উচ্চশিক্ষায় বাংলা অনুবাদ গ্রন্থের সঙ্কট

বাংলাদেশে একুশে বইমেলায় প্রতিবছর যে অসংখ্য বই প্রকাশ হয় তার মধ্যে থাকে নানা ধরণের অল্প কিছু অনুবাদ গ্রন্থ। তবে সাহিত্য বা দর্শনের কিছু বিদেশি বইয়ের অনুবাদ পাওয়া গেলেও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলায় বই নেই বললেই চলে।

মেলার তৃতীয় সপ্তাহের একদিন তথ্যকেন্দ্র থেকে দেয়া ঘোষণা অনুযায়ী, “কবিতার বই জমা পড়েছে সাতশ বিশটি। দ্বিতীয় অবস্থানে উপন্যাস জমা পড়েছে তিনশত নিরানব্বইটি। গল্পের তিনশত আটত্রিশটি, প্রবন্ধ একশত পঁয়ত্রিশটি, গবেষণাধর্মী ও ছড়ার বই সাতচল্লিশটি করে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পঁচাত্তরটি, ধর্মীয় নয়টি ও অনুবাদের বই জমা পড়েছে সাতাশটি”।

বোঝাই যাচ্ছে, বাংলাদেশে নতুন পুস্তক প্রকাশের সবচাইতে বড় এই উপলক্ষকে ঘিরে কত কম সংখ্যক অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে।

তবে সাহিত্যের ক্ষেত্রে কিছু অনুবাদ হলেও বাংলাদেশে প্রায় একশ বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রকৌশল ও মেডিকেল শিক্ষার মতো বিশেষায়িত উচ্চশিক্ষার যেসব প্রতিষ্ঠান আছে তাদের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জন্য দরকারি বইগুলোর বাংলা অনুবাদ নেই বললেই চলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী কাকলী তানভীর বলছেন, হাতে গোনা যে দু একটি অনুবাদ পাওয়া যায় তা মূলত মুল ইংরেজি বইয়ের হুবহু ভাষান্তরের মতো।

“আমাদের যে পড়াশোনার বই ছিলো সেখানে আমরা যেটা বলি যে উচ্চশিক্ষায় মাতৃভাষার ব্যবহার সেটি তখনো ছিলোনা, এখনো নেই। আমরা পড়েছি ইংরেজি বই কিন্তু পরীক্ষার খাতায় লিখেছি বাংলায়। একাডেমিক বইগুলো অনুবাদ হবে এ আশাই করা যায়না। আমি দেখিনি যে একাডেমিক বইগুলোর ভালো অনুবাদ বেরিয়েছে”।

কাকলী তানভীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েছেন প্রায় দু দশক আগে।

এই দুদশকে মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষার কথা জোরেশোরে বলা হলেও বাংলা, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা এ ধরণের কয়েকটি বিষয় বাদ দিলে অন্য বিষয়গুলোর পর্যাপ্ত বাংলা বই বা বিদেশি বইয়ের বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে খুব একটা অগ্রগতি নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মানসুরা আলম বলছেন, আইনের ক্ষেত্রে বাংলা অনুবাদ গ্রন্থ বা মানসম্পন্ন বাংলায় লেখা বই এখনো নেই বললেই চলে।

“সাধারণত আমাদের ক্লাসে যেগুলো পড়ানো হয় ইংরেজিকে প্রাধান্য দিয়েই। নীলক্ষেতে কিছু বই পাওয়া যায় তবে ইংরেজিকেই বেশি গুরুত্ব দেই। কারণ লিখতে হবে ইংরেজিতে। আবার ল’য়ের ক্ষেত্রে যেহেতু কলোনিয়াল ল’তে আছি, সেক্ষেত্রে ব্যাখ্যার জন্য ইংরেজিই পড়ি, কারণ বাংলায় ব্যাখ্যা সেভাবে তৈরি এখনো হয়নি”।

একই অবস্থা বিরাজ করছেন প্রকৌশল কিংবা মেডিকেল শিক্ষার ক্ষেত্রেও। দেশে বুয়েট ছাড়া বেশ কিছু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় আছে এবং প্রায় প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে।

এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ভর্তি হচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই আসছেন বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তাদের ক্লাসে শিক্ষক বাংলায় পড়ালেও কোনো বই নেই বাংলায়।

বুয়েটের শিক্ষক তাসনিম তারিক বলছেন, ইংরেজিতে পড়াশোনা করার নির্দেশনাই আছে সেখানে।

“এখানে ইংরেজিই ফলো করি। ইংরেজিতেই পরীক্ষা নেয়া হয়। যে মেটারিয়ালগুলো পড়ি সেগুলো ইংরেজিতে। হিস্ট্রি থিওরির কিছু বাংলা বই পেলেও অন্যক্ষেত্রে রিডিং মেটারিয়ালগুলো ইংরেজিই অনুসরণ করা হয়”।

তিনি জানান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় বইগুলোর বাংলায় অনুবাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ কখনো তার চোখে পড়েনি।

“স্বঃপ্রণোদিত হয়ে কোনো শিক্ষক বই করতে চাইলে করতে পারেন। শিশু স্থাপত্য বিষয়ে বাংলায় বই আছে। কিন্তু এটা আসলে ব্যক্তি উদ্যোগের ওপর নির্ভর করে”।

একই অবস্থা দেশের চিকিৎসা বিষয়ে পড়াশোনার ক্ষেত্রেও।

দেশে একত্রিশটি সরকারি মেডিকেল কলেজ ছাড়াও রয়েছে অনেকগুলো বেসরকারি মেডিকেল কলেজ। কিন্তু পড়াশোনার ক্ষেত্রে তাদের নির্ভর করতে হয় ইংরেজি ভাষায় লেখা বই।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রভাষক ফারজানা নুসরাত তানিয়া বলছেন বাংলায় কার্যত কোনো বই-ই নেই মেডিকেল শিক্ষার্থীদের জন্য।

“মেডিকেল শিক্ষা সম্পূর্ণ ইংরেজি মাধ্যম। শিক্ষকরাও ইংরেজিটাই বাংলায় বোঝানোর চেষ্টা করে। আপনি জানেন মেডিকেল টার্মগুলো বোঝা কঠিন। বাংলাদেশি লেখক যারা লিখেছেন তারাও ইংরেজিতে লিখেছেন। আর সব লেখাই বাইরের”।

তিনি বলেন মেডিকেল শিক্ষার বইগুলো বাংলায় অনুবাদের কোনো উদ্যোগ তার দৃষ্টিতে আসেনি। তবে বাংলা একাডেমী বলছে, তারা কিছু বই যেগুলো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠ্য সেগুলোর অনুবাদের কাজ করেছে, বিশেষ করে দর্শনের মতো বিষয়।

বাংলা একাডেমী অবশ্য বলছে, তারা যথাযথ সম্পাদনা প্রক্রিয়া মেনেই নামীদামী সাহিত্য, দর্শন বা প্রবন্ধের পাশাপাশি একাডেমিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি বইয়ের অনুবাদ করছে যেগুলো উচ্চশিক্ষায় ব্যবহৃত হতে পারে।

প্রতিষ্ঠানটির অনুবাদ বিভাগের পরিচালক ড. মিজানুর রহমান বলছেন, দুটি প্রক্রিয়ায় অনুবাদের কাজ করছে একাডেমী।

“প্রথমত অনুবাদের বিষয় ঠিক করে কমিশন করা হয় অনুবাদককে। আবার সুপরিচিত অনুবাদকরাও নিজেরা পাণ্ডুলিপি আনলে আমরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ছাপার ব্যবস্থা করি। বাংলা একাডেমী অনেক ডিসিপ্লিনের বই ছাপি আমরা। যেমন দর্শনের বই। ইদানীং বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে”।

তিনি বলেন তারা এখন বাংলা সাহিত্যকে ইংরেজিভাষীদের মধ্যে বেশি করে উপস্থাপন করতে চান অনুবাদের মাধ্যমে তাই পাঠ্যপুস্তকের চেয়ে তারা বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছেন সেটিকেই।

একাডেমীর হিসেবে এ পর্যন্ত ৭/৮শ বিদেশি বই তারা অনুবাদ করেছেন বাংলায়, যার অনেকগুলো উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সহায়ক। তবে এর বাইরে শিক্ষক বা গবেষকরা যদি কোনো বিষয়ের বিদেশি বই অনুবাদ করে দিলে একাডেমী তা প্রকাশ করবে বলেও জানা মিস্টার রহমান।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অনুবাদক সোনিয়া নিশাত আমিন বলছেন, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজিতেই এখন জোর দিতে হবে কারণ এখানে সব সাম্প্রতিক বই অনুবাদ করার মতো যথেষ্ট মানসম্পন্ন অনুবাদক এখনো তৈরি হয়নি।

তিনি বলেন শুধু ইংরেজি থেকে বাংলায় নয়, আরও অনেক যেসব সমৃদ্ধ ভাষা আছে সেসব ভাষা থেকেও একাডেমিক কাজে ব্যবহারের বই বাংলায় অনুবাদ করার মতো লোকবল এ মূহুর্তে নেই।

“অনুবাদের মাধ্যমে আমাদের বিশ্ব সাহিত্য এক্সেস করতে হবে। এ জন্য যারা ইংরেজি বাংলা চর্চা করে তাদের সমাদর করতে হবে। অন্য ভাষার দোভাষীরা কোথায়? ফরাসি, রাশিয়ান, জার্মান তো বাদই দিলাম। এ নিয়ে দৈন্যতা থেকেই গেছে। অনেক বেশি অনুবাদক তৈরি করা উচিত। আমি শুনেছি প্রধানমন্ত্রী অনুবাদ ক্ষেত্রে ভালো বরাদ্দ দিয়েছেন। আশা করি এর সদ্ব্যবহার হবে”।

আর সুপরিচিত অনুবাদক বিশেষ করে বাংলা বই ইংরেজিতে অনুবাদের জন্য সুপরিচিত অধ্যাপক ফখরুল আলম বলছেন অনুবাদের ক্ষেত্রে ভালো মানের জাতীয় প্রতিষ্ঠান না থাকায় অনুবাদে পেশাদারিত্ব গড়ে উঠেনি। তবে জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা শাখায় যেসব নতুন বই আসছে সেগুলো বাংলায় করার মতো প্রতিষ্ঠান নেই। আবার প্রকাশকদের সামর্থ্যও সীমিত বিশেষ করে একাডেমিক বই বাংলায় অনুবাদ করার ক্ষেত্রে।

“অনুবাদ আসলেই কঠিন বিষয়। অনুবাদকের স্পোকেন দক্ষতা থাকতে হয়। এমন অনুবাদক কমই আছে। আর উচ্চশিক্ষা তো স্টেট অফ আর্ট নলেজ। এখানে নতুন জ্ঞানের জায়গা আছে। সেজন্য অনুবাদ সঙ্গে সঙ্গে যাবেনা। শিক্ষার যতো উঁচু স্তরে যাবো তত ভালো অনুবাদ পাওয়া আমাদের জন্য দুরূহ হবে”।

আবার একাডেমিক বই পুস্তক বিদেশী ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করার ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রকাশনা সংস্থাগুলোর আগ্রহ কম। এসব সংস্থাগুলো মনে করে এ কাজে বরং বাংলা একাডেমী কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থার মতো প্রতিষ্ঠানগুলোই যথেষ্ট।

বাংলাদেশে বাংলা একাডেমীর বাইরে যে কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশ করে বেশ পাঠক সাড়াও পেয়েছে তাদের মধ্যে একটি পাঠক সমাবেশ। এ প্রতিষ্ঠানটির ইলিয়াড, ফ্রানৎস কাফকা গল্প সমগ্র বা প্লেটো সিরিজ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি হেড অফ পাবলিকেশন্স ওয়াহিদুল হক মনে করেন অনুবাদের জন্য একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান জরুরি হয়ে পড়েছে।

“বাংলাদেশে অনুবাদ নিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান বা কেন্দ্র সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে হওয়া উচিত। যেখানে অনুবাদকদের ডাটাবেস থাকবে। সেখান থেকে প্রকাশকরাও জানতে পারবে তাদের সম্পর্কে”।

তবে অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে আমাদের অনুবাদ সাহিত্যিকদের অনুযোগ কম নয়। তাদের মতে, ভালো অনুবাদকের যথাযথ মূল্যায়ন যেমন হয়না তেমন তাদের কাজেরও স্বীকৃতি মেলে না। আবার মানহীন অনুবাদের কারণে ভালো অনুবাদকদের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অনুবাদক জি এইচ হাবীব বলছেন, ভাষার সমস্যার কারণেই এদেশে মূল বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ থেকে আবার বাংলায় অনুবাদের প্রবণতা এখানে বেশি। আবার নিয়ম কানুন না থাকার কারণে অনুবাদের ক্ষেত্রে কোনো ভালো সংস্কৃতি তৈরি হয়নি।

“সেই অর্থে এখানে এডিটর নেই। আবার যারা আছেন গুটিকয়েক তাদের আর্থিক মূল্যায়ন করা হয়না। মনে রাখতে হবে অনুবাদ একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। লাইনে লাইনে মিলিয়ে দেখতে হয়। আর এখানে এমনি সিস্টেম মানার প্রবণতা নেই। গুটি কয়েক প্রতিষ্ঠান যথাযথ সম্পাদনা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বই বাজারে আনে, যেই সংখ্যা অনেক কম”।

তবে অনুবাদক, প্রকাশক কিংবা একাডেমী সবাই এটি একবাক্যেই স্বীকার করছে যে, ভালো অনুবাদের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের যেমন আন্তর্জাতিকীকরণ সম্ভব হবে তেমন বিদেশী সমসাময়িক পাঠ্যবই এমনকি চারু ও কৃত্য শিল্পের সব শাখায় বিশ্ব মানের লেখাগুলোর বাংলায় অনুবাদ, ভাষান্তর ও রূপান্তর হওয়া উচিত নিয়মিতভাবেই।

এসএইচ-০৭/২৩/২০ (রাকিব হাসনাত, বিবিসি)