দফায় দফায় সোনার দাম বৃদ্ধি নিয়ে যত প্রশ্ন

দেশে বাজেট প্রস্তাবের পরদিন থেকে দুই দফায় স্বর্ণের দাম বাড়ানো হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার থেকে প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ২ হাজার ৪১ টাকা করে বেড়েছে। ফলে বর্তমানে এক ভরি স্বর্ণের দাম ৫২ হাজার ১৯৬ টাকা। ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা তাসমিনা আহমেদ তার ছেলের বিয়ের আয়োজন করার পরিকল্পনা করছেন।

তিনি বলছেন, “গয়না না হলে আমাদের বিয়ে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আমি চাই আমার ছেলের বৌকে মাথার একটা তাজ, গলার হার, সীতা হার, হাতে চুড়ি- যতটুক দেয়া যায় ততটুকু দিয়ে সাজিয়ে আনবো।” বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়নি এখনও কিন্তু স্বর্ণের দাম বৃদ্ধি নিয়ে এখনই উদ্বিগ্ন তিনি।

বলছিলেন, “ইচ্ছা ছিল ছয় ভরি, তিন লাখ টাকার গয়না দিয়ে আমার ছেলের বৌকে আনবো। আমাদের ফ্যামিলিতে মিনিমাম ছয় ভরির সেট দিতেই হবে। যে হারে দাম বাড়ছে, আমি কি ছয় ভরি দিতে পারবো? আমাকে এখন ছোট হতে হবে। মানুষ এটা নিয়ে আড়ালে সমালোচনা করবে। আমার আত্মীয়দের সামনে আমি যদি সুন্দর করে ছেলেকে উপস্থাপন না করতে পারি তাহলে আমার কষ্ট হবে।”

স্বর্ণের গয়না বাংলাদেশের সমাজ ও পরিবারে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটি তাসমিনা আহমেদ কথাতেই বোঝা যায়। ফলে এর দাম বাড়লে বিশেষ করে মধ্যবিত্তের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়। এবছর জানুয়ারি মাসে দু’দফায় স্বর্ণের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি। আর বাজেট ঘোষণার পর থেকে দাম বাড়ানো হয়েছে আরও দুবার। একবার অবশ্য বাড়িয়ে আবার কমানোও হয়েছে।

কিন্তু সব মিলিয়ে বছরের শুরুতে যে স্বর্ণ ভরি প্রতি ৪৮ হাজার ৯৮৮ টাকায় কেনা যেত এখন সেটি কিনতে হচ্ছে ৫২ হাজার ১৯৬ টাকায়।

দেশ জুয়েলার্স সমিতির প্রেসিডেন্ট গঙ্গাচরণ মালাকার বলছেন, “আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম বেড়েছে। আমরা তো দুই হাজার টাকা বাড়িয়েছি। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে তো বাড়ছে আরও বেশি। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের হুমকি, ডলার পাউন্ডের দাম ওঠানামা করা, শেয়ারের দাম, এই সব মিলে ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে দাম বেড়েছে, কমলে কমে যাবে।”

কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে তার প্রভাব বাংলাদেশে কতটা পড়া উচিৎ সেনিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

দেশে দীর্ঘদিন ধরে স্বর্ণ আমদানি করা হয় না। দু’বছর আগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এক হিসেবে বলেছিল বাংলাদেশে স্বর্ণের চাহিদা বছরে প্রায় ৪০ মেট্রিক টন। বহু দিন ধরে অভিযোগ রয়েছে- চোরাচালান হয়ে আসা স্বর্ণের দিয়েই বাংলাদেশে স্বর্ণকারদের ব্যবসা পরিচালিত হয়।

তবে সামনেই স্বর্ণ আমদানির সুযোগ মিলতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদিত ডিলারদের মাধ্যমে স্বর্ণ আমদানির বিধান রেখে গত বছর একটি স্বর্ণ নীতিমালা অনুমোদন দিয়েছে সরকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক সায়মা হক বিদিশা বলছেন, তিনি এখন স্বর্ণের দাম বৃদ্ধির কোন যুক্তি দেখছেন না।

তিনি বলছেন, “এখন জিনিসটা বৈধ পথে আসার ব্যবস্থা হচ্ছে, সুতরাং কিছু হলেও স্বর্ণ প্রদর্শন করতে হবে। সুতরাং যেহেতু কিছু টাকা দিতে হবে সরকারকে, যত টাকা তাদের দিতে হবে তার চেয়েও কিন্তু বেশি হারে দাম বাড়ানো হচ্ছে।”

এভাবে দাম বাড়ানোর একটি অজুহাত তৈরি করা হচ্ছে বলে তিনি মনে করছেন। দেশে স্বর্ণ ব্যবসার উপর সেই অর্থে সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ এতদিন ছিল না। দেশে কি পরিমাণে স্বর্ণ রয়েছে তার কোন সঠিক হিসেব তাদের কাছে নেই।

সম্প্রতি একটি মেলার আয়োজন করে নির্দিষ্ট করের বিনিময়ে অপ্রদর্শিত স্বর্ণকে বৈধ করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। বিদেশ থেকে স্বর্ণ আনার শুল্কও কমানো হয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মফিজুল ইসলাম বলছেন, “যদি আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম বাড়ে, তারা স্বর্ণের দাম বাড়াতে পারে। এবং সেক্ষেত্রে আমাদের কাছ থেকে তাদের অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন নেই।”

তবে তিনি বলছেন, সরকার এই খাতের উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, “কী পরিমাণ স্বর্ণ আমাদের দেশে আছে আমরা কিন্তু সেটার হিসাব পাচ্ছি না। বর্তমান স্বর্ণ নীতিমালায় আমরা একটা সুযোগ করে দিয়েছি যে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের কাছে কী পরিমাণ স্বর্ণ আছে এটি যেন তারা ডিক্লেয়ার করে। অলরেডি তারা তা করেছে এবং আমার জানা মতে প্রায় দুইশত কোটি টাকার রাজস্ব আমরা পেয়েছি।”

তিনি আরও বলছেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ডিলার নিয়োগ করে যদি আমরা স্বর্ণ আমদানি করতে পারি তখন কিন্তু আমাদের কাছে একটা হিসাব থাকবে যে কি পরিমাণ স্বর্ণ তাদের কাছে আছে। বা ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে দাম বাড়লে, আমাদের এখানে কী করা উচিৎ, যেহেতু স্বর্ণের হিসাব থাকবে, তখন আমরা একটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবো।”

কিন্তু তাতেও উদ্বেগ কমছে না তাসমিনা আহমেদের মতো অনেকের। আর নতুন করে নেওয়া সরকারের নানা উদ্যোগ এই খাতে কতোটা স্বচ্ছতা নিয়ে আসবে এনিয়ে সন্দেহ রয়েই গেছে।

এসএইচ-০৫/০৬/১৯ (শাহনাজ পারভীন, বিবিসি)