নীতিমালা হলেও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেয়া হয় না

নেপালে ২০১৫ সালের ভূমিকম্প নাড়িয়ে দিয়েছিলো বাংলাদেশকেও। নেপালের ওই ভূমিকম্পের পর বাংলাদেশে সরকারী ভাবে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানানো হয়েছিলো।

কিন্তু এ সম্পর্কিত নীতিমালা কোনোদিনই মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেয়া হয়নি।

যদিও ২০০৪ সালেই জাতিসংঘের সহায়তায় সরকার ও কিছু সংস্থা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচিতে গুরুত্ব দেয়া শুরু করেছিলো এবং সেই পরিকল্পনায় ভূমিকম্পের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত ছিলো।

পরে ২০০৯ সাল নাগাদ দেখা যায় ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতায় প্রয়োজনীয় জনবল ও উপকরই নেই ফায়ার সার্ভিস বিভাগের।

এখন কর্তৃপক্ষ বলছেন ফায়ার সার্ভিস এখন অনেক বেশি সক্ষমতা অর্জন করেছে। ভূমিকম্প জনিত আগুন বা অন্য বিপর্যয়ে তারা আরও বেশি সক্রিয়তা দেখাতে পারবে।

প্রায় এক লাখ স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে যাতে প্রয়োজনের সময় তারাও কাজ করতে পারেন।

নেপালের ভূমিকম্পের ভয়াবহতায় তখন বাংলাদেশ জুড়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছিলো। কারণ এরপর বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিলো।

এরপর প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিলের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিলো ‘ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার’ প্রতিষ্ঠার।

সিদ্ধান্তটি এখনো বাস্তবায়িত না হলেও এ সম্পর্কিত কিছু কাজ চলছে বলে জানা গেছে।

এছাড়া ওই বৈঠকে ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এনডিএমআইএস) নামে একটি ওয়েবসাইট তৈরির সিদ্ধান্তও হয়েছে বলে তখন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব জানিয়েছিলেন ।

কিন্তু সেটিও এখনো হয়নি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ গওহর নঈম ওয়ারা বলছেন, এমন অনেক বিষয়েই এখনো কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি।

তিনি বলেন, বিল্ডিং কোড খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হলেও সেগুলোর গেজেট হয়নি।

“বিল্ডিং কোড সহজবোধ্য করে মানুষের কাছে পৌঁছানো দরকার ছিলো যাতে করে ভবন নির্মাণের সময় মানুষ সত্যিকার অর্থেই সতর্ক হওয়ার গুরুত্ব বুঝতে পারে। কিন্তু এ কাজটিও করা হয়নি এখনো। আবার প্রস্তুতি বা যা কাজ হচ্ছে তার লক্ষ্য শহর এলাকা। কিন্তু ভূমিকম্পের জন্য শহর ও গ্রাম এলাকায় সমান গুরুত্ব দেয়া উচিত।”

তিনি বলেন, একটা কক্ষ কতটুকু বড় হলে দরজার সংখ্যা বাড়ানো দরকার যাতে দুর্যোগ জনিত আগুনের সময় সহজেই মানুষ বের হয়ে আসতে পারে – এ ধারণাটি এখনো জনপ্রিয় হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক ড: হাফিজা খাতুন বলছেন সচেতনতা তৈরির মতো রুটিন কিছু কাজ চলছে ভূমিকম্প বিষয়ে এবং এর বাইরে বড় ধরণের কাজ বলতে ফায়ার সার্ভিসের কিছু যন্ত্রপাতি দেখা যাচ্ছে।

“আসলে যখন ঘটনা ঘটে নানা উদ্যোগ নেই আমরা যা পরে ভুলে যাই। রুটিন কাজ হলো সচেতনতা । এটি নিয়ে অনেক কাজ হয়। এমনকি বিল্ডিং কোডের পরিবর্তনগুলোও এখনো চূড়ান্ত করে মানুষকে জানানো হয়নি”।

জানা গেছে নেপালে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর বিশ্বব্যাংক ও জাইকার সহায়তা বাংলাদেশে ভবন পর্যবেক্ষণ ও অবস্থা যাচাই করার জন্য বেশ বড় ধরণের কর্মকাণ্ড শুরু হয়।

যার আওতায় সরকারি ভবন বিশেষ করে স্কুল, হাসপাতাল ও ফায়ার সার্ভিস ভবনগুলো পর্যবেক্ষণের কাজ শুরুর পাশাপাশি রাজউকের মাধ্যমে প্রাইভেট ভবনগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজ শুরু হয়ে।

এসব প্রকল্পের সাথে জড়িত আছেন বুয়েটের শিক্ষক মেহেদী হাসান আনসারী বলেন, বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় রাজউকের আওতাধীন ভবন এসেসমেন্ট কাজ চলছে আর জাইকার অর্থায়নে সরকারি ভবনগুলো নিরীক্ষা করা ও মজবুত করার কাজ চলছে।

জানা গেছে শুধু ঢাকাতেই প্রায় পাঁচ হাজার হাসপাতাল, স্কুল, ফায়ার সার্ভিস ভবনসহ সরকারি ভবনগুলো পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।

আনসারীর মতে এসেসমেন্ট প্রতিবেদন কয়েক মাসের মধ্যেই চূড়ান্ত হবে, তবে প্রাথমিকভাবে ভূমিকম্প ও ভূমিকম্প জনিত দুর্ঘটনা প্রতিরোধে খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই এই ভবনগুলো।

তিনি বলেন ৬০০ স্কুলকে টার্গেট করা হয়েছে এসেসমেন্টের জন্য এবং এর মধ্যে দুশো স্কুলের এসেসমেন্ট শেষ হয়েছে।

আনসারী বলেন মোট চারটি বিষয়কে সামনে রেখে ভূমিকম্প জনিত দুর্ঘটনা থেকে ভবন ও জানমাল রক্ষার কাজ চলছে।

এগুলো হলো :

১. রাজউক, সিটি কর্পোরেশন ও ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বাড়ানো। এজন্য প্রশিক্ষণ ও কমিউনিকেশন শক্তিশালী করণের পাশাপাশি ব্যাকআপ কমিউনিকেশন তৈরি করা। যাতে করে ভূমিকম্প হলে স্বাভাবিক যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল হয়ে গেলেও ব্যাক-আপ সক্রিয় থাকে।

২. একটি জরুরি সমন্বয় অপারেশন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা। আপাতত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন উত্তর ও দক্ষিণ, ফায়ার সার্ভিস এবং সিলেট সিটিতে এটা করা হচ্ছে। এই সমন্বয় কেন্দ্রগুলো ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবনে থাকবে যাতে বিপযর্য়কালে এর কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আর এখান থেকেই দুর্যোগ পরবর্তী সব কার্যক্রম পরিচালিত হবে। সব ধরণের তথ্য এখানেই আসবে এবং এখান থেকে দেয়া হবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এখান থেকেই কাজ করবেন। সর্বশেষ সব তথ্য এসব কেন্দ্রর স্ক্রিনে সার্বক্ষণিক দেখানো হবে। ফায়ার সার্ভিসের একটি ভবনই করা হচ্ছে ভূমিকম্প প্রতিরোধ উপযোগী করে।

৩. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের দক্ষতা বাড়ানো। এজন্য সেখানে একটি ইন্সটিটিউট হবে এবং একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ তৈরি হবে এই ইন্সটিটিউটেই।

৪. পুরো কাজগুলো ঠিক মতো হচ্ছে কিনা তা দেখভাল করবে পরিকল্পনা কমিশন।

আনসারী অবশ্য জানান সরকারি অর্থায়নে অন্তত একশ কোটি টাকা খরচ করে ফায়ার সার্ভিসের জন্য নানা উপকরণ কেনা হয়েছে যেগুলোর খুব প্রয়োজন ছিলো ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো: শাহাদৎ হোসেন বলেন বিল্ডিং কোডকে শক্তিশালী করা হয়েছে এবং ভূমিকম্প সহনীয় অবকাঠামো নির্মাণে জোর দেয়া হয়েছে।

“আমরা একই সাথে পূর্বাচলে তিন একর জায়গায় মানবিক সহায়তা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কাজ করছি। যাতে বড় দুর্যোগ হলে সেখান থেকেই জরুরি অপারেশন্স চালানো সম্ভব হয়। আর এয়ারপোর্টের কাছে বিবেচনায় সেখানে জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি নিয়ে এখন কাজ চলছে”।

“আমাদের মূল লক্ষ্য অবকাঠামো বিশেষ করে স্কুল, ঘরবাড়িকে ভূমিকম্প সহনীয় করে গড়ে তোলার সংস্কৃতি তৈরি করা। সে লক্ষ্যেই সরকার কাজ করছে।”

বুয়েটের সঙ্গে যৌথভাবে সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি সিডিএমপির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সাড়ে সাত মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকার ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়বে। যেখানে তৈরি হবে সাত কোটি টন কনক্রিটের স্তুপ।

এমন ভয়াবহ আশংকার বিপরীতে প্রস্তুতি কতটা সম্পন্ন হয়েছে জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ ড: আদিল মোহাম্মদ খান বিবিসিকে বলেন, ঘরবাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।

“এখন অনেকেই ভূমিকম্প বা এ ধরণের দুর্যোগের বিষয়টি বিবেচনা করে প্রকৌশলীদের সহায়তা নিয়ে ঘরবাড়ি নির্মাণে উৎসাহিত হচ্ছে। এ ধরণের ভবন গত দশ বছরে অনেকে বেড়েছে”।

যদিও এরপরেও দেশে বিপুল সংখ্যা অনিরাপদ হাউজিং আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় করণীয় হলো বিদ্যমান ভবনগুলোকে ভূমিকম্প সহনীয় করে তোলা।

“এটি অল্প সংস্কার ও অল্প ব্যয়েই সম্ভব। কিন্তু এজন্য সরকারিভাবেই প্রচার ও সহায়তায় এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় এখনো বহু মানুষ ঝুঁকিতেই থেকে যাবে”।

এসএইচ-০৫/১৪/১৯ (রাকিব হাসনাত, বিবিসি)