করোনাভাইরাস ভীতি পাল্টে দিচ্ছে মানুষের মনোজগত

করোনাভাইরাস যেভাবে আমাদের চিন্তা-ভাবনার জগত দখল করে ফেলেছে, এমনটা যে কোনো রোগের ক্ষেত্রেই খুব বিরল।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিটি সংবাদমাধ্যম- রেডিও, টেলিভিশন জুড়ে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত খবর রয়েছে। সামাজিক মাধ্যমেও নানারকম তথ্য, উপাত্ত, পরামর্শ, গুজব ইত্যাদি ছড়িয়ে রয়েছে।

আক্রান্ত ও মৃত ব্যক্তিদের সংখ্যা বৃদ্ধির নানা খবরে মানসিক উদ্বেগ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে, স্বাভাবিকভাবেই যার প্রভাব পড়ছে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর।

কিন্তু রোগটি নিয়ে অব্যাহত ভীতি আমাদের মানসিকতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

সংক্রামক এই ভাইরাস নিয়ে অব্যাহত ভীতির কারণে মানুষের চিন্তা-ভাবনায় পরিবর্তন আসতে পারে।

বিশেষ করে সামাজিক মেলামেশা, বিচার ক্ষমতা আরও বেশি রক্ষণশীল হয়ে উঠতে পারে।

অভিবাসন, যৌন স্বাধীনতা ও সমতা নিয়ে মানুষের ভাবনায় পরিবর্তন আসতে পারে। এমনকি আমাদের রাজনৈতিক মতাদর্শেও পরিবর্তন ঘটাতে পারে করোনাভাইরাস।

করোনাভাইরাসের ফলে এর মধ্যেই অহেতুক ভীতি এবং বর্ণবিদ্বেষের লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করেছে।

কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণার পূর্বাভাসগুলো যদি সঠিক হয়, তাহলে সামাজিক ও মনস্তত্ত্বের ক্ষেত্রে বড় ধরণের পরিবর্তন আসতে পারে।

মানব মনস্তত্ত্বের অন্যান্য বিষয়গুলোর মতো রোগব্যাধির ক্ষেত্রে আচরণের বিষয়টি বোঝার জন্য ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে।

আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা আবিষ্কারের আগে সংক্রামক ব্যাধি ছিল মানুষের টিকে থাকার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।

তখন মানুষের শরীরে যে প্রতিরোধ ব্যবস্থা কাজ করতো, তার ফলে মানুষ খানিকটা ক্লান্ত, ঘুমকাতুরে বোধ করতো।

তখন আমাদের পূর্বপুরুষরা তাদের নিয়মিত কার্যকলাপ, যেমন শিকার করা, জড়ো হওয়া বা শিশুদের লালনপালন করার মতো কাজগুলো ঠিকভাবে করতে পারতো না।

কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ার ক্ষেত্রে মানসিক ও শারীরিক অনেক প্রতিরোধ কাজ করে।

যেমন অসুস্থ হলে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। তার মানে তাপমাত্রা বাড়িয়ে শরীর মোকাবেলার চেষ্টা করে।

কিন্তু শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া মানে শরীরের খাদ্য ব্যবহারের হারও বেড়ে যাওয়া। যখন খাবার দুর্লভ হয়ে ওঠে, তখন সেটা কঠিন হয়ে পড়ে।

এর অন্যতম কারণ হচ্ছে আচরণগত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

যা কিছুই আমাদের শরীরের জন্য খারাপ হতে পারে, সেটা আমরা এড়িয়ে যেতে চাই, তার বিরুদ্ধে এক ধরণের প্রতিরোধমূলক আচরণ তৈরি করি।

যেমন যেসব খাবারের গন্ধ খারাপ, আমরা ধরে নেই সেগুলো অপরিচ্ছন্ন। আমরা সম্ভাব্য সংক্রমণ থেকে অবচেতনভাবে এড়িয়ে যেতে চাই।

অনেক সময় পচা কোন খাবার খেয়ে ফেলার পর আমাদের প্রাথমিক আচরণ হয় বমি-বমি ভাব আসা।

যার মাধ্যমে শরীরের ভেতর সংক্রমিত হওয়ার আগেই আমরা সেই বিষাক্ত জিনিসটিকে বের করে দিতে চাই।

ভ্যাঙ্কুভারের ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ার অধ্যাপক মার্ক স্কলার বলছেন, “এটা অনেকটা মেডিকেল ইনস্যুরেন্সের মতো। এটা থাকা ভালো, কিন্তু যখন আপনি সেটা ব্যবহার করা শুরু করবেন, তখন দ্রুত ফুরিয়ে যাবে।”

গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব জিনিস আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা দিয়েছে, সেগুলো আমাদের মনের ভেতরে থেকে যায়। ফলে এ ধরণের কোন পরিস্থিতি তৈরি হলে, যা আমাদের ভবিষ্যতে বিপদে ফেলতে পারে, সেগুলো আমরা এড়িয়ে যাই।

মানুষ যেহেতু সামাজিক জীব, অনেকের সঙ্গে একত্রে মিলেমিশে থাকতে অভ্যস্ত, তাই রোগের বিস্তার ঠেকাতে তখন মানুষের সাথে চলাফেরা, মেলামেশার ধরণের ওপরেও পরিবর্তন আসে। ফলে রোগের সংক্রমণ এড়াতে মানুষ সামাজিক দূরত্ব তৈরি করতে শুরু করে।

আর্থাউস ইউনিভার্সিটি অব ডেনমার্কের অধ্যাপক লেনে অ্যারোয়ি বলছেন, অনেক সময় এ ধরণের আচরণ ভুল হতে পারে, হয়তো ভুল তথ্যের ভিত্তিতে হতে পারে, হয়তো আমাদের নীতিগত অবস্থান বা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করেও হতে পারে।

বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, যখন কোন রোগের হুমকি দেখা যায়, মানুষ সাধারণত প্রচলিত আইনকানুন বা নিয়ম মেনে চলে।

গবেষণায় দেখা গেছে, এ ধরণের রোগের ক্ষেত্রে মানুষজন অপরিচিত বা নতুন ধরণের মানুষের সঙ্গে মেলামেশার পরিবর্তে, পরিচিত হওয়ার বদলে চেনাজানা মানুষের মধ্যেই থাকতে পছন্দ করে। তারা এটাও মনে করেন যে, সামাজিক নিয়মকানুন ভঙ্গ করা ক্ষতিকর হতে পারে।

মহামারি নিয়ে তৈরি অনেক চলচ্চিত্রে যেমন দেখা যায়, এ রকম সংক্রমণের ক্ষেত্রে মানুষজন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, বেপরোয়া আচরণ করে।

কিন্তু ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের গবেষণায় দেখা গেছে যে, মানুষ বরং অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি নিয়মকানুন মেনে চলে।

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আমাদের অনেক সামাজিক নিয়ম বা চলাফেরার ধরন পরিবর্তন করে সংক্রমণের ঝুঁকি কমিয়ে আনা যায়।

যেমন যেখানে আমরা রান্না করি, যেভাবে আমরা মানুষের সঙ্গে মিশি, আমাদের ব্যবহৃত ময়লা যেসব স্থানে ফেলি, সেসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা যায়।

ভ্যাঙ্কুভারের ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ার অধ্যাপক মার্ক স্কলার বলছেন, ‘”মানব ইতিহাসের পুরো সময় জুড়ে দেখা যাবে, অনেক নিয়ম ও ধর্মীয় বিধি-বিধান রোগ-ব্যাধিকে দূরে রাখার জন্য কাজ করেছে। যারা সেগুলো মেনে চলেছেন, তারা সুস্থ থেকেছেন, আর যারা লঙ্ঘন করেছেন, তারা নিজেদেরও বিপদে ফেলেছেন, অন্যদের জন্যও বিপদের কারণ হয়েছেন।‘’

এ কারণেই সম্ভবত কোন মহামারীর সময় আমরা অনেক বেশি সতর্ক হয়ে উঠি।

এ কারণেই যারা ছোটখাটো অপরাধও করেন (যেমন কোন কর্মী হয়তো অফিসের সমালোচনা করেন, অথবা কোন ব্যক্তি আইন অমান্য করেছেন), তাদের ব্যাপারে আমরা বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করি।

এসব অপরাধের সঙ্গে হয়তো মহামারীর কোন সম্পর্ক নেই, কিন্তু আমরা ভাবতে থাকি, তারা এসব অন্যায় করলে রোগ ছড়ানোর মতো কাজও করতে পারেন।

নিজেদের সমাজের ব্যক্তিদের ব্যাপারে অতিরিক্ত সতর্ক হয়ে ওঠার পাশাপাশি সংক্রামক রোগের হুমকির সময় আমরা বহিরাগতদের ব্যাপারেও বেশি সচেতন হয়ে উঠি।

গবেষণায় দেখা গেছে, এরকম ক্ষেত্রে নতুন পরিচিত হতে মানুষ অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, বিশেষ করে যাদের কারো মধ্যে যদি সংক্রমিত হওয়ার ভীতি থাকে।

বিশেষ করে যারা কম আকর্ষণীয়, তাদের ক্ষেত্রে এরকম বাছবিচার বেশি করা হয়।

বিভিন্ন সংস্কৃতি থেকে আসা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও এরকম আচরণের বিভিন্নতা দেখা যায়।

মার্ক স্কলারের মতে, অসাদৃশ্য বা সামঞ্জস্যহীনতার প্রতি আমাদের ভীতির কারণে এটা ঘটতে পারে, যা অতীতের পূর্বপুরুষের কাছ থেকে আমাদের ভেতরে এসেছে।

তখন সংক্রামক রোগের সময় মানুষ নিজেদের গ্রুপ বা গোত্রের বাইরের মানুষকে এড়িয়ে চলতো। ধারণা করা হতো তাদের কাছ থেকে হয়তো রোগ আসতে পারে।

কিন্তু বর্তমান সময়ে একে কুসংস্কার এবং জেনোফোবিয়া ছাড়া আর কিছু বলা যাবে না।

লেখক অ্যারোয়ি যেমন দেখতে পেয়েছেন, সংক্রামক রোগের ভীতির কারণে অভিবাসন নিয়ে অনেক মানুষের মনোভাব বদলে গেছে।

তিনি মনে করেন, মানুষের ভেতরে যে আচরণগত প্রতিরোধ ব্যবস্থা আছে, যার কারণে মানুষ মনে করে যে, ‘দুঃখিত হওয়ার চেয়ে নিরাপদ হওয়া জরুরি’ সে কারণেই তারা এরকম আচরণ করতে পারে।

আচরণগত প্রতিরোধ ব্যবস্থা একেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে একেক রকম হয়ে থাকে। সবাই একই রকম আচরণ করবে না।

অ্যারোয়ি বলছেন, “কিছু মানুষের মধ্যে বিশেষভাবে স্পর্শকাতর আচরণগত প্রতিরোধ ব্যবস্থা কাজ করে, ফলে সংক্রমণের ঝুঁকি আছে, এসব সব কিছুর ক্ষেত্রে তারা জোরালো আচরণের প্রকাশ ঘটায়।”

গবেষণা বলছে, এ ধরণের মানুষ সামাজিক নিয়মকানুনের প্রতি বেশি শ্রদ্ধাশীল থাকে এবং চেনা-জানা মানুষের বাইরে বহিরাগতদের ব্যাপারে বেশি কঠোর আচরণ করে। তাদের সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনাও কম।

ইউনিভার্সিটি অব টরোন্টোর ইয়োয়েল আনবান বলছেন, করোনাভাইরাস মহামারী আমাদের চিন্তাভাবনার জগতে কী ধরণের পরিবর্তন আনছে, তা নিয়ে এখনো যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত নেই। কিন্তু আচরণগত প্রতিরোধ ব্যবস্থার যে থিওরি রয়েছে, তা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে।

তবে তিনি মনে করেন, সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বিবেচনা করলে এটা হয়তো মাঝারি ধরণের পরিবর্তন হবে। সামাজিক চিন্তাভাবনায় বিশাল কোন পরিবর্তন আসবে না।

তিনি দেখতে পেয়েছেন, ২০১৪ সালের ইবোলা মহামারীর সময় সামাজিক বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে। দুই লাখ মানুষের ওপর চালানো একটি জরিপে দেখা গেছে, সমকামীদের ব্যাপারে মানুষের মনোভাব নেতিবাচক হয়ে উঠেছিল।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সামনে যুক্তরাষ্ট্রের যে নির্বাচন আসতে যাচ্ছে, সেখানে বিভিন্ন ধরণের প্রার্থী বা নীতির ক্ষেত্রে মানুষের চিন্তাভাবনায় এই মহামারির প্রভাব দেখা যাবে কি না?

মার্ক স্কলার ধারণা করেন, এর ক্ষুদ্র একটা প্রভাব থাকতে পারে, তবে সেটা বিশেষ কোন কারণ হবে বলে তিনি মনে করেন না।

“আচরণগত প্রতিরোধ ব্যবস্থার চেয়ে মানুষের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে সরকারি কর্মকর্তারা পরিস্থিতি সামলাতে কী করেছেন বা করেননি, সেটা,” তিনি বলছেন।

মনোজগতের এসব পরিবর্তন জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলুক বা না ফেলুক, করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের ব্যক্তিগত আচরণের ওপর কী প্রভাব ফেলছে, সেটাই বরং বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা কি অন্যদের প্রতি বেশি সচেতন হয়ে উঠছি, অন্যদের আচরণ বিচার বিশ্লেষণ করছি, নিয়মকানুনের গুরুত্ব কি বুঝতে পারছি? আমাদের চিন্তাভাবনা কি স্বাভাবিক রয়েছে?

নাকি হাজার বছর আগে সংক্রামক রোগ ছড়ানোর সময় আমাদের পূর্বপুরুষরা যে আচরণ করেছিলেন, সেটাই আমরা অবচেতনে প্রকাশ করে চলেছি।

এসএইচ-০৭/০৪/২০ (অনলাইন ডেস্ক, বিবিসি)