসের আইনজীবী তার নাম তালিকাভুক্ত করার আবেদন জানিয়ে মামলা করলেও জুলাই মাসে তালিকা থেকে তার নাম বাদ দেয়া হয়।

৩০ বছর আগে তার বাবাও আত্মহত্যা করেছিলো।

তাকেও নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণের নির্দেশ দিয়েছিলেন স্থানীয় ট্রাইব্যুনাল।

তবে তার মৃত্যুর কয়েক মাস পরে তাকে ভারতের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেন ট্রাইব্যুনাল।

খারুপেটিয়া শহরাঞ্চলের স্কুল শিক্ষক এবং আইনজীবী নিরোদ বরন দাস আত্মহত্যা করার পর তার বিছানার পাশ থেকে তিনটি কাগজ উদ্ধার করা হয়।

যার মধ্যে একটি ছিল এনআরসি তালিকা থেকে তার নাম বাদ দিয়ে তাকে বিদেশি ঘোষণা। অন্যগুলো ছিল হাতে লেখা একটি আত্মহত্যার নোট এবং তার স্ত্রীর প্রতি কিছু ছোট ঋণ শোধ করার আবেদন।

আত্মহত্যা করা নিরোদ বরণ দাসের ভাই অখিল চন্দ্র দাস বলেন “১৯৬৮ সালে স্থানীয় স্কুল থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর ওই স্কুলেই ৩০ বছর পাঠদান করেন। তার স্কুলের সার্টিফিকেট প্রমাণ করে যে তিনি বিদেশি নন।”

অখিল চন্দ্র দাস অভিযোগ করেন, তার ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য এনআরসি কর্তৃপক্ষ দায়ী।

সম্প্রতি ভারতীয় সাবেক সেনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ সানাউল্লাহকে সামনে নিয়ে আসে বিবিসি।

তাকে বিদেশি ঘোষণার পর ১১ দিন একটি বন্দী শিবিরে রাখা হয়েছিলো, যা জাতীয় পর্যায়ে নিন্দার ঝড় তোলে।

“ভারতের জন্য জীবন বাজি রেখেছি আমি। আমি ভারতীয় হয়েই থাকব। এই প্রক্রিয়া পুরোপুরি ভুল” মি. সানাউল্লাহ বলেন।

৩১শে জুলাইয়ের মধ্যে তাড়াতাড়ি তালিকা হালনাগাদের কাজ সেরে ফেলতে চাইছে আসাম রাজ্য সরকার।

যার কারণে হাজার হাজার বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ার ভয়ে রয়েছেন।

“এনআরসি’র খসড়া থেকে বাদ পড়া ৪০ লাখ মানুষের মধ্যে অর্ধেকই চূড়ান্ত তালিকায় জায়গা পাবে না” বলেন স্থানীয় আইনজীবী হাফিজ রশিদ চৌধুরী।

“তাদের ভবিষ্যৎ আসলেই অনিশ্চিত।”

এসএইচ-০৬/৩০/১৯ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্য সূত্র : বিবিসি)