শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে বিদ্রোহের আগুন

কালো রঙ দশকের পর দশক জুড়ে সারা ফ্যাশন দুনিয়ায় বিশেষ স্থান অধিকার করে রেখেছে। তবে ভারতের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের ক্ষেত্রে কালো রঙের কদর বিশেষ একটা দেখা যায় না। ভারতের শাড়ি ডিজাইনার শর্মিলা নায়ার কালো রঙের শাড়ি ডিজাইন করে ভারতীয় সমাজে যেসব প্রচলিত সামাজিক ও রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা রয়েছে তাকে চ্যালেঞ্জ করছেন।

মিজ নায়ার একটি নতুন ক্যাম্পেইন চালু করেছেন, যার নাম ‘এইটিন শেডস্ অফ ব্ল্যাক’। এতে ১৮ জন নারী তার ডিজাইন করা কালো রঙের অপূর্ব সুন্দর সব শাড়ি পরেছেন, এবং তারা প্রতিদিনের জীবনে যেসব সূক্ষ্ম বৈষম্যের মুখোমুখি হচ্ছেন, সে সম্পর্কে খোলামেলা কথাবার্তা বলেছেন।

এ সব কিছুকে শর্মিলা নায়ার বর্ণনা করছেন ‘অদৃশ্য বাধা’ হিসেবে, কারণ এগুলো নারীদের জীবনে এতই সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে যে অনেক সময় নারীরাই এসব বিধিনিষেধ নিজের ওপর চাপিয়ে দেন।

তিনি বিবিসিকে জানান, গত বছর দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালায় হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র মন্দিরগুলোর একটি সবরিমালা মন্দিরে নারীদের প্রবেশাধিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট যে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছিল, সেই ঘটনা তাকে এই ক্যাম্পেইন শুরু করতে অনুপ্রাণিত করেছে।

হিন্দু ধর্মমতে ঋতুমতী নারী অপবিত্র, এবং সেই কারণে তাদের মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ।

মিজ নায়ার বলছেন, ঐ প্রথার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে এত বিপুল সংখ্যক নারী যোগ দিয়েছিলেন যে এটা দেখে তিনি ‘হতবাক’ হয়ে গিয়েছিলেন।

আর সেই ঘটনা থেকে শুরু হয় ‘এইটিন শেডস্ অফ ব্ল্যাক’ আন্দোলন। সংখ্যাটি ১৮ এই কারণে যে সবরিমালা মন্দিরে ঢুকতে ১৮টি সিঁড়ি পার হতে হয়। আর ব্ল্যাক বা কালো রঙের মানে হল সবাইকে ঐ মন্দিরে কালো পোশাক পরে ঢুকতে হয়।

“আমাদের বলা হয় মাসিক চলার সময় আমার দেহ অপবিত্র, এবং আমরা সেটাকে মেনে নিতে বাধ্য হই। এমনকি এখনও পিরিয়ড চলার সময় আমার অনেক বন্ধু কোন মন্দিরে যান না, বা কোন ধর্মীয় উপাসনা করেন না,” বলছেন তিনি।

“তাই আমি ভাবলাম, দেবীর অধিকার রক্ষার জন্য অনেক নারী যদি লড়াই করতে পারেন, তাহলে নারীর অধিকার রক্ষার লড়াইয়েও বহু নারী সামিল হতে পারবেন না কেন? এই লড়াইয়ে যদি বহু নারী যোগ দেন, তাহলে ভাবুন, পরিস্থিতি কেমন দাঁড়াবে?”

শর্মিলা নায়ার বলছেন, সমাজে প্রথাগত ভূমিকা পালনের জন্য নারীকে মানসিকভাবে তৈরি করার কাজ শুরু হয় একেবারে শিশুকাল থেকে।

“আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয় যে ছেলে এবং মেয়ে আলাদা। মেয়েরা জোরে কথা বলতে পারবে না, শব্দ করে হাসতে পারবে না। এখনও, বিশেষভাবে গ্রামে, মেয়েদের আর্টস বা কলাবিভাগে পড়তে উৎসাহিত করা হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিকেল পড়তে উৎসাহ দেয়া হয় কমই।

“মেয়েদের বিয়ে এবং সন্তান জন্মদানের ওপর অনেক বেশি জোর দেয়া হয়। ভারতের অনেক জায়গাতেই মেয়ের বয়স ১৮ বছর হওয়ার সাথে সাথে পরিবার উঠেপড়ে লাগে তাকে বিয়ে দিতে। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর পরিবার তাকে জিজ্ঞেস করতে থাকে সে কবে বাচ্চা নেবে। আবার প্রথম বাচ্চা হওয়ার পর থেকেই প্রশ্ন করতে থাকে দ্বিতীয় বাচ্চাটি তারা কবে নেবে,” বলছেন শর্মিলা নায়ার।

“এসব বিধিনিষেধকে আমরা নিজের ভেতরে স্থান দেই। আমরা নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কথা বলি, কিন্তু আমাদের প্রতিদিনের জীবনে এসব বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে প্রশ্ন না তুলেই আমরা নতি স্বীকার করি,” বলছেন তিনি, “আমি এসব অদৃশ্য বাধাগুলিকেই মোকাবেলা করার চেষ্টা করছি।”

এই ক্যাম্পেইনের লক্ষ্য হচ্ছে শাড়িকে ব্যবহার করে অন্ধ ধর্মীয় অনুশাসন এবং পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি, বর্তমানে অচল সব চিন্তাভাবনাকে চ্যালেঞ্জ করা।

এই ক্যাম্পেইনে নানা ধরনের ইস্যু নিয়ে কথাবার্তা বলা হয়। এর মধ্যে রয়েছে: বডি শেমিং বা দেহসৌষ্ঠব নিয়ে লজ্জা, গায়ের রঙের ওপর ভিত্তি করে বৈষম্য, বাল্য বিবাহ, মাসিককে ঘিরে সামাজিক লজ্জা, বর্ণবৈষম্য, এবং এমনকি নারীদের জন্য পরিষ্কার টয়লেটের অভাব ইত্যাদি।

শর্মিলা নায়ার জানাচ্ছেন, তবে এই ক্যাম্পেইনের জন্য উপযুক্ত নারী খুঁজে বের করার কাজটা সহজ ছিল না।

“আমি ৭০/৮০ জন নারীর সাথে কথা বলেছি। তাদের কাছে ভয়াবহ সব ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা শুনেছি। কিন্তু বেশিরভাগই প্রকাশ্যে কোন কথা বলতে রাজি হননি,” বলছেন তিনি, “সবরিমালা মন্দির বিতর্ক নিয়ে তাদের মনে ভয় ছিল। তারা আমাকে জানিয়েছেন তারা ভীত এই কারণে যে বৃহত্তর সমাজ তাদের বক্তব্যকে ভুলভাবে দেখতে পারে।”

কিন্তু এই ১৮ জন ‘চমৎকার নারী’ এগিয়ে আসেন এবং তারা যেসব বিধিনিষেধের শিকার হচ্ছেন, ও কীভাবে এসব বাধা মোকাবেলা করছেন, তা নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে রাজি হন।

তার ক্যাম্পেইনের মডেলরা যা-তা লোক নন। এদের মধ্যে রয়েছেন একজন আইনজীবী, একজন অভিনেতা, একজন মনোবিজ্ঞানী, রয়েছেন লেখক, অফিস-কর্মী, একজন গৃহবধূ এবং একজন যন্ত্রকৌশলী।

শর্মিলা নায়ার সোশাল মিডিয়ায় তার ক্যাম্পেইনের যেসব ভিডিও প্রকাশ করেছেন তাতে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নানা ধরনের গল্প উঠে এসেছে।

রেমিয়া সাসিন্দ্রান একজন লেখক ও উন্নয়ন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি জানাচ্ছেন, ছোটবেলা থেকেই তিনি এই জেনে বড় হয়েছেন যে মাতৃত্ব নিয়ে কোন আলোচনা চলবে না। তিনি যখন মা হতে রাজি হননি, তখন বলা হয়েছে তার মধ্যে নিশ্চয়ই কোন সমস্যা রয়েছে।

“কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমি টের পারলাম এরকম অনেক ধারণাই বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে … আমি বুঝতে পারলাম মাতৃত্ব কোন নারীর একমাত্র পরিচয় হতে পারে না। মাতৃত্ব যেমন একটা ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার, তেমনি মা না-হওয়াও একটা পছন্দের বিষয়,” তিনি বলছেন।

মনোবিজ্ঞানী এবং মাতৃদুগ্ধ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ স্বাতী জগদীশ তার সাথে তার মা’র ”বিষময় সম্পর্ক” নিয়ে কথা বলেন এবং জানান, মায়ের সাথে কোন কিছু নিয়ে আলোচনা করা তার জন্য কতটা কঠিন ছিল।

“সে জন্যেই আমি চাই আমার ওপর আমার মেয়ের যেন পূর্ণ আস্থা থাকে। আমার মায়ের উচিত ছিল সবকিছু নিয়ে আমার সাথে আলোচনা করা,” বলছেন তিনি, “আমার মা-ই আমাকে শিখিয়েছেন কীভাবে মা না হতে হয়।”

স্মিতা নায়েক নিজে একজন ইন্টিরিয়ার ডিজাইনার। তাকে নিয়েও ভিডিও হয়েছে। তিনি বিবিসিকে বলছেন, এই ক্যাম্পেইনে পোশাককে ব্যবহার করে যেসব বিষয় নিয়ে কথা বলা হচ্ছে তা বৃহত্তর সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

এই ভিডিওতে ভারতের নারী ড্রাইভারদের যেভাবে দেখা হয় এবং সড়কে তারা কী ধরনের হেনস্তার শিকার হন, তা নিয়ে মিজ নায়েক চাঁছাছোলা ভাষায় কথা বলেছেন।

তিনি মনে করেন এসব বিষয় নিয়ে নিয়মিতভাবে কথা বলা উচিত। “একটি ক্যাম্পেইন দিয়ে এই সমস্যা দূর করা যাবে না,” বলছেন তিনি।

তবে, ফ্যাশন এবং সৃজনশীল শিল্প ব্যবহার করে সমাজের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পৌঁছে দেয়া সম্ভব, এইটিন শেডস্ অফ ব্ল্যাক যে কাজটা এখন করার চেষ্টা করছে, বলছেন তিনি।

“কালো রঙের পোশাক পরে আমরা সমাজকে জানাতে চাইছি যে সবরিমালা মন্দিরের মতোই এই রঙ আমাদের। সমাজে আমাদেরও সমান ভাগ রয়েছে। এই যে কালো রঙের সমুদ্র রয়েছে, আমরাও তারই অংশ।”

এসএইচ-০৭/১৭/১৯ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্য সূত্র : বিবিসি)