শতবছরের মনিপুরী নৃত্য কমলগঞ্জ টু শান্তিনিকেতন

বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব কিছু ঐতিহ্য আছে। যা নিজ এলাকাকে পরিচিতি করাতে সক্ষম। আর সময়ের ধারাবাহিকতায় তা ধরে রাখছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মরা। এমনি একটি অঞ্চল সিলেট। সবুজের মায়ায় ঘেরা পাহাড়ের উচু-নিচু ভাব দুর থেকে যেনো মনে হয় নৃত্যের সাথে স্বাগত জানাচ্ছে। তাইত এই অঞ্চলের সংস্কৃতি অঙ্গনের বড় ঐতিহ্য মণিপুরী নৃত্য। আদিবাসিদের পায়ে মোড়ানো ঝুমুরের রিনিক-ঝিনিক আওয়াজ। আর শরীর দুলানোর মাঝে ফুটে উঠে নৃত্যের পরিভাষা। তাইত কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন নৃত্য দেখে নিজেকে সামলাতে পারেননি। তিনি আগরতলা থেকে রাজকুমার বুদ্ধিমনতা সিংহ-কে শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়ে মণিপুরী নৃত্য প্রবর্তন করেন। ১৯১৯ সালে সিলেট সফরকালে মণিপুরী নৃত্য দেখে কবিগুরু মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি এই নৃত্যকে বহির্বিশ্বে পরিচিত করান।

বিভিন্ন তথ্যসূত্রে পাওয়া যায়, মণিপুরী নৃত্যকে বলা হয় লাস্য বা কোমল ধরনের নাচ। কোমলতা ও নম্রতা হচ্ছে এই নৃত্যের বিশেষত্ব। শারীরিক ভঙ্গিমা, সৌন্দর্য ও নিবেদনের আকুতি থাকে এই নৃত্যে। বর্তমানে মণিপুরীরা বৃহত্তর সিলেটে বসবাস করছে। সিলেট শহর ও শহরতলি, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া ও বড়লেখা উপজেলা, হবিগঞ্জের চুনারঘাট এবং সুনামগঞ্জের ছাতকে এদের বসবাস।

১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী মণিপুরীদের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। এদের মধ্যে মৌলভীবাজারে ১৩ হাজার, সিলেটে ৭ হাজার এবং হবিগঞ্জে ৪ হাজার মণিপুরী বসবাস করে। এই মণিপুরিরায় মুলত এই নৃত্যকে এখনও আগলে রেখেছেন। তাদের সংস্কৃতির সবচেয়ে সমৃদ্ধ শাখা হচ্ছে মণিপুরী নৃত্য। মণিপুরী ভাষায় নৃত্যের প্রতিশব্দ হচ্ছে জাগই। এই নৃত্যে শারীরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চালনার মাধ্যমে বৃত্ত বা উপবৃত্ত সৃষ্টি করা হয়। মণিপুরী সংস্কৃতির সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নিদর্শন হচ্ছে রাসা নৃত্য। মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র রাসা নৃত্য উদ্ভাবন করেন এবং ১৭৭৯ সালের কার্তিকের পূর্ণিমায় মণিপুরে এটি প্রথম অনুষ্ঠিত হয়।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে শান্তিনিকতনে মণিপুরী নত্যৃ প্রবর্তনের শতবর্ষপূর্তি উদযাপন উপলক্ষে গেলো সপ্তাহে নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল বাংলাদেশ মণিপুরী আদিবাসী ফোরাম। প্রথম দিন বৃহস্পতিবার আলোচনাসভা ও বিচিত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। কমলগঞ্জ উপজেলার রানীরবাজার এলাকার দয়াময় সিংহ উচ্চ বিদ্যালয়ে দুদিন ব্যাপী এ অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। উদযাপন পরিষদের আহবায়ক ও মণিপুরী আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সমরজিত সিনহার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সিরাজগঞ্জ রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য অধ্যাপক ড, বিশ্বজিৎ ঘোষ। সম্মানিত অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন জ্বালানী ও খনিজ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কথা সাহিত্যিক ড. গোলাম শফিউদ্দিন, মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিশ্বভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র সঙ্গীত, মণিপুরী নৃত্য এবং নাটক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ওয়াই হেমন্তকুমার, অধ্যাপক ড. শ্রুতি বন্দোপাধ্যায়, অধ্যাপক অবসরপ্রাপ্ত কলাবতী দেবী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী রাজশাহী চারুকলা মহাবিদ্যালয়ের প্রভাষক নারগিস পারভিন সোমা, কমলগঞ্জ উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান বিলকিস বেগম।

এছাড়াও বক্তব্য রাখেন পৌরী সম্পাদক সুশীল কুমার সিংহ, বাংলাদেশ মনিপুরী মুসলিম ডেভেলপমেন্টের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদুল হক স্বপন, লেখকক গবেষক আহমদ সিরাজ, কমলগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি বিশ্বজিৎ রায়, কমলকুঁড়ি পত্রিকার সম্পাদক পিন্টু দেবনাথ, কবি লক্ষীন্দ্র সিংহ, কুমকুম সিংহ, ছালিয়া সিংহ, কবি পুলক কান্তি ধর। স্বাগত বক্তব্য রাখেন উদযাপন পরিষদের সদস্য সচিব এল. বজ্র গোপাল সিংহ।

অনুষ্ঠানের অতিথিবৃন্দ রবিরশ্মি স্মারক-সংকলন উন্মোচন করেন। সবশেষে বিচিত্রানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন ওয়াই হেমন্তকুমার, শ্রতি বন্দোপাধ্যায়, কলাবতী দেবী, কঙ্কনা সিংহ, আশুকান্তি সিংহ, সামিনা হোসেন প্রেমা, নীলমণি সিংহ ও ধীরেন্দ্র কুমার সিংহ।

এসএইচ-০৩/১৪/১৯ (সুমন হাসান)