সংসদ সদস্যদের বাড়াবাড়ি বন্ধের নির্দেশ

আওয়ামী লীগের টিকিট পেয়ে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর যারা দলে গ্রুপিং সৃষ্টি করেছে এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত আছে তাদের সতর্ক হতে বললেন দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবনে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত দলের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে তিনি এই নির্দেশনা দেন। প্রায় এক বছর পর অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা আমাদের সময়ের কাছে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

সূত্র জানায়, এমপি ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের দ্বন্দ্ব চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য সাংগঠনিক দায়িত্বে নিয়োজিত নেতাদের নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি বলেন, শুধু দলের রাজনীতি করার জন্য নয়, নানা হিসাব-নিকাশ করে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়। কিন্তু দলীয় প্রতীক ও নেতাকর্মীদের প্রচেষ্টায় এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর অনেকে দলের নেতাকর্মীদের কথা ভুলে যান। এটা ঠিক নয়।

খুব দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করে দলকে সংগঠিত করতে হবে। এ সময় দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের বহিষ্কার না করে শর্তসাপেক্ষে ক্ষমা করার সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া আগামী সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার প্রণয়নের প্রস্তুতি নেওয়া, ডিসেম্বরের মধ্যে কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া এলাকায় সম্মেলন করা এবং ষড়যন্ত্র থেকে সতর্ক থেকে দলকে সংগঠিত করার আহ্বান জানান আওয়ামী লীগপ্রধান।

শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বিরতিহীনভাবে বৈঠক চলে বিকেল পর্যন্ত। সঞ্চালনা করেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। শুরুতে বিভিন্ন বিভাগের সাংগঠনিক রিপোর্ট উপস্থাপন করেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকরা। বিদেশে সফরে থাকা, সদ্য বিদেশ থেকে ফেরা এবং কোভিড ইস্যুসহ নানা কারণে বৈঠকে উপস্থিত হতে পারেননি ২০ জনের বেশি নেতা।

গণভবন সূত্র জানায়, সাংগঠনিক রিপোর্টে নোয়াখালী, বরিশাল, নাটোর, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, ফরিদপুর ও ঢাকা মহানগরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে দলীয় সমস্যার কথা উঠে আসে। বরিশাল ও নোয়াখালী বিভাগের সমস্যা সমাধানের জন্য দলের সভাপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সংশ্লিষ্ট নেতারা।

রাজশাহী বিভাগের রিপোর্ট উপস্থাপনকালে সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সমস্যা তুলে ধরেন। নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল কুদ্দুস ও সাধারণ সম্পাদক নাটোর-২ আসনের সাংসদ শফিকুল ইসলাম শিমুলের দ্বন্দ্বের প্রসঙ্গ উঠে আসে। এ সময় এই দুই নেতার ভূমিকা ও বিতর্কিত কর্মকা- নিয়ে আলোচনা হয়। একপর্যায়ে শেখ হাসিনা দ্রুততম সময়ে সম্মেলন করার নির্দেশ দেন। প্রয়োজনে নাটোরে বিকল্প নেতৃত্ব খোঁজার কথাও বলেন তিনি। এ সময় এসএম কামাল হোসেন ৬ নভেম্বর নাটোরে সম্মেলন ও ৭ নভেম্বর পাবনা জেলা সম্মেলন করার প্রস্তুতি আছে বলে জানান। তার প্রতিবেদনে পৌরসভা নির্বাচনে পাবনার বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রসঙ্গ উঠে আসে।

বিদ্রোহীদের প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়া শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ। তবু অনেকে নানা কারণে বিদ্রোহী হয়েছে। এ-ও সত্য তারা দীর্ঘ সময় ধরে দলে অবদান রেখেছে। সুতরাং বিদ্রোহীদের দল থেকে বহিষ্কার নয় বরং শর্তসাপেক্ষ ক্ষমা করা যেতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ পদে না দেওয়া, মনোনয়নের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় রাখা যেতে পারে।

রংপুর বিভাগের রিপোর্ট উপস্থাপন করেন সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন শফিক। এতে বিভাগের বেশ কয়েকটি স্থানে এমপিদের সঙ্গে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সংকটের কথা উঠে আসে। অন্যান্য রিপোর্টেও এমপি বনাম স্থানীয় আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব উঠে আসে।

এ সময় শেখ হাসিনা এমপিদের হুশিয়ারি দেন। বাড়াবাড়ি বন্ধ করে দলের নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে মানুষের জন্য কাজ করার নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, যারা মনোনয়ন পেয়ে জনগণের রায় নিয়ে এমপি নির্বাচিত হন তারা তো অনেক কিছুই পেল। অনেকে গুরুত্বপূর্ণ পদ নিয়েও নিজেদের বিকাশ ঘটানোর সুযোগ পেল। কিন্তু যারা কিছু পেল না তাদের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। সবার সঙ্গে মিল রেখে দলের স্বার্থে কাজ করতে হবে। আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলার জন্য দলকে সংগঠিত করার বিকল্প নেই।

সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজমের প্রতিবেদনেও ঢাকা বিভাগে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের দ্বন্দ্বের প্রসঙ্গ উঠে আসে। এই প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর বেশি কথা হয় মাদারীপুর আওয়ামী লীগ নিয়ে। কথা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা দলের সভাপতিম-লীর সদস্য শাজাহান খান ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমসহ অন্যদের মিলেমিশে রাজনীতি করার জন্য বলেন। শাজাহান খানকে তিনি বলেন, ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি বাদ দিয়ে দলের জন্য কাজ করুন। আর বাহাউদ্দিন নাছিমকে বলেন, তোমরাই শাজাহান খানকে দলে এনেছ, এখন মিলেমিশে রাজনীতি করো। এ সময় কেন্দ্রের সঙ্গে তৃণমূলের নেতৃবৃন্দের দূরত্ব কমানোর নির্দেশ দেন তিনি।

বৈঠকে দলের বিভিন্ন উপকমিটিকে আরও সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান শেখ হাসিনা। বিভিন্ন সভা, সেমিনারের মাধ্যমে যেসব প্রস্তাব আসবে তা আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে যুক্ত করার নির্দেশনা দিয়ে তিনি বলেন, দলকে সংগঠিত করার পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে। এ সময় তিনি বিভেদ ভুলে আসন্ন স্থানীয় ও উপনির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করার আহ্বান জানান।

বৈঠক শেষে বিকালে গণভবনের মূল ফটকের সামনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, করোনা মহামারীকালে প্রায় এক বছর পর এই সভা হলো। তিনি জানান, পাবনায় পৌরসভা নির্বাচনে অনেকে বিদ্রোহ করেছিল, ২০ জনের মতো। তারা ক্ষমা চেয়ে একটা চিঠি দিয়েছিল, নেত্রী তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, যারা দলের শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে কাজ করছে বিভিন্ন জায়গায়, তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। কাউকে কোনো ব্যাপারে ছাড় দেওয়া যাবে না।

বৈঠকে সাংগঠনিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়া এবং আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রস্তুতির বিষয়টি প্রাধান্য পায় বলে জানান ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, বৈঠকের মূল ফোকাস ছিল সাংগঠনিক বিষয় এবং পরবর্তী নির্বাচনে প্রস্তুতির বিষয়। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে কোন কোন বিষয় হালনাগাদ করতে হবে, তা চিহ্নিত করতে উপকমিটিগুলোকে বলা হয়েছে।

সাংগঠনিক রিপোর্ট সম্পর্কে ওবায়দুল কাদের বলেন, কিছু কিছু ছোটখাটো কলহ-বিবাদ আছে, সেগুলো মীমাংসা করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে ওবায়দুল কাদের বলেন, নোয়াখালীর ব্যাপারে কোনো কথা হয়নি। স্বপন (আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, সাংগঠনিক সম্পাদক) সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটি কাঠামো দাঁড় করিয়েছেন সমাধানের জন্য। তিনি দেশের বাইরে আছেন। ফিরে এলে পরে প্রকাশ করা হবে। এটা নেত্রীও অবহিত আছেন।

তিনি আরও বলেন, অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র চলছে সরকারের বিরুদ্ধে। যতই নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে ততই অপপ্রচারের মাত্রা বাড়ছে। এসব অপপ্রচারের জবাব দিতে হবে। চক্রান্তমূলক তৎপরতার বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। মহামারীকালে মানুষের পাশে যেভাবে দলের নেতাকর্মীরা দাঁড়িয়েছে, তাতে শেখ হাসিনা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলে জানান ওবায়দুল কাদের।

সূত্র জানায়, বৈঠকে শেখ হাসিনা খুবই প্রাণবন্ত ছিলেন। অনেক দিন পর দলের নেতৃবৃন্দকে কাছে পেয়ে তাকে উচ্ছ্বসিত দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে তিনি বক্তব্যে বলেন, অনেক দিন ধরে বলা চলে প্রায় গৃহবন্দি জীবনযাপন করেছি। আজ সবাইকে কাছে পেয়ে ভালো লাগছে।

এসএইচ-০২/১০/২১ (অনলাইন ডেস্ক)