বিশ্বে কোথাও কোনো সুখবর নেই

করোনাভাইরাসের প্রাদূর্ভাব নিয়ে কোথাও কোনো সুখবর নেই। গোটা বিশ্ব এক প্রকার লণ্ডভণ্ড অবস্থা। গতকাল ইতালির এক তরুণ ফুটবলারের মৃত্যু হয়েছে। লন্ডনে অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন আরেকজন তরুণ ইতালীয় নাগরিক। প্রায় এক সপ্তাহ যাবৎ ওই তরুণ অসুস্থ ছিলেন। বারবার হাসপাতালে ফোন করার পরেও তাকে কোনো চিকিৎসক দেখতে আসেননি বা হাসপাতালে নেওয়া হয়নি। শেষ মুহূর্তে যখন হাসপাতালে নেওয়া হয় ততক্ষণে তার মৃত্যু অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায়।

এই দূর্ভাগ্যজনক মৃত্যু নিয়ে ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুইজি দি মাইয়ো ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘ইতালীয় ওই তরুণকে বিনা চিকিৎসায় হত্যা করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ইতালিতে কোনো ব্রিটিশ নাগরিক অসুস্থ হলে একই রকম চিকিৎসা পেতেন যেমনটা পান ইতালীয় নাগরিকরা।’

ইতালি থেকে যুক্তরাজ্যে যাওয়া অনেক বাংলাদেশি অভিবাসী জানিয়েছেন তারা সবাই আতঙ্কে আছেন। অসুস্থ হলে সুচিকিৎসা না পাওয়ার ভয়ে আছেন।

এদিকে দিনে দিনে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। দুদিন আগে নাপলির আতঙ্কিত মানুষরা একটি সুপারমার্কেটে হামলা করে খাবার লুট করার চেষ্টা করে, যা পরবর্তীতে পুলিশ নিয়ন্ত্রণে আনে।

এত এত খারাপ সংবাদের মধ্যেও কিছু উদাহরণ সৃষ্টি করার মতো সংবাদের জন্ম দিচ্ছেন হৃদয়বান মানুষরা। ইতালির বিভিন্ন শহরে বসবাসরত বাংলাদেশিরা অনলাইনে ও বাংলাদেশি খাবারের দোকানে বাক্স রেখে অর্থ সংগ্রহ করছেন। সেই অর্থ তুলে দিচ্ছেন স্থানীয় পৌরসভার করোনা তহবিলে। ব্যক্তিগতভাবেও এগিয়ে আসছেন অনেকে। এমনই একজন উদাহরণ সৃষ্টিকারী মানুষ আনকোনা শহরের মনিরুজ্জামান বাবু। তিনি নিজ উদ্যোগে ইতালির পুলিশ বিভাগে ও হাসপাতালে ছয়শ পিপিই সরবরাহ করেছেন। যা স্থানীয় পত্রিকায় গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে।

ইতালির জাহাজ নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে জড়িত মনিরুজ্জামান বাবু বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের প্রায় ৬০ শতাংশ বাংলাদেশি। তারা সবাই ভালো আছেন। ইতালির আইন মেনে বাসায় আছেন। আমরা নিয়মিত তাদের খোঁজখবর রাখছি। কোনো সমস্যা হলে সহযোগিতার চেষ্টা করছি।’

‘অর্থনৈতিকভাবে যারা সামর্থ্যবান এই সংকটকালে মানবিক দায়িত্ব নিয়ে তাদের এগিয়ে আসা উচিত,’ যোগ করেন তিনি।

ইতালির পরেই স্পেনে করোনার প্রাদূর্ভাব সব থেকে বেশি। সেখান থেকে বাংলা ভিশনের সাংবাদিক মিরন নাজমুল জানান, স্থানীয় মিডিয়ার জরিপে উঠে এসেছে এখন স্পেনের প্রায় ৯৭ শতাংশ মানুষ আতঙ্কের মধ্যে আছে। বিশেষ দরকার ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। শহরাঞ্চল একদম ফাঁকা, সুনশান।

স্পেনের হাসপাতালগুলোর দুরাবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে মিরন বলেন, ‘সে দেশের একজন চিকিৎসক বলেছেন, হাসপাতালে মারা যাওয়ার চেয়ে বাসায় মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া ভালো। চিকিৎসকের এই কথা থেকে বোঝা যায় স্পেনের হাসপাতালগুলো এখন কী করুণ পরিস্থিতির মধ্যে আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘স্পেনে প্রায় ৪০ হাজার বাংলাদেশি অভিবাসী বসবাস করেন। এর মধ্যে একজনের মৃত্যুসহ প্রায় অর্ধশতাধিক বাংলাদেশি আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ নিশ্চিত হওয়া গেছে।’

ইতালির হটস্পট মিলানো থেকে প্রবাসী সাংবাদিক নাজমুল হোসেন বলেন, ‘এখন আর করোনাক্রান্তের সংবাদ দেখতে বা বলতে ভালো লাগে না। আমরা সবাই আতঙ্কের মধ্যে আছি। আজ সংক্রমণের মাত্রা কিছু কমে তো কাল আবার বেড়ে যায়। কোথাও কোনো সুখবর নেই।’

তিনি জানান, প্রতিদিনই পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ছে। সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে মানুষের পাশে থাকতে। কিন্তু, সংক্রমণের মাত্রা যদি কমিয়ে আনা না যায় তবে কতক্ষণ টিকে থাকা যাবে সেটাই এখন বড় দাগের প্রশ্ন হয়ে উঠে এসেছে।

অষ্ট্রেলিয়ায় অভিবাসী সর্দার রুমি জানান, সে দেশের অবস্থা এখনো ভয়াবহ আকার ধারণ না করলেও প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। মানুষের মধ্যে ভয়, আতঙ্ক বাড়ছে। সরকার থেকে মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হলেও মানুষের আতঙ্ক কমছে না।

রুমি বলেন, ‘মেলবোর্ন অষ্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় আক্রান্ত অঞ্চল। এখানকার অন্য সব বাসিন্দাদের মতো বাংলাদেশি অভিবাসীরাও চরম দুঃসময় পার করছেন।’

ফ্লোরিডা থেকে ব্যবসায়ী টিটু বেপারী বলেন, ‘আমেরিকার কিছু অঞ্চলে লকডাউন করা হয়েছে। তবে অনেকেই এখনো করোনা সংক্রমণকে গুরুত্বে নিতে চাইছে না। তারা আগের মতোই প্রটেকশন ছাড়া ঘোরাফেরা করছে। যদিও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সবাইকে সতর্ক করে বলেছেন, আগামী দুই সপ্তাহে আমাদের জন্য আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।’

টিটু মনে করেন, এখনি পুরা ফ্লোরিডা লকডাউন করা উচিত এবং মানুষকে ঘরে থাকতে বাধ্য করা উচিৎ।

লন্ডন থেকে রেহানা খান বলেন, ‘প্রতিদিনই পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। এখনি যদি শতভাগ লকডাউন করা না হয় তবে আরও খারাপ পরিস্থিতিকে আহবান করা হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যৌথ পরিবারগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কোনোভাবে একজন আক্রান্ত হলে অন্যদের মধ্যেও তা ছড়াচ্ছে। এছাড়া সাহায্যকর্মী ও করোনা টেস্টের কিটের অভাব দেখা যাচ্ছে।’

রেহানা জানান, সরকার থেকে আড়াই লাখ স্বেচ্ছাসেবক আহবান করা হয়েছে। জনগণের মধ্য থেকে এই আহবানে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে।

ডেনমার্ক থেকে সোহেল আহমেদ জানান, সেখানে আগে থেকেই লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। যে কারণে সংক্রমণের মাত্রা এখনো মহামারি আকার ধরণ করেনি। তবে প্রতিদিনই জনমনে আতঙ্ক বাড়ছে। মানুষজন খাবারসহ নিত্য দরকারি জিনিস কিনে মজুত করছেন।

সোহেল বলেন, ‘ডেনমার্কে প্রায় আড়াই হাজার বাংলাদেশি অভিবাসী বসবাস করেন। তাদের কেউ এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা যায়নি।’

পর্তুগালের লিসবন থেকে আব্দুল জলিল জানান, সেখানে প্রায় তিন হাজার বাংলাদেশি অভিবাসী বসবাস করেন। তাদের সবাই এখন পর্যন্ত ভালো আছেন। দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। খাবারের দোকান ও ওষুধের দোকান ছাড়া সব বন্ধ।

তিনি বলেন, ‘ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো এ দেশের সরকার থেকে এখন পর্যন্ত জনগণের জন্য বিশেষ কোনো অর্থিক সহযোগিতার ঘোষণা দিতে শোনা যায়নি।’

পোল্যান্ড থেকে মেহেদি হাসান জানান, সেখানে সরাসরি লকডাউন করা না হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পার্ক, সিনেমা হলসহ জনসমাগম হয় এমন সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া বাইরে ঘোরাঘুরির উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘প্রতিনিয়ত মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। বিশেষ করে হাসপাতালগুলো থেকে সাধারণ রোগীরা ভয়ে বাসায় চলে যাচ্ছেন।’

মেহেদি জানান, পোল্যান্ডে প্রায় ৪০ হাজার বাংলাদেশি অভিবাসী রয়েছেন। এর বড় অংশ রেস্টুরেন্টে কাজ করেন। কিন্তু, রেস্টুরেন্টগুলোয় বসে খাওয়া বন্ধ করা হলেও টেকঅ্যাওয়ের ব্যবস্থা চালু আছে বিধায় কেউ এখনো চাকরিহারা হননি।

এসএইচ-০৭/০২/২০ (অনলাইন ডেস্ক, দ্য ডেইলি স্টার)