ডেঙ্গুর পর ‘জিকা’র ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

এডিস মশা থেকে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া হয় সে তথ্য এখন অনেকেরই জানা। কিন্তু এই মশা আরও যে মারাত্মক রোগের জীবাণু বহন করে, সেটি হল জিকা।

অথচ মানবদেহে জিকা শনাক্ত করার কোন ধরনের ব্যবস্থা বাংলাদেশের হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে একেবারেই নেই। শুধুমাত্র সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট-এ জিকা শনাক্ত করার ব্যবস্থা রয়েছে।

ব্রাজিলে জিকার প্রাদুর্ভাবকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি জনস্বাস্থ্য বিষয়ক জরুরি অবস্থা হিসেবে ঘোষণা করেছিলো।

এখন জিকা চলে এসেছে বাংলাদেশের ঘরের কাছেই ভারত পর্যন্ত।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে জিকা সংক্রমণের বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে নেপালও।

ডেঙ্গুজ্বরের ব্যাপক প্রাদুর্ভাবের বিষয়ে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ গত কয়েক মাস ধরে সজাগ। কিন্তু বাংলাদেশ জিকা সম্পর্কে কতটা প্রস্তুত?

বছর দুয়েক আগে দেশের সিলেটে একবার জিকা ভাইরাসের নমুনা পাওয়া গিয়েছিলো।

জিকা ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয়েছিলো উগান্ডায় ১৯৪৭ সালে এক ধরনের বানরের শরীরে।

মানবদেহে এটি প্রথম শনাক্ত হয়েছিলো নাইজেরিয়াতে ১৯৫৪ সালে।

এরপর আফ্রিকা সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের কিছু দ্বীপে এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেখা দেয়।

এর সবচাইতে বড় প্রাদুর্ভাব হয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে ২০১৫ সালে।

এর লক্ষণগুলো দেখে সাধারণভাবে একে খুব ভয়াবহ মনে করেনি অনেকে।

এর লক্ষণগুলো হল হালকা জ্বর, চোখে ব্যথা ও লালচে রঙ, মাথা ব্যথা, গিঁটে গিঁটে ব্যথা এবং শরীরে র‍্যাশ।

কিন্তু পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন এই রোগ সম্পর্কে যা মনে করা হচ্ছে, মশা-বাহিত জিকা ভাইরাস তার চেয়েও অনেক বেশি ভয়ানক।

এর ফলে স্নায়ু বিকল হয়ে যেতে পারে যাতে অস্থায়ী পক্ষাঘাত দেখা দিতে পারে।

কিন্তু জিকার সবচেয়ে ভয়াবহ একটি বিষয় হল গর্ভবতী নারী যদি এতে আক্রান্ত হন হবে তার শিশু মাইক্রোসেফালিতে আক্রান্ত হতে পারেন।

এতে শিশুর মাথা ছোট হয়। অর্থাৎ তাদের মস্তিষ্ক সঠিক আকারের হয় না বা মস্তিষ্কের সঠিক বৃদ্ধি হয় না।

এমন শিশুদের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হওয়ার অথবা দেরিতে বেড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে।

জিকার কারণে ২০১৫ ও ১৬ সালের দিকে ব্রাজিলে চার হাজারের মতো শিশু এমন সমস্যা নিয়ে জন্মেছে।

দেশের শহর ছাড়িয়ে এডিস মশার দুটি প্রজাতিই সারা দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে বলে সরকারি তথ্যেই পাওয়া যায়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্বের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলছেন, “বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি শহরে এডিস মশার যে ঘনত্ব রয়েছে তা অনেক বেশি। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার সাথে কোনভাবে যদি এই ভাইরাসটা বাংলাদেশে চলে আসে তাহলে কিন্তু এটা আমাদের দেশে ভয়ংকর আকার ধারণ করতে পারে।”

তিনি বলছেন, “পাশের দেশ নেপাল, ভারত ও মিয়ানমারে যদি জিকা পৌঁছে যায় তাহলে বাংলাদেশ বড় মাত্রার ঝুঁকিতে থাকবে।”

তিনি বলছেন, এডিসের দুটি প্রজাতির মধ্যে “এডিস ইজিপটাই” শহরে বেশি পাওয়া গেছে।

কিন্তু অন্য প্রজাতি “এডিস অ্যলবোপিক্টাস” সারা বাংলাদেশের গ্রামে পাওয়া গেছে। এই দুটি প্রজাতিই ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকার জীবাণু বহন করে।

যেসব দেশে অতিমাত্রায় ঠাণ্ডা বা বরফ বেশি সে দেশগুলো ছাড়াই এডিসে মশার বিস্তার সারা দেশে বলে বলেছন জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন।

তিনি বলছেন, “বিশ্বব্যাপী মানুষ এখন যেভাবে ভ্রমণ করে, ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য যে পরিমাণে যাতায়াত বেড়েছে তাতে জিকা সংক্রমণ নিয়েও অনেকে চলে আসতে পারেন। আর মশার তো সীমান্তে কোন বাধা নেই। ডেঙ্গু সম্পর্কিত ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ছড়িয়ে পড়া এডিস বিভিন্ন দেশে যাওয়ার অন্যতম কারণ।”

তিনি বলছেন, যেখানে এডিস আছে সেখানেই এডিস বাহিত রোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

যেহেতু বাংলাদেশের খুব কাছেই পৌঁছে গেছে জিকা, তাই সেটি বাংলাদেশে চলে আসারও সম্ভাবনা রয়েছে।

প্রথম ২০০০ সালে খুব বড় ধরনের ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হয়েছিলো।

তিনি বলছেন, মশা নিধন ও মশার বিস্তার রোধ অন্যতম উপায় হলেও এটি প্রতিরোধ করতে আরও কিছু ব্যবস্থা নেয়ার সময় এসেছে।

তিনি বলছেন, “বিমানবন্দরের মতো জায়গায় এটির স্ক্রিনিং খুব জরুরি। যাতে করে জিকা আক্রান্ত কোন ব্যক্তি যেন প্রবেশ করতে না পারে। এজন্য আমাদের বিমানবন্দরগুলোতে জিকা পরীক্ষার সক্ষমতা থাকতে হবে। অন্তত এডিসের মৌসুমে জিকাকেও মাথায় রাখতে হবে।”

“যে সকল দেশে জিকার প্রকোপ রয়েছে সেসব দেশ থেকে এডিসের মৌসুমে যদি বাংলাদেশে কেউ আসেন তাহলে নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ তাকে অন্য মশা কামড়ালে সেই মশাও জিকা বহন করবে ও অন্যদের আক্রান্ত করবে।”

তার তথ্যমতে মেশিনে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে যতটুকু সময় লাগে, রক্ত দিয়ে জিকা পরীক্ষায় সেরকমই মিনিট খানেক লাগে। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে যেভাবে এডিস ছড়িয়েছে তাতে হাসপাতালগুলোতে এটি পরীক্ষার যন্ত্রপাতি এখুনি আনা দরকার বলে তিনি বলছেন।

মানবদেহে জিকা শনাক্ত করার কোন ধরনের ব্যবস্থা বাংলাদেশের হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে নেই।

২০১৫ সালের দিকে ব্রাজিলে জিকার ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব দেখে দিয়েছিলো। তখন ঢাকায় বিমানবন্দরে জিকা শনাক্ত করার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো।

কিন্তু সেই প্রক্রিয়া এখনো চলমান আছে কিনা সেটি পরিষ্কার নয়।

কাছাকাছি সময়ে নেপাল বা ভারত থেকে ভ্রমণ করে যারা এসেছেন তারা এমন কোন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়নি বলে জানিয়েছেন।

যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার প্রধান ড. সানিয়া তাহমিনা বলছেন, “জিকার ব্যাপারে আসলে উচ্চ মহল থেকেই আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। যে দেশে এডিস আছে সেদেশে এর ঝুঁকি আছে আমরা জানি। আমরা জানি যদি আমরা এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি তাহলে এর দ্বারা বহন করা কোন অসুখই হবে না।”

তিনি দাবি করছেন বিমানবন্দরে এর পরীক্ষা করা হচ্ছে। বছরে চারবার মশা জরিপ হয়।

তিনি বলছেন, “সরকারের উচ্চ পর্যায়ে জানানো হয়েছে যে এখন থেকে ব্যবস্থা না নিলে পরবর্তীতে জিকাও ডেঙ্গুর মতো ছড়াতে পারে।”

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলছেন, “আমরা চারটি হাসপাতাল থেকে নিয়মিত রোগীদের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করছি। সেগুলোর তিন রকম পরীক্ষা হয়। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা। এছাড়া মাইক্রোসেফালিতে আক্রান্ত শিশুদের উপর সারভেইল্যান্সের প্রস্তুতি চলছে যাতে আমরা জানতে পারি তারা জিকায় আক্রান্ত হয়েছে কিনা।”

এসএইচ-০৪/১৯/১৯ (শাহনাজ পারভীন,বিবিসি)