রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করা হবে শিগগীরই

বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তার জন্য গঠিত রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের একটি তালিকা কিছুদিনের মধ্যেই প্রকাশ করা হবে, বলছে সরকার।

“বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতাকারী রাজাকারদের নাম, পরিচয় এবং ভূমিকা সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে জানানোর তাগিদ থেকেই এই সরকারি উদ্যোগ” – বলছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।

তিনি বলেন, রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের তালিকা সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ছিল, সেগুলো সংগ্রহ করে এখন তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে।

দেশের স্বাধীনতা লাভের ৪৮ বছরের দ্বারপ্রান্তে এসে রাজাকারদের তালিকা প্রকাশের এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু এত বছর পর কিভাবে এই তালিকা করা হচ্ছে, এমন প্রশ্ন উঠতে পারে।

সরকার বলছে, এ প্রশ্নটি বিবেচনায় নেয়া হয়েছে, এবং নতুন করে কোন তালিকা করা হচ্ছে না।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, নতুন কোন তালিকা হচ্ছে না। বরং রাজাকার বাহিনীর সদস্য হিসেবে যারা ভাতা নিয়েছেন বা যাদের নামে অস্ত্র এসেছে, তাদের নাম পরিচয় এবং ভূমিকাসহ রেকর্ড বা তালিকা সেই ৭১ সালেই জেলাসহ স্থানীয় প্রশাসন এবং পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ছিল।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সেই রেকর্ড সংগ্রহ করে রাজাকারদের তালিকাটি করা হয়েছে বলে মন্ত্রী হক উল্লেখ করেছেন।

“১৯৭১ সারে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর যারা সহযোগী ছিল, রাজাকার হিসেবে যাদের নামে অস্ত্র ইস্যু করেছিল পাকিস্তান বাহিনী। এছাড়া যারা ভাতা পেতো এবং রাজাকার হিসেবে তাদের পরিচয় পত্রও দিয়েছিল পাকিস্তান সরকার। সেই ব্যক্তিদের তালিকা সরকারের কাছে সংরক্ষিত যা আছে, তা আমরা প্রকাশ করবো” – বলেন তিনি।

“নতুনভাবে রাজাকারের কোন তালিকা আমরা প্রকাশ করছি না। ৭১ সালে যে তালিকা ছিল, সেটাই আমরা সংগ্রহ করেছি। তবে কিছু এলাকার তালিকা পাওয়া যায়নি। সেগুলো তারা ধ্বংস করেছিল। যেটুক পাওয়া গেছে, সেটাই আমরা অচিরেই প্রকাশ করতে যাচ্ছি।”

তিনি জানিয়েছেন, যে এলাকাগুলোতে রাজাকারদের তালিকা নষ্ট করে ফেলা হয়েছে, সেই এলাকাগুলোতে স্থানীয়ভাবে তথ্য সংগ্রহ করে কোন তালিকা করা যায় কিনা, সে ব্যাপারে সরকারের মধ্যে আলোচনা রয়েছে এবং এ ব্যাপারে পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

এখন এই সংগ্রহ করা তালিকায় কোন কোন এলাকার কতজন রাজাকারের নাম পরিচয় রয়েছে, মন্ত্রী তালিকা প্রকাশের আগে এ মুহুর্তে তা জানাতে রাজি নন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণাকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিংস এর প্রধান এম হাসান বলছিলেন, প্রায় ৫০ হাজারের মতো রাজাকার ছিল, গবেষণা করে তারা এ সংখ্যা পেয়েছেন।

হাসান বলেন, “প্রায় ৫০ হাজারের মতো রাজাকার ছিল। এটা জেনারেল নিয়াজী তার বইয়েও লিখেছে। তার মধ্যে ৩৭ হাজার রাজাকার এবং স্বাধীনতা বিরোধীকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট অর্ডারের একটি ধারার আওতায় ঐ রাজাকারদের তালিকার একটি গেজেট করা হয়েছিল। সেই তালিকা প্রকাশ করে এখন গুরুতর অপরাধীদের বিচার করা উচিত।”

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর ৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শীর্ষ স্থানীয়দের বিচার করেছে। সেই বিচার প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত রয়েছে। এখন রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করা হলে তাদের আইনের আওতায় নেয়ার কোন চিন্তা কি সরকার করছে-মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, এটি সরকার আলোচনা করে পরে সিদ্ধান্ত নেবে।

“আমরা শুধু বলি রাজাকার। কিন্তু কে ছিল সেই রাজাকার? ইতিহাসের স্বার্থে সেটা জাতির জানা দরকার” – বলেন তিনি।

“কারা বিরোধিতা করেছিল, কি ভূমিকা ছিল, এসব প্রশ্ন আছে। একটা ছিল মৌখিকভাবে আরেকটা ছিল সক্রিয়ভাবে। যারা ভাতা নিয়েছে এবং যাদের নামে অস্ত্র এসেছে, তারা গর্হিত কর্মকান্ড করেছে যেমন হত্যা, লুট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি, তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা উচিত। সেটা পরে বিবেচনা করা হবে।”

স্বাধীনতা বিরোধীদের তালিকা করার ক্ষেত্রেই আইনগত কোন ভিত্তি প্রয়োজন কিনা, সেই বিষয়ে দুই ধরণের মত সরকারের মধ্যে এসেছে। তবে এ নিয়ে কোন প্রশ্ন যেন না থাকে – সেজন্য সরকার মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন সংশোধন করে তাতে বিষয়টি যুক্ত করার জন্য এর খসড়া তৈরি করেছে বলেও মন্ত্রী হক জানিয়েছেন।

কিন্তু এই রাজাকার বাহিনী কিভাবে গঠিত হয়েছিল এবং এর সদস্যদের ভূমিকাই বা কি ছিল — এ নিয়েও গবেষণা করেছেন এম হাসান। তিনি বলছিলেন, ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে অনানুষ্ঠানিকভাবে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হচ্ছিল এবং সেপ্টেম্বরে তা পাকিস্তানী বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছিল।

“ঐ সময় গ্রামে-গঞ্জে বেসিক ডেমোক্রেসী মেম্বার ছিল, তাদেরকে রাজাকার বাহিনীতে লোক সংগ্রহ করতে বলা হয়েছিল। গ্রামের এসব মেম্বার এবং বিভিন্ন দলসহ যেমন জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ, জামাতে ওলামা, কনভেনশন মুসলিম লীগ – পাকিস্তানের সমর্থক এমন অনেক দল ঐ রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়।”

“শাহ আজিজ, গোলাম আযম, সবুর খান, আয়েনউদ্দিনসহ ইসলামী দলগুলোর নেতারা রাজাকার বাহিনীর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তবে সবকিছুর পিছনে পাকিস্তানের গোয়েন্দা বাহিনী এবং তাদের জেনারেলরা সরাসরি রাজাকার বাহিনী তৈরি করেছিল।

রাজাকার ছাড়াও স্বাধীনতা বিরোধী আল-বদর, আল-শামস এবং শান্তি কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠন ছিল, বাকি সংগঠগুলোর সদস্যদের তালিকাও পর্যায়ক্রমে প্রকাশের উদ্যোগ রয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।

এসএইচ-০৭/১১/১৯ (কাদির কল্লোল, বিবিসি)