আতঙ্কে চিকিৎসা সংকটে পড়ছেন সাধারণ রোগীরা

ফরিদপুরের একজন বাসিন্দা গত বেশ কয়েকদিন ধরে জ্বর, সর্দি-কাশিতে ভুগছিলেন। দুইদিন আগে তার শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তিনি হাসপাতাল ভর্তির চেষ্টা করেন।

কিন্তু ফরিদপুরের কোন হাসপাতালই তাকে ভর্তি করাতে রাজি হয়নি। তাকে পরামর্শ দেয়া হয়, তিনি যেন আইইডিসিআরের হটলাইনে যোগাযোগ করে করোনাভাইরাসের পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন।

রোগীর ভাই নেয়ামুল বাসার বিবিসিকে বলছেন, ” আমরা সবগুলো হাসপাতালে চেষ্টা করেছি। এমনকি ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও গিয়েছি। কিন্তু সেখানে তারা বলেছেন, তার রোগ করোনার লক্ষণের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, তাই এখানে ভর্তি করানো যাবে না। কোন হাসপাতালই ভর্তি করাতে রাজি হয়নি।”

”এদিকে হটলাইনে চেষ্টা করার পর তারা জানতে চেয়েছে, বিদেশি কারো সংস্পর্শে আমার ভাই এসেছিল কিনা। যখন বললাম, সেটা হয়নি,তখন বললো,তাহলে তারা কোন টেস্ট করবে না। স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বলেছে। কিন্তু স্থানীয় হাসপাতাল তো চিকিৎসা দিতে রাজি নয়, তাদের কাছে যেতে বলছে। আমরা এখন কি করবো?”

পরে ফরিদপুরের সিভিল সার্জনের হস্তক্ষেপে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

বিবিসি বাংলার কাছে এরকম বেশ কয়েকটি ঘটনার তথ্য এসেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বরিশালের বাসিন্দা একজন নারী বিবিসিকে বলছেন, তার জ্বর ও কাশি নিয়ে তিনি চিকিৎসকের কাছে গেলে তাকে প্রথমেই আইইডিসিআরে যোগাযোগ করতে বলা হয়। চিকিৎসক তাকে বলেন, তিনি যেন ঢাকায় গিয়ে কুর্মিটোলা বা মুগদা হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।

”আমি থাকি বরিশালে। এখান থেকে জ্বর-কাশি নিয়ে চিকিৎসা করাতে আমার ঢাকায় যেতে হবে? আইইডিসিআর থেকে কবে আসবে,কবে টেস্ট করবে? আমার যে রোগই হোক না কেন, আমাকে তো হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসাটা অন্তত করবে?”

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত আতঙ্ক আর অবহেলায় একজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।

ঢাকার একটি পত্রিকা ডেইলি স্টার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যে, কানাডা ফেরত একজন ছাত্রী পেটের ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। প্রথমে তার চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু যখনি ডাক্তার ও সেবিকারা জানতে পারেন যে, তিনি কানাডা থেকে এসেছেন, এরপর তার কাছে আর কোন চিকিৎসা কর্মী আসেননি বলে পরিবার অভিযোগ করেছে।

নিজেদের ভোগান্তির কথা অনেকে তুলে ধরেছেন ফেসবুকে।

প্রতাপ শেখর মোহান্ত নামের একজনের একটি লেখা ফেসবুকে অনেক শেয়ার হচ্ছে।

সেখানে লেখা হয়েছে, ”জ্বর, শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, নিউমোনিয়া এমন রোগ হলে কোনও সাধারণ হাসপাতাল চিকিৎসা দিচ্ছে না। বলছে করোনার উপসর্গ; কুর্মিটোলা হাসপাতাল সহ নির্দিষ্ট ৪টা হাসপাতালে নিয়ে যেতে। সেখানে গেলে বলছে, IEDCR-এ গিয়ে টেস্ট করাতে। IEDCR-এ গেলে বলছে, কেনও সশরীরে চলে এসেছেন? ফোন করতে হবে হটলাইনে। ”

”ফোন করলে সিম্পটম শুনে আমরা স্যাম্পল কালেক্ট করবো। হটলাইনে উপুর্যপরি ফোন দিলেও তারা আর রিসিভ করছে না। সৌভাগ্যক্রমে রিসিভ করলেও জিজ্ঞেস করছে, কোনো বিদেশ ফেরত বাংলাদেশির সংস্পর্শে এসেছেন কি না? না এলে করোনা টেস্টের দরকার নেই, সাধারণ হাসপাতালে চিকিৎসা করান। সাধারণ হাসপাতাল গো-ধরে আছে, তারা এমন রোগী ভর্তি করাবে না। ক্রিটিকাল রোগী হয়তো এর মধ্যেই অগস্ত্যযাত্রায় চলে গেছেন।”

এ নিয়ে কয়েকটি হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কোন চিকিৎসক বা কর্মকর্তা প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি হননি।

তবে বেসরকারি একটি হাসপাতালের একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসিকে বলেছেন, ”করোনা ভাইরাস পরীক্ষা করার কোন ব্যবস্থা আমাদের হাসপাতালেই নেই। এখন একজন রোগীকে ভর্তি করানোর পরে যদি করোনাভাইরাস পাওয়া যায়, তখন সেটি আমাদের অন্য রোগীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে, চিকিৎসকদের মধ্যে ছড়াবে। আমরা সেই ঝুঁকি নিতে চাই না।”

”এ কারণে আমরা রোগীদের সরকার নির্ধারিত হাসপাতালগুলোয় যেতে পরামর্শ দিচ্ছি।”

সরকারি একটি হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলছেন, ”ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সর্দি-কাশির চিকিৎসা করার জন্য আলাদাভাবে ব্যবস্থা করেছে। আমাদের এখানে তো সেরকম নাই। তারপরেও ছোটখাটো রোগের চিকিৎসা আমরা দিচ্ছি। কিন্তু অনেক উপসর্গ থাকলে আমরা তাদের বিশেষ হাসপাতালগুলোতে যেতে বলি। আমাদের এখানে তো আরও রোগী আছে, তাদেরও তো সুস্থ থাকতে হবে।”

তিনি বলছিলেন, ”আমাদের চিকিৎসা দিতে আপত্তি নেই। কিন্তু আমাদের তো নিরাপত্তামূলক পোশাক personal protective equipment (PPE) থাকতে হবে। আমার হাসপাতালের কথা বলি, এখানে কোন পিপিই আসেনি। তাহলে কী পড়ে আমি রোগীদের সেবা দেবো?”

কিন্তু রোগীদের অভিযোগ, করোনাভাইরাস সন্দেহে যেসব হাসপাতাল নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, সেখানে আইইডিসিআরের রোগ পরীক্ষার ফলাফল ছাড়া ভর্তি করা হচ্ছে না। কিন্তু বিদেশ ফেরত বা ফেরতদের সংস্পর্শের ইতিহাস না থাকলে, সেরকম রোগীদের পরীক্ষা করতে রাজি নয় আইইডিসিআর।

ফলে রোগীরা মাঝখানে পড়ে চিকিৎসাহীনতার শিকার হচ্ছেন।

বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে রোগীদের চিকিৎসা পাওয়া নিয়ে এই ভোগান্তির বিষয়টি উঠে আসে।

আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ”আমরা এই ধরণের তথ্য পাচ্ছি, প্রকাশ্যেই দেখতে পাচ্ছি যে, এই ধরণের বিষয়গুলো হচ্ছে। অনেকদিন ধরেই এই সমস্যা হচ্ছে, আমরা বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। সমস্যাটি সমাধান করার জন্য আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করছি।”

”প্রত্যেকটা হাসপাতালের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে, কথা বলে এই সমস্যাটি কীভাবে সমাধান করা যায়, আমরা সর্বাত্মকভাবে সেই চেষ্টা করছি। ”

পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা বলছেন, ”কি কি পদক্ষেপ নিলে কীভাবে মোকাবেলা করা যাবে, কী করলে চিকিৎসকরা ভীতি কাটিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দেবেন, সেসব নিয়ে অনেক রকমের চিন্তাভাবনা চলছে। আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি, আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি পরিস্থিতির উন্নতি হবে।”

”আমি বলবো, ছোটখাটো অসুস্থতা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার দরকার নেই। ছোটখাটো অসুখ বাড়িতে থেকেই সুস্থ হয়ে যাওয়া সম্ভব।” তিনি বলছেন।

এসএইচ-০৪/১৯/২০ (সায়েদুল ইসলাম, বিবিসি)