যুবলীগ নেতা সম্রাট ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেন যেভাবে

দেশে ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের শুরু থেকেই আলোচিত যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে অবৈধভাবে ক্যাঙ্গারুর চামড়া রাখার অভিযোগে মামলায় ভ্রাম্যমাণ আদালতে ছয় মাসের কারাদন্ড দিয়ে জেলে পাঠানো হয়েছে।

রোববার ভোরারাতে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে গ্রেফতারের পর তাকে সেইদিনই ঢাকায় এনে র‍্যাব তার ব্যক্তিগত কার্যালয় এবং দুই বাসভবনে একযোগে তল্লাশি চালিয়েছে।

র‍্যাব জানিয়েছে, চৌধুরীর কার্যালয়ে তল্লাশি চালিয়ে অবৈধ অস্ত্র, মাদক এবং ক্যাঙ্গারুর চামড়া উদ্ধার করা হয়েছে। অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী রাখার অভিযোগেই এখন তার ছয় মাসের জেল হয়েছে।

এছাড়া তার বিরুদ্ধে ক্যাসিনো বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে।

যুবলীগের এই নেতার প্রভাবশালী কারও সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না – এতদিন এমন অনেক গুঞ্জন ছিল।

বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক বনে যাওয়া যুবলীগের এই নেতার উত্থান বা ক্ষমতার উৎস কী – এই প্রশ্ন খোদ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেই রয়েছে।

ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের শুরুর দিকে যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ঢাকার কাকরাইল এলাকায় তার ব্যক্তিগত কার্যালয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন কয়েকশ’ সমর্থকের পাহারায়।

সেই অবস্থানের মাধ্যমে তার পক্ষ থেকে অভিযানের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শক্তি দেখিয়ে একটা জানান দেয়ার চেষ্টা ছিল বলে যুবলীগেরই অনেকে মনে করেন।

কিন্তু তিন দিন পর তার সমর্থকরা লাপাত্তা হয়ে যান। তখন থেকে সেই যুবলীগ নেতারও খোঁজ মিলছিল না।

তাকে ঘিরে জন্ম নিতে থাকে নানা আলোচনা। আওয়ামী লীগ বা সরকারের প্রভাবশালী কারও সাথে তার সম্পর্ক আছে কিনা, তাকে গ্রেফতার করা যাবে কিনা – এমন অনেক প্রশ্ন ওঠে।

এরসাথে এমন জল্পনাও ছিল যে, তাকে ধরে রাখা হতে পারে, সময় বুঝে র‍্যাব ঘোষণা দিতে পারে।

অবশেষে ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরুর দুই সপ্তাহ পর তাকে গ্রেফতারের কথা জানানো হলো। র‍্যাবের মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, চলমান অভিযানে আলোচনা শীর্ষে থাকা যুবলীগ নেতাকে গ্রেফতার করা গেছে, এটাই গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মনে করেন।

“এর পেছনে কী ড্রামা আছে-এই ড্রামা না বলে বরং দিন শেষে আমরা ক্যাসিনো নিয়ে সবচেয়ে বেশি অভিযোগের তীর যার দিকে ছোঁড়া হচ্ছিল, তাকে গ্রেফতার করা গেছে এটাই স্যাটিসফেকশন বা সন্তুষ্টির বিষয়।”

জেনারেল এরশাদের আমলে কোন রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন না ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট।

কিন্তু সে সময় এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে বিরোধীদলগুলোর হরতাল অবরোধে তিনি মতিঝিল এলাকায় পিকেটিংয়ে নামতেন।

মতিঝিল রমনা এলাকা থেকেই তার উত্থান শুরু।

আশির দশকের শেষ দিকে যুবলীগের কয়েকজনের সাথে পরিচয় হলে তিনি সংগঠনটির সাথে যুক্ত হন।

তবে দুই যুগ আগেও ইসমাঈল হোসেন চৌধুরী সম্রাট যুবলীগে সাধারণ একজন ওয়ার্ড নেতা ছিলেন।

তিনি ১৯৯৩ সালে ঢাকার ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। সে সময় যুবলীগের চেয়ারম্যান ছিলেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম।

ওয়ার্ডের নেতা থাকার সময় থেকেই তিনি বেপোরোয়া হয়ে উঠেছিলেন বলে সংগঠনটির একজন নেতা জানিয়েছেন।

২০০৩ সালে মি. সম্রাট ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন।

যুবলীগের বর্তমান নেতা ওমর ফারুক চৌধুরী যুবলীগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান ২০১২ সালে।

এরপর ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট যুবলীগের ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি হন।

যুবলীগের একজন নেতা জানিয়েছেন, বছরের পর বছর ধরে ঢাকা সিটি করপোরেশনের টেন্ডার যারা নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাদের মধ্যে চৌধুরী অন্যতম।

এখন তার বিরুদ্ধে ক্যাসিনো বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলেছে র‍্যাব।

যুবলীগের একজন নেতা হিসেবে প্রভাব খাটিয়েই ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট বিপুল সম্পদের মালিক হন এবং তিনি টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি এবং সর্বশেষ ক্যাসিনো বাণিজ্যসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন – যুবলীগের অনেক নেতাই এখন এসব অভিযোগ তুলে ধরছেন।

তবে এতদিন নানা জল্পনা-কল্পনার পরও তাকে গ্রেফতারের ঘোষণা আসার পরই যুবলীগ থেকে তাকে বহিস্কার করা হয়। এই বিলম্বের ব্যাপারে সংগঠনটির নেতৃত্ব কোন ব্যাখ্যা দেয়নি।

সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদ বলেছেন, চৌধুরীর রাজনৈতিক কর্মকান্ড ছাড়া ব্যক্তিগত বিষয়ে আগে তাদের কিছুই জানা ছিল না।

এই প্রশ্ন রয়েছে খোদ আওয়ামী লীগের মধ্যে।

দলটির অনেক নেতা বলেছেন, যুবলীগ বা সহযোগী সংগঠনগুলোই নয়। তাদের মুল দলই ভাবমূর্তির সংকটে পড়েছে। সেজন্য পেছনে কেউ থাকলে তাকেও খুঁজে বের করা উচিত বলে তারা মনে করেন।

চলমান অভিযানে যুবলীগের কয়েকজন গ্রেফতার হওয়ার পর আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের নাম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবায়দা নাসরীন বলছিলেন, মানুষের আস্থা আরও বাড়াতে এখন এই যুবলীগ নেতার ক্ষমতার পেছনে রাঘব বোয়াল কেউ আছে কিনা, তাদের চিহ্নিত করেও ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

“মানুষের অবিশ্বাসের জায়গা সরকার বুঝতে পেরেছে বলে মনে হয়। সেকারণে আজ সম্রাটকে গ্রেফতারের বিষয় প্রকাশ করা হযেছে বা গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু এরকম সম্রাট হয়তো আরও আছে। এর পেছনেও লোক আছে। তাদেরকেও ধরা উচিত।”

দলটির সিনিয়র নেতা এবং মন্ত্রী ড: আব্দুর রাজ্জাক বলছিলেন, ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের বেপোরোয়া কর্মকান্ড নিয়ে তাদের নেত্রী দীর্ঘ সময় ধরে খোজ নিয়ে ব্যবস্থা নিয়েছেন। এখানে কোন সন্দেহ বা প্রশ্নের সুযোগ নেই বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।

“এক বছর আগেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সম্রাটের ব্যাপারে সজাগ থাকার জন্য। প্রধানমন্ত্রী বেশ কিছুদিন যাবতই এটি ওয়াচ করছিলেন। আমাদের বৈঠকে উনি সুপরিকল্পিতভাবে বিষয়টি নেতাদের জানাতে চেয়েছিলেন বলে আমার কাছে মনে হযেছে। সেই বৈঠকে তিনি কঠোর অবস্থান তুলে ধরেছিলেন।”

ড: রাজ্জাক আরও বলেছেন, “আমি এ ব্যাপারে একদমই নিশ্চিত ছিলাম যে, সম্রাটকে ধরা হয়েছে বা ধরা হবে-এটা আইন মৃঙ্খলা বাহিনী বা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরের মধ্যেই আছে।তার আর পালাবার কোন সুযোগ নাই।”

তবে আওয়ামী লীগের এই নেতা দাবি করেন, তাদের দলে বা সহযোগী সংগঠনগুলোতে সম্রাটের পৃষ্ঠপোষক কেউ নেই এবং সম্রাটের মতও আর কেউ নেই।

এসএইচ-০৭/০৭/১৯ (কাদির কল্লোল, বিবিসি)