সমাজ সেবার পালে নতুন ধারা

দেশে সমাজসেবা ও সামাজিক উদ্যোগের ক্ষেত্রে নতুন এক ধারার সূচনা হচ্ছে৷ বিশেষ করে তরুণরা কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা ছাড়াই নেমে পড়ছেন সেবাকর্মে৷

মিল্টন সমাদ্দার ও মিঠু হালদার নার্স দম্পতি৷ তারা দুজনে প্রথমে বাণিজ্যিকভাবে ‘মিল্টন হোম কেয়ার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন বয়স্কদের বাসায় গিয়ে সেবা দেয়ার জন্য৷ সেখান থেকেই তারা অনুভব করেন অনেক বয়স্ক মানুষ আছেন যাদের দেখার কেউ নেই৷ তাদের থাকার ও খাবার ব্যবস্থাও নেই৷ সেই ভাবনা থেকেই ওই দম্পতি ২০১৪ গড়ে তোলেন আরেকটি ফ্রি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’৷

মিঠু হালদার ঢাকার একটি সরকারি হাসপাতালে চাকরি করেন আর মিল্টন সমাদ্দার পুরোটা সময় দেন এই কাজে৷ মিল্টন হোম কেয়ার থেকে মাসে এখন তাদের ৫ লাখ টাকা আয়৷ তার সঙ্গে মিঠু হালদারের চাররির বেতন মিলিয়ে তারা চালান ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’৷

এখানে যারা থাকেন তাদেরকে তারা বাবা-মা ডাকেন৷ আর শিশুদের সন্তান হিসেবেই দেখেন৷ তাদের নিজেদেরও একটি ছেলে আছে৷ দক্ষিন পাইকপাড়ায় ভাড়া বাড়িতে চলছে এই মানবতার বসতি৷

মিল্টন সমাদ্দার জানান, এখন তাদের কাছে এখন ৬৬ জন বয়স্ক নারী-পুরুষ এবং ৬ টি শিশু আছে৷ এ পর্যন্ত তারা ২২৭ জন বয়স্ক মানুষকে সেবা দিয়েছেন৷ তাদের মধ্যে ৪৯ জন মারা গেছেন৷ আর ৭৬টি শিশুর মধ্যে ৫০ শিশুকে তাদের বাবা-মায়ের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে৷

মিল্টন সমাদ্দার বলেন, ‘‘আমরা যাদের নিয়ে আসি তারা মূলত রাস্তার৷ তাদের কেউ নেই৷ অনেক বৃদ্ধ বাবা-মাকে আমরা রাস্তায় পেয়েছি৷ অনেক শিশু আমরা ডাস্টবিনে পলিথিন মোড়ানো অবস্থায় পেয়েছি৷ আমারা তাদের সব দায়িত্ব নেই৷ থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা, এমনকি মৃত্যুর পর দাফন করা পর্যন্ত৷”

নিজেদের আয়ের বাইরে তারা কিছু ডোনেশন পান সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে৷ তাদের একটি ফেসবুক পেজ আছে৷ সেখানেও অনেকে যোগাযোগ করেন৷ এমন কষ্ট এবং ব্যয়সাধ্য সেবামূলক কাজ শুরুর কারণ জানতে চাইলে মিল্টন সমাদ্দার বলেন, ‘‘আমরা যদি তাদের না দেখি, তাহলে আমদেরও কেউ দেখবে না৷ এই ভাবনা থেকেই আমাদের এই কাজ৷”

বাংলাদেশে একইভাবে শিক্ষা, পরিবেশ, রক্তদান, চিকিৎসাসহ নানা ক্ষেত্রে প্রচলিত ধারার এনজিও বা সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের বাইরে এরকম ব্যতিক্রমী উদ্যোগ আছে৷ আছে সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি৷ এইসব উদ্যোগের পিছনে নেই দেশি-বিদেশি ডোনেশন৷ তরুণরা নিজেদের উদ্যোগেই এসব কাজ করছেন৷ স্বেচ্ছাশ্রমে৷ অনেকটা নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবার মতো৷

‘মজার স্কুলের’ যাত্রা শুরু হয়েছিল একটি ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে, ২০১৩ সালের ১০ জানুয়রি৷ সোহারোওয়ার্দী উদ্যান থেকে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার জন্য৷ আর যারা শুরু করেন তারা প্রচলিত ধারায় না গিয়ে শিশুদের আনন্দ আর খেলাধুলার মাধ্যমে শিক্ষা দিতে চান৷

এখন ঢাকায় তাদের আটটি ওপেন স্কুল আছে৷ জাতীয় শিক্ষা পাঠক্রমের অধীনে চারটি স্কুল আছে৷ এসব স্কুলে দুই হাজার সুবিধাবঞ্চিত শিশু শিক্ষা, খাওয়া, পোশাক ও খেলাধুলার সুযোগ পায়৷ অচিরেই তাদের জন্য শুরু হবে ভকেশনাল ট্রেনিং স্কুল৷

সাড়ে তিন হাজার স্বেচ্ছাসেবক এই স্কুলগুলোতে পড়ান৷ পড়িয়ে কোনো অর্থ নেন না৷ তবে ৭৪ জন ফুল টাইম কাজ করেন৷ তাদের সম্মানি দেয়া হয়৷ স্কুলের উদ্যোক্তা আরিয়ান আরিফ জানান, ‘‘আমরা স্পন্সর নিই৷ মাসে দেড় হাজার টাকা করে দিলে একটি শিশুর পড়াশোনার দায়িত্ব নেয়া যায়৷ এটা নিয়ে আমাদের ক্যাম্পেইন আছে৷ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে আমরা সহায়তা পাই৷ আমাদের ফেসবুক পেজ দেখেও অনেকে সহায়তা করেন৷ আর সম্প্রতি আমরা খিলগায়ে একটি রেষ্টুরেন্ট চালু করেছি৷ সেখান থেকেও আয় আসে৷’

মজার স্কুলে মার্বেল খেলার মধ্য দিয়ে গণিত শেখানো হয়৷ মূলত সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা খেলে এমন খেলাগুলোকেই শিক্ষার উপকরণে পরিণত করা হয়েছে বলে জানান আরিয়ান আরিফ৷ প্রথমে ওপেন স্কুলে শিশুরা আসে৷ সেখান থেকে য়ায় ন্যাশনাল কারিকুলামের স্কুলে৷ আর ৭০০ শিশু আছে, যারা নেশাগ্রস্ত হওয়ার পথে গিয়েছিল৷ তারা এখন সেই পথ থেকে ফিরে এসে স্কুলে পড়ে৷

২০১৬ সালে ৩ জুন শাহবাগ থেকে সার্ক ফোয়ারা পর্যন্ত রাস্তা পরিস্কার করে তারা যাত্রা শুরু করেছিল৷ এখন দেশের ৫৭টি জেলায় তাদের কর্মসূচি বিস্তৃত৷ সপ্তাহে এক দিন তারা যার যার এলাকায় পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি পালন করে৷ এখন স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা তিন লাখ৷

বিডি ক্লিনের প্রধান সমন্বয়কারী ফরিদ উদ্দিন জানান, ‘‘আমরা গত ডিসেম্বরে সারাদেশ থেকে ফেলে দেয়া ৩০ লাখ প্লাস্টিক বোতল সংগ্রহ করে বিজয় দিবসে ঢাকায় প্রদর্শনী করেছি৷এর উদ্দেশ্য ছিল একবার ব্যবহার করা এইসব প্লাস্টিক বর্জ্যরে বিপদ সম্পর্কে দেশের মানুষকে সচেতন করা৷ পরে আমরা ওই বোতলগুলো রিসাইকেল করেছি৷”

এই কাজের জন্য তাদের কোনো অর্থ খরচ হয় না৷ তারা কোনো একটি ইভেন্ট ফেসবুকে ঘোষণা দেন৷ মানুষ স্বেচ্ছায় সেই ইভেন্টে যোগ দেয় বলে জানান ফরিদ উদ্দিন৷

নতুন ধারার এইসব সামাজিক উদ্যোগ সরকারের নজরেও আছে বলে জানান সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু৷ তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে সমাজ সেবার এক দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে৷ তরুণরা সেই ঐতিহ্যকে আবার নতুনভাবে, নতুন ধারায় ফিরিয়ে আনছে৷ এতে দেশের, দেশের মানুষের যেমন কল্যাণ হয়, তেমনি তরুণদের এই কাজ তাদের মাদক, সন্ত্রাস থেকে দূরে রাখবে৷ বিপথগামী তরুণ ফিরে আসবে সঠিক পথে৷ এই ধারা বাংলাদেশকে নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে৷”

তিনি বলেন, ‘‘তারা সরকারি সহায়তা নিচ্ছে না সত্য৷ তবে তাদের কাজ যেন কেউ বাধাগ্রস্ত করতে না পারে সেদিকে আমাদের খেয়াল আছে৷ তাছাড়া তারা যদি প্রয়োজন মনে করে, তাহলে আমরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবো৷”

প্রসঙ্গত, প্রচলিত ধারার অনেক এনজিও কাজ করছে বাংলাদেশে৷ এনজিও ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে নিবন্ধিত দেশি-বিদেশি এনজিও’র সংখ্যা দুই হাজার ৫০২টি৷ এই প্রতিষ্ঠানগুলো অলাভজনক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান৷ এরমধ্যে দেশি এনজিও দুই হাজার ২৪৬টি৷ বাকিগুলো বিদেশি৷

এসএইচ-০৪/২২/২০ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)