অল্পবয়সী মেয়েদের উপভোগের জন্য বিয়ে দেয়া হয়

ইরাকের ধর্মীয় নেতারা অল্প বয়সী মেয়েদের দেহ-ব্যবসার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, বিবিসি আরবি নিউজ শিয়া সম্প্রদায়ের অস্থায়ী বিয়ে প্রথার ওপর অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে এমন তথ্য পায়; যেখানে মেয়েদের সাময়িক সময়ের জন্য উপভোগ করতে বিয়ে দেয়া হয়।

ইরাকের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মাজারের আশপাশে ধর্মীয় নেতাদের দ্বারা পরিচালিত কাজী অফিসগুলোয় গোপন অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে, বেশিরভাগ ধর্মীয় নেতা স্বেচ্ছায় খুব স্বল্প সময়ের জন্য মাঝে মাঝে মাত্র এক ঘণ্টার জন্য উপভোগের জন্য বিয়ে দিয়ে থাকে যেন যৌনমিলনকে বৈধতা দেয়া যায়।

কেউ কেউ ৯ বছরের কম বয়সী মেয়েদেরও এই অস্থায়ী বিয়ের জন্য স্বেচ্ছায় সরবরাহ করেছে। তারা এই উপভোগের বিয়ের জন্য কনে হিসাবে নারী, এমনকি এবং অল্প বয়সী মেয়েদের সরবরাহ করার প্রস্তাবও দিয়েছিল।

প্রামাণ্যচিত্রে বলা হয়েছে, ধর্মীয় নেতারা শিশুদের যৌন নির্যাতনকে আশীর্বাদ জানানোর মাধ্যমে দালাল হিসেবে কাজ করছে।

উপভোগের জন্য বিবাহ; নিকাহ মুত’আহ – একটি বিতর্কিত ধর্মীয় রীতি যা শিয়া মুসলমানরা অস্থায়ী বিয়ের জন্য ব্যবহার করে। এর বিপরীতে নারীদের অর্থ প্রদান করা হয়। সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোয় তথাকথিত মিসিয়াহ বিয়ে একই ধরনের কাজ সম্পাদন করে।

মূলত এই প্রথায়, একজন পুরুষকে ভ্রমণের সময় তার স্ত্রীকে সঙ্গে রাখার অনুমতি দেয়া হয়েছে। তবে আজকাল এই প্রথাটি ব্যবহার করা হচ্ছে নারী ও পুরুষকে সীমিত সময়ের জন্য যৌন মিলনের অনুমতি দিতে। এই অনুশীলনটি মুসলমান পণ্ডিতদের মধ্যে বিভক্তির সৃষ্টি করেছে।

কারও কারও মতে এর মাধ্যমে পতিতাবৃত্তিকে বৈধতা দেয়া হয়েছে এবং বিবাহ কীভাবে স্বল্পমেয়াদী হতে পারে তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।

বিবিসির ইরাকি ও ব্রিটিশ দল বিষয়টি নিয়ে ১১ মাস অনুসন্ধান চালিয়ে, ধর্মীয় নেতাদের ছবি গোপনে ক্যামেরায় ধারণ করে, যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীদের সাথে যোগাযোগ করে, পাশাপাশি সেইসব পুরুষদের সাথে কথা বলে যারা অস্থায়ী বিয়ের জন্য নারীদের পেতে ধর্মীয় নেতাদের টাকা দিতো।

১৫ বছরের যুদ্ধের পরে, আনুমানিক ১০ লাখ ইরাকি নারী বিধবা হয়ে পড়েন এবং আরও অনেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে যান বলে ধারণা করা হয়। বিবিসির দল জানতে পেরেছে যে দারিদ্র্যের কারণে অনেক নারী এবং মেয়েরা এই অস্থায়ী আনন্দ বিবাহ প্রথায় প্রবেশ করছেন।

ডকুমেন্টারি দলটি প্রমাণ পেয়েছিল যে ইরাকের পবিত্রতম দুটি মাজার অঞ্চলে অস্থায়ী বিবাহ ব্যাপকভাবে প্রচলিত।উদাহরণস্বরূপ, বাগদাদে শিয়া মুসলমানদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাজার কাদিমিয়ায় ১০ জন ধর্মীয় নেতার সঙ্গে তারা কথা বলেছিলেন।

তাদের মধ্যে আটজন বলেছেন যে তারা অস্থায়ী বিয়ের ব্যবস্থা করবেন; পাঁচজন বলেছেন যে তারা ১২-১৩ বছর বয়সের একটি মেয়ের সাথে অস্থায়ী বিয়ে করাবেন। বিশ্বের বৃহত্তম শিয়া তীর্থস্থান কারবালায় বিবিসির এই দলটি চারজন ধর্মীয় নেতার কাছে যান।

তাদের মধ্যে দু’জন অল্প বয়সী মেয়েদের সাথে অস্থায়ী বিয়ে করাতে রাজি হন। চারজন আলেমকে গোপনে ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছিল। তিনজন বলেছেন, তারা নারী সরবরাহ করবে, আর চারজনের মধ্যে দুজন বলেছেন যে তারা অল্প বয়সী মেয়ে সরবরাহ করবে।

বাগদাদের একজন আলেম সাইয়িদ রাদ বিবিসির গোপন প্রতিবেদককে বলেছিলেন যে শরিয়া আইনে অস্থায়ী বিবাহের কোনও সময়সীমা বেধে দেয়া হয়নি; একজন পুরুষ তার যত খুশি নারীকে বিয়ে করতে পারবেন। আপনি আধা ঘণ্টার জন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করতে পারবেন এবং যত তাড়াতাড়ি তা শেষ হবে, তাৎক্ষণিকভাবে আপনি অন্য আরেকজনকে বিয়ে করতে পারবেন।

অনুসন্ধানকারীরা যখন সাইয়িদ রাদকে জিজ্ঞাসা করেন, কোনো শিশুর সাথে অস্থায়ী বিয়ে করা গ্রহণযোগ্য কিনা, তখন ওই আলেম জবাব দিয়েছিলেন, কেবল সতর্ক থাকতে হবে ওই শিশু যেন তার কুমারীত্ব না হারায়।

তিনি আরও বলেন, আপনি তার সাথে ফোরপ্লে করতে পারেন, তার সাথে শুয়ে থাকতে পারেন, তার শরীর, তার স্তনগুলো স্পর্শ করতে পারেন… আপনি তার সামনে থেকে সেক্স করতে পারবেন না বলে পায়ু পথে করতে পারবেন।

মেয়েটি আহত হলে কী হবে, এমন প্রশ্ন জানতে চাইলে আলেম তাড়াহুড়ো করে জবাব দেন। মেয়েটি ব্যথা নিতে পারবে কি পারবে না সে বিষয়টি আপনার এবং তার মধ্যকার ব্যাপার। কারবালার একজন আলেম শেখ সালাউইকে তদন্তকারী গোপন ক্যামেরায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে কোনও ১২ বছরের কিশোরী কী মুত’আহর জন্য গ্রহণযোগ্য হবে?

তিনি বলেন, বিয়ে দেয়া হয় হ্যাঁ, নয় বছরের বেশি হলেই হবে- কোনও সমস্যা নেই। শরিয়া অনুসারে কোনও সমস্যা নেই। সাইয়্যিদ রাদের মতো তিনিও বলেছিলেন, একমাত্র বিষয় হল মেয়েটি কুমারী কিনা। সেক্ষেত্রে ফোরপ্লের অনুমতি দেয়া হয়েছে এবং নাবালিকা সম্মতি জানালে পায়ুপথে সেক্সও গ্রহণযোগ্য। তিনি আরো বলেন, আপনি যা চান তা করুন।

শিশুদের সাথে অস্থায়ী বিয়ের প্রক্রিয়াটি পরীক্ষা করার জন্য, এই প্রতিবেদক সাইয়্যিদ রাদকে শায়মা নামে একটি কাল্পনিক ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরীর বর্ণনা দিয়েছিলেন যার সাথে তিনি অস্থায়ী বিয়ে চান। বাস্তবে মেয়েটির ভূমিকায় বিবিসির একজন সহকর্মী অভিনয় করেছিলেন।

সাইয়িদ রাদ ওই মেয়েটির সাথে দেখা করেননি বা তার পরিবারের সাথে কথা বলেননি। ছদ্মবেশী প্রতিবেদকের সাথে ট্যাক্সিতে বসে ফোনের মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন করতে রাজি হন তিনি। তিনি মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করন, শায়মা, তুমি কি তাকে বিয়ে করার ব্যাপারে আমাকে তোমার সম্মতি জানাতে রাজি হয়েছ এবং একদিনের জন্য সে দেড় লক্ষ দিনার দেবে? শেষে তিনি বলেন, এখন আপনারা দুজনই বিবাহিত এবং আপনাদের এক সাথে থাকা হালাল।

তিনি কয়েক মিনিটের আনুষ্ঠানিকতার জন্য গোপন প্রতিবেদকের কাছে ২০০ ডলার দাবি এবং কাল্পনিক ১৩ বছর বয়সের মেয়েটির কল্যাণের জন্য কোনোউদ্বেগ প্রকাশ করেননি।

একজন বিবাহিত ব্যক্তি যিনি অপরিচিত নারীদের সাথে সহবাস করার জন্য আলেমদের মাধ্যমে নিয়মিত অস্থায়ী বিবাহ ব্যবহার করে থাকেন, তিনি বলছিলেন, ১২ বছর বয়সের এক শিশুর দাম অনেক বেশি। কারণ সে এখনও নিখুঁত। তার জন্য অনেক খরচ করতে হবে- ৫০০, ৭০০ এমনকি ৮০০ ডলার শুধুমাত্র ওই ধর্মীয় নেতাকেই দিতে হবে।

তিনি বিশ্বাস করেন যে তার এমন আচরণকে ধর্মীয় আচ্ছাদনে বৈধতা দেয়া হয়েছে। যদি কোনও ধার্মিক লোক আপনাকে বলেন যে অস্থায়ী বিবাহ হালাল, তবে এটি পাপ হিসাবে গণ্য হবে না। নারী অধিকারকর্মী ইয়ানার মোহাম্মদ, যিনি পুরো ইরাক জুড়ে নারীদের আশ্রয়ের একটি নেটওয়ার্ক চালাচ্ছেন, বলেছেন যে মেয়েদেরকে মানুষের চেয়ে বরং পণ্যদ্রব্য হিসাবে গণ্য করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, তারা এই মেয়েদের নির্দিষ্ট উপায়ে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। তবে তারা কুমারীত্ব টিকিয়ে রাখছে ভবিষ্যতে বড় ধরনের ব্যবসা করার জন্য। বড় ধরনের ব্যবসা বলতে তিনি বিয়েকে বুঝিয়েছেন।

যেখানে একটি মেয়ের কুমারীত্ব হারিয়ে গেলে, তাকে বিবাহের অযোগ্য হিসাবে দেখা হয়; এমনকি সে তার পরিবারের জন্য অসম্মান বয়ে আনার কারণে নিজ পরিবারের দ্বারা হত্যার ঝুঁকিতেও থাকে। তিনি বলেন, সব সময় মেয়ে এবং নারীদেরই এর মূল্য দিতে হয়।

ডকুমেন্টারি নির্মাতারা এই ধর্মীয় নেতাদের সাথে কথোপকথন গোপনে ক্যামেরায় রেকর্ড করেন; যেখানে তারা বলেছিল যে তারা অল্পবয়সী মেয়েদের সরবরাহ করতে রাজি আছে। বিবিসির এই দলটি একজন ভুক্তভোগীর সাক্ষ্যও নিয়েছিলেন, যিনি অভিযোগ করেছেন যে তাকে একজন ধর্মীয় নেতাই এই দেহ-ব্যবসায় ঠেলে দিয়েছে। তার সাক্ষ্যের প্রতি অন্যান্যরাও সমর্থন জানিয়েছে।

দলটি গোপনে এমন একজন আলেমকে ক্যামেরায় ধারণ করেছিলেন; যিনি ছদ্মবেশী প্রতিবেদকের সামনে একজন তরুণীকে ২৪ ঘণ্টার সম্ভাব্য অস্থায়ী বিয়ের জন্য হাজির করেছিলেন। এখানে মূলত ওই ধর্মীয় নেতা দালালের ভূমিকা পালন করছিলেন।

ছদ্মবেশী প্রতিবেদক যখন অস্থায়ী বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানান, তখন ওই ধর্মীয় নেতা বলেন যে তিনি তার কোনও কিশোরী মেয়ের সঙ্গে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন কিনা। সেক্ষেত্রে তিনি তেমন কাউকে খুঁজে বের করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

গাইথ তামিমি ইরাকের একজন প্রাক্তন উচ্চ পদস্থ শিয়া আলেম, যিনি মৌলবাদের বিষয়ে কথা বলার কারণে এখন লন্ডনে নির্বাসনে আছেন। তিনি সেইসব ধর্মীয় নেতাদের প্রতি নিন্দা জানান যারা নারীদের শোষণ করার জন্য অস্থায়ী বিবাহ প্রথাকে ব্যবহার করছে, বিশেষত খুব অল্প বয়সী মেয়েদের সাথে অস্থায়ী বিয়ের বৈধতা দিচ্ছে।

তার মতে, এটি এমন একটি অপরাধ; যার জন্য আইনের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। ইরাকের কয়েকজন শিয়া ধর্মীয় নেতা লিখেছেন, ইসলামী আইন শিশুদের সাথে যৌন সম্পর্কের অনুমতি দেয়। তামিমি শিয়া নেতাদের আহ্বান জানান যেন তারা এ ধরনের অনুশীলনকে নিন্দা জানান।

বিবিসি নিউজ আরবি গোপনে চিত্রায়িত তিনজন আলেমের মধ্যে দুজন, নিজেদের শিয়া ইসলামের অন্যতম জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব আয়াতুল্লাহ সিস্তানির অনুসারী বলে বর্ণনা করেছেন। তবে বিবিসির কাছে এক বিবৃতিতে আয়াতুল্লাহ বলেছেন, আপনি যেভাবে বলছেন সেভাবে যদি এই ঘটনাগুলো ঘটে থাকে তবে আমরা অকপটে তাদের নিন্দা জানাই। অস্থায়ী বিয়েকে এভাবে যৌনতা বিক্রির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়নি; যা নারীদের মর্যাদা এবং নারীর প্রতি মানবিকতাকে ছোট করে।

ইরাকি সরকারের একজন মুখপাত্র বলেছেন, নারীরা যদি আলেমদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ নিয়ে পুলিশের কাছে না যান। তবে কর্তৃপক্ষের এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া কঠিন।

এসএইচ-০৭/০৮/১৯ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্য সূত্র : বিবিসি)