দিল্লিতে হিন্দু-মুসলিম বিশ্বাসের ভিতে ফাটল

দাঙ্গাবিধ্বস্ত উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে রাস্তাঘাটে একটু একটু করে যানচলাচল আবার শুরু হয়েছে, মানুষজন জরুরি প্রয়োজনে বাইরে বেরোচ্ছেন – কিন্তু ভেতরে ভেতরে পরিস্থিতি এখনও অত্যন্ত থমথমে।

সবচেয়ে বড় কথা, রাজধানীর এই এলাকাগুলোতে গরিব, শ্রমজীবী হিন্দু ও মুসলিমরা যে পারস্পরিক ভরসার ভিত্তিতে এত বছর ধরে পাশাপাশি বসবাস করে আসছেন – সেই বিশ্বাসের ভিতটাই ভীষণভাবে নড়ে গেছে।

হিন্দু-অধ্যুষিত এলাকা ব্রিজপুরী আর মুসলিম-অধ্যুষিত মোস্তাফাবাদের সীমানায় একদল মহিলা বলছিলেন, তারা এখন দুই সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেই রাত জেগে মহল্লায় পাহারা দিচ্ছেন।

কিন্তু তারা স্পষ্টতই ব্যতিক্রম। খুব কম জায়গাতেই দুই সম্প্রদায়ের মানুষ একযোগে পাহারা দিচ্ছেন কিংবা হিন্দু-মুসলিমদের নিয়ে এলাকায় ‘শান্তি কমিটি’ গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে।

বরং জাফরাবাদ-মৌজপুর-গোকুলপুরী-ভজনপুরা গোটা তল্লাট জুড়েই প্রবল সন্দেহ আর অবিশ্বাসের বাতাবরণ।

হিন্দু ও মুসলিম উভয় মহল্লাতেই গলিতে ঢোকার প্রবেশপথগুলো পাথর বা ব্যারিকেড ফেলে আটকে দেওয়া হয়েছে।

গলিতে ঢোকার বা বেরোনোর সময় এলাকার বাসিন্দারাই বহিরাগতদের নাম-পরিচয় পরীক্ষা করছেন।

সংবাদমাধ্যমও এই ‘স্ক্রুটিনি’ থেকে বাদ পড়ছে না।

আমি ও বিবিসিতে আমার সহকর্মী সালমান রাভি-কেও বার বার এই ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে।

মুসলিম নাম শুনে হিন্দু মহল্লার লোকজন ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছেন, আবার হিন্দু নাম শুনে মুসলিম এলাকার লোকজন অনেকে গুটিয়ে গেছেন।

পাশাপাশি হিন্দু ও মুসলিম দুতরফেই এই প্রশ্নটা তোলা হচ্ছে, “যখন মারামারি-লুঠপাট হচ্ছিল তখন পুলিশ বা মিডিয়া কোথায় ছিল?”

শিব বিহারের বাসিন্দা বৃদ্ধ শাজাহান আলি বলছিলেন, “দুতরফ থেকেই পাথর ছোঁড়াছুড়ি হচ্ছিল যখন – তখন কোনও পুলিশই আসেনি। বরং মনে হয়েছে, প্রশাসন যেন ইচ্ছাকৃতভাবে এই হিংসায় উসকানি দিয়েছে।”

বাইক চালাচ্ছিল তার ছেলে মুজফফর, সে পাশ থেকে যোগ করে, “সহিংসতার পর আহতদের নিয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত আসেনি, ফোন করেও কোনও সাড়া মেলেনি!”

বস্তুত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে মূলত মুসলিমদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কীভাবে এই বিপজ্জনক হিংসায় মোড় নিল, সেটা এখনও একটা রহস্যই।

ব্রিজপুরীর প্রবীণ হিন্দু বাসিন্দা পন্ডিত মোহন শর্মা যেমন বলছিলেন, “গত দুমাসের ওপর ধরেই পাড়ার মসজিদে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলছিল – কিন্তু তা শান্তিপূর্ণই ছিল।”

“কিন্তু সেটাকে কেন্দ্র করে পরিবেশ আচমকা এতটা অশান্ত হয়ে উঠল কীভাবে সেটা আমার মাথাতেই ঢুকছে না।”

আবার শর্মাজির প্রতিবেশী মহম্মদ রফিকও জানাচ্ছেন, “সেদিন সকাল থেকেই বাতাসে কানাঘুষো শুনছিলাম, গন্ডগোল হতে পারে।”

“বিকেল চারটে নাগাদ সেই আশঙ্কাই সত্যি হল – পাথর-ইট-পাটকেল-পেট্রল বোমা ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু হয়ে গেল। কে আগে করেছে জানি না, কিন্তু যা হয়েছে অত্যন্ত খারাপ হয়েছে।”

গত রবিবার বিকেলে দিল্লিতে বিজেপির এক বিতর্কিত নেতা কপিল মিশ্র-র প্ররোচনামূলক ভাষণকে অনেকে দাঙ্গা ‘ট্রিগার’ করার জন্য দায়ী করেছেন।

বহু মুসলিম আমাদের বলেছেন, “কপিল মিশ্রই যাবতীয় গন্ডগোলের মূলে।”

“দলের ইশারাতেই নিশ্চয় তিনি এখানে এসে পুলিশকে হুমকি দিয়ে গেছেন – যাতে দাঙ্গার সময় তারা হাত গুটিয়ে থাকে।”

আবার হিন্দুদের মধ্যে কপিল মিশ্রর সমর্থকও কম নয়।

ভজনপুরার এক ভস্মীভূত পেট্রোল পাম্পের সামনে একদল বাইক-আরোহী যুবক মিডিয়ার লোকজন দেখে আমাদের এসে শুনিয়ে গেল, “শুনে রাখুন – আসল হিরো কিন্তু কপিল মিশ্রই!”

“মুসলিমরা যেখানে খুশি রাস্তা আটকে বসে পড়বে, আমরা হিন্দুরা কি চুড়ি পরে বসে থাকব না কি?”, এক নি:শ্বাসে বলেই ঝড়ের গতিতে বাইক চালিয়ে বেরিয়ে যায় তারা।

বৃহস্পতিবার সকাল থেকে আম আদমি পার্টির এক স্থানীয় কাউন্সিলর তাহির হোসেনের নামও ভীষণভাবে আলোচনার কেন্দ্রে।

বিজেপি সমর্থকরা সোশ্যাল মিডিয়া-তে নানা ভিডিও পোস্ট করে দাবি করছেন, অঙ্কিত শর্মা নামে যে তরুণ গোয়েন্দা অফিসারের লাশ দুদিন আগে জাফরাবাদের নর্দমা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে – তার হত্যার পেছনে দায়ী ওই মুসলিম রাজনীতিবিদই।

তাহির হোসেন নিজে অবশ্য এদিন দাবি করেছেন, তিনি কোনও আক্রমণে জড়িত তো ছিলেনই না – বরং তার বাড়িতেই দাঙ্গাকারীরা হামলা করেছিল।

তবে তার পরও বিভিন্ন হিন্দু মহল্লায় তাহির হোসেনকে ‘টেররিস্ট’ বলে গালাগালাজ করা হচ্ছে, তা নিজের কানেই শুনেছি।

দিল্লির বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সাম্প্রদায়িক পরিবেশ যে কতটা বিষিয়ে গেছে, এগুলো তারই প্রমাণ।

যমুনা বিহারের এক মুসলিম গার্মেন্ট ব্যবসায়ীর সঙ্গে এদিন কথা হচ্ছিল, যিনি নিজের নাম বলতে চাইলেন না।

তিনি নিজের কারখানার এগারোজন হিন্দু শ্রমিককে আজ সকালেই ওল্ড দিল্লি স্টেশন থেকে বিহারের ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে এসেছেন।

“যা পরিস্থিতি এখানে, ওদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেওয়া আমার পক্ষে সত্যিই আর সম্ভব নয়। অথচ ওরা প্রায় দশ-বারো বছর ধরে আমার এখানেই কাজ করছে, কখনও কোন সমস্যা হয়নি”, বলছিলেন তিনি।

ওদিকে মুস্তাফাবাদের অলিতে-গলিতে পোড়া মসজিদের ভেতর থেকে এখনও ধোঁয়া উঠছে, চারদিকে ছড়িয়ে আছে ছাই।

ফারুকিয়া মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে মহিলারা বলছিলেন, “হিন্দুদের বিপদের সময় আমরা তাদের নিজের ঘরেও লুকিয়ে রেখেছি – অথচ তারা আমাদের এত বড় ক্ষতি কীভাবে করতে পারল?”

“মাদ্রাসার ছোট ছোট বাচ্চাদের ওপর পর্যন্ত হামলা করা হয়েছে, জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে কোরান শরিফ”, জানাচ্ছেন তারা।

বস্তুত এখন সরাসরি অন্য সম্প্রদায়কে আক্রমণ করে কথা বলছে হিন্দু-মুসলিম দুতরফই।

ওদিকে একটু দূরেই পিপুল গাছের গলি নামে পরিচিত সরু রাস্তার ভেতরে দিলীপ সিংয়ের বাড়ির ভেতরেও শোকের মাতম চলছে আজ তিনদিন ধরে।

পাড়ার মহিলারা বলছিলেন, “পরিবারের ছোট ছেলে রাহুল সেদিন দুপুরে বাড়ি থেকে মায়ের বেড়ে দেওয়া খাবার খেয়ে বাইরে বেরিয়েছিল কীসের গন্ডগোল তা দেখতে।”

“এই রাস্তা দিয়ে গেল, আর পাঁচ মিনিট বাদে পাশের রাস্তা দিয়ে তার ফিরল তার গুলিবিদ্ধ লাশ!”

উত্তর-পূর্ব দিল্লির বাবরপুরা, জাফরাবাদ, মৌজপুর বা গোকুলপুরীর মোড়ে মোড়ে আজ এই ধরনেরই ছবি।

আর রাহুল সিং যেমন, তেমনি শাহিদ আলম বা তানভির শেখ-সহ নিহতদের অনেকের পরিবারেরই স্পষ্ট অভিযোগ তাদের প্রিয়জনের প্রাণ গেছে যে হিংসায় – প্রশাসন চাইলে তা অনায়াসেই এড়াতে পারত!

যে কোনও কারণেই হোক প্রশাসন তা চায়নি – আর শুধু ৩৫টি প্রাণই নয়, তার নিষ্ঠুর বলি হয়েছে সেই ভরসাটুকুও – যার ভিত্তিতে দিল্লিতে এতদিন পাশাপাশি থেকেছে হিন্দু ও মুসলিমরা।

এসএইচ-০৭/২৮/২০ (শুভজ্যোতি ঘোষ, বিবিসি)