বিনামূল্যে চিকিৎসা : তবু যক্ষ্মায় মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছেনা!

দেশের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে প্রতিদিন প্রায় ৯৭৮ জন যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছেন এবং এর মধ্যে ১৬ জন ঔষধ-প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত।

আর আক্রান্তদের মধ্যে দৈনিক মারা যাচ্ছে ১২৯ জন।

আর এমন পরিস্থিতির জন্য কর্মকর্তারা দায়ী করছেন প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব, আধুনিক যন্ত্রপাতির স্বল্পতা এবং অর্থের ঘাটতিকে।

যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির মেডিকেল কর্মকর্তা নাজিস আরেফিন বলছেন, এসব কারণ ছাড়াও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী ঔষধ দেশে উৎপাদন নিয়েও সমস্যা আছে।

জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বা এনটিপির হিসেবে ১৯৯৫ থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে প্রায় ত্রিশ লাখ যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। যার মধ্যে শিশু রয়েছে প্রায় বিশ হাজার।

জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. শামিউল ইসলাম বলছেন, যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসায় সফল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি এবং এটি বিশ্বে স্বীকৃত।

তিনি বলছেন ২০১৯ সালে দেশে তিন লাখ যক্ষ্মা রোগীকে চিহ্নিত করে চিকিৎসার আওতায় আনা হয়েছে এবং তাদের ধারণা আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা সাড়ে তিন লাখের মতো হতে পারে।

“চিহ্নিত করার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে আর ৯৬ ভাগ রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা যাচ্ছে। ২০১৫ সালে মৃত্যু হার ছিলো প্রতি লাখে ৬৭ জন, সেটি এখন উনত্রিশে নেমে এসেছে”।

ইসলাম বলেন, মানুষকে ব্যাপকভাবে জানানো দরকার যে চিকিৎসার সুযোগ আছে বিনামূল্যে এবং রোগ নির্ণয় সুবিধাও এখন অনেকে বেড়েছে।

চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে এটি জীবাণুঘটিত মারাত্মক সংক্রামক রোগ, যা মাইকো-ব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস নামক জীবাণু দিয়ে হাঁচি-কাশির মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটিয়ে থাকে।

একনাগাড়ে তিন সপ্তাহের বেশি কাশি, জ্বর ও বুকে ব্যথা এ রোগটির প্রধান লক্ষণ। কফ পরীক্ষা করাই হচ্ছে এ রোগ নির্ণয়ের একমাত্র নির্ভরযোগ্য উপায়।

যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. শামিউল ইসলাম বলছেন, এটি একটি কমিউনিকেবল ডিজিজ এবং আক্রান্ত ব্যক্তি চিকিৎসা না নিলে তার দ্বারা আরও দশজন পর্যন্ত আক্রান্ত হবার আশংকা থাকে।

“মনে রাখতে হবে অঞ্চল বিবেচনায় আমরা একটি যক্ষ্মাপ্রবণ এলাকায় বাস করছি। তাছাড়া মানুষের আয়ু বাড়ছে। ডায়াবেটিস বা বার্ধক্যজনিত সমস্যা নিয়ে আছেন অনেকে। খোলা জায়গা কমে যাচ্ছে এবং বাড়ছে বায়ুদূষণ – যা যক্ষ্মার ঝুঁকি বাড়াতেও সহায়তা করছে। রোগ-নির্ণয়ে দেরী করাটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে”।

যক্ষ্মা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা: আবু রায়হান বলছেন, বেশ কয়েকটি কারণে যক্ষ্মাকে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছেনা।

“দারিদ্র্যের কারণে অনেকেই রোগের লক্ষণ গোপন করে যায়। একজন রিকশাচালক বা বস্তিবাসী তিনি মনে করেন, অসুস্থ হলে চিকিৎসক হাসপাতালে ঘোরাঘুরি করলে তার উপার্জনে ক্ষতি হবে। মূলত এসব কারণে বড় একটা অংশ লক্ষণ গোপন করে অসুস্থ হচ্ছে ও পরে রোগ ছড়াচ্ছে”।

তাছাড়া আমাদের দেশে গণপরিবহনে প্রচণ্ড ভিড় থাকে এবং সেই ভিড়ে কোনোভাবে একজন যদি যক্ষ্মা রোগী থাকে তাহলে তিনি অনেককেই আক্রান্ত করতে পারেন, বলছিলেন মিস্টার রায়হান।

“আর বাচ্চাদের যক্ষ্মার বিষয়ে এতকাল তেমন কোনো ডায়াগনোসিসের ব্যবস্থা কার্যত ছিলোনা। এখন প্রয়োজনীয় মেশিন এসেছে। একেবারে ছোটো বাচ্চাদের কাশি দিয়ে বোঝানোর ক্ষমতা থাকেনা। পাঁচ বছরের আগ পর্যন্ত বাচ্চাদের কাশিই আসলে ওভাবে হয়না। ফলে এতদিন বেশ বড় একটা অংশ পরীক্ষা নিরীক্ষার বাইরে ছিলো”।

রায়হান বলছেন, অনেক জায়গায় যক্ষ্মা পরীক্ষার নামেও সমস্যা হচ্ছে।

“যথাযথ প্রশিক্ষিত ব্যক্তিদের ছাড়াই পরীক্ষা করে অনেককে আক্রান্ত না হওয়া সত্ত্বেও ঔষধ দেয়ার ঘটনাও ঘটছে। পরে আবার এদের মধ্যে যারা আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছেন তখন দেখা যাচ্ছে তাদের আর ঔষধে কাজ করছেনা”।

এছাড়া প্রচার সত্ত্বেও সচেতনতা পর্যাপ্ত আসেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আক্রান্তদের অনেকে ঔষধের ডোজ পুরোপুরি শেষ করছেননা যা আরও বড় সমস্যার জন্ম দিচ্ছে।

“ঔষধ প্রতিরোধীদের মধ্যে ৮০ভাগই ডায়াগনোসিসের বাইরে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গবেষকরা বলছেন এ সংখ্যা দেশে কমপক্ষে এখন দশ হাজার”।

কর্মকর্তারা বলছেন, ২০৩০ সাল নাগাদ নব্বই ভাগ রোগীকে পরিপূর্ণ চিকিৎসার আওতায় আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের মধ্যে ৭০ ভাগ নিয়ন্ত্রণে আনার কথা।

তবে ডা: আবু রায়হান বলছেন এক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হবে ঔষধ প্রতিরোধী হয়ে পড়া রোগীরা।

শনাক্তের বাইরে থাকা যক্ষ্মা রোগীরা কিংবা যারা চিকিৎসা পুরোপুরি শেষ করেননা – তাদের কারণে বাংলাদেশে নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। তাদেরই বলা হয় ঔষধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা বা এমডিআর।

অর্থাৎ সাধারণ চিকিৎসা তাদের জন্য আর কার্যকর থাকছেনা, শনাক্ত করার পর তাদের জন্য প্রয়োজন হয় আরও দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার – এমনটাই মনে করছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা।

তবে ঢাকায় আইসিডিআরবির কর্মকর্তারা বলছেন, যক্ষ্মা নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই – কারণ আধুনিক জিন এক্সপার্ট পরীক্ষা এখন বাংলাদেশেই হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে দু ঘণ্টায় রোগ নির্ণয় করা সম্ভব। তাছাড়া নয় মাসে রোগীকে ভালো করার পদ্ধতিও বাংলাদেশই বের করেছে।

যদিও কর্মকর্তারাই বলছেন, দেশে এ মূহুর্তে অন্তত ১২শ আধুনিক জিন এক্সপার্ট যন্ত্র দরকার অথচ চালু আছে মাত্র ২২১টি।

এখন পর্যন্ত যে পরিকল্পনা – তাতে আগামী পাঁচ বছরেও চাহিদার অর্ধেক আনা সম্ভব হতে পারে বলে মনে করছেন তারা।

২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে ২৪ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে বলে কর্মকর্তারা এর জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সফলতার কথা বলছেন।

অন্য যক্ষ্মারোগীসহ শিশু যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে দেশে।

তবে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা বা মাল্টি ড্রাগ রেজিসটেন্ট টিউবারকিউলোসিস (এমডিআর) রোগীদের আনুমানিক ৮০ শতাংশই শনাক্তের বাইরে থাকছে। আর সব ধরনের যক্ষ্মা চিকিৎসার আওতাবহির্ভূত থাকছে ২৬ শতাংশ রোগী।

অথচ যক্ষ্মার প্রচারে সবসময় বলা হয় এ রোগের চিকিৎসা সম্পূর্ণ ফ্রি।

তবে চিকিৎসক ও কর্মকর্তারা বলছেন ফ্রি বলতে এখানে শুধু ঔষধ ও কাশির পরীক্ষাকে বোঝানো হয়েছে।

অর্থাৎ এর বাইরে যেমন এক্সরে, সিটি স্ক্যান বা যক্ষ্মা সম্পর্কিত অন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা বা চিকিৎসা কিছুই বিনামূল্যে হয়না, এমনকি বক্ষব্যাধি হাসপাতালেও সব বেড ফ্রি নেই।

এটাকে অনেক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অসচ্ছল রোগীদের রোগকে গোপন করার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন চিকিৎসক ডা: আবু রায়হান।

তবে ডা: শামীউল ইসলাম বলছেন, প্রাথমিক পর্যায়ে কাশির পরীক্ষা ও ঔষধ নিয়ে চিন্তার কারণ নেই।

তবে কোনো কারণে ঔষধ প্রতিরোধী হয়ে পড়লে অনেক টাকা খরচের বিষয় হয়ে পড়ে বলে জানান তিনি।

“একজন নরমাল যক্ষ্মা রোগীর চেয়ে ঔষধ প্রতিরোধী রোগীর চিকিৎসার খরচ অন্তত ত্রিশ গুণ বেশি। সেটি আবার না হলে রোগটি আরও মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে”।

এসএইচ-০৪/১১/২০ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্য সূত্র : বিবিসি)