চাপে জামায়াত, বিএনপি খুঁজছে গ্রেপ্তারের কারণ

সেক্রেটারি জেনারেলসহ শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার পর চাপে পড়েছে জামায়াতে ইসলামী। দুই মাস ধরে সারাদেশে ছাত্র, যুব ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একাধিক বৈঠক করে যখন সংগঠন গুছিয়ে এনেছে তখনই নেতাদের গ্রেপ্তারে বড় ধাক্কা খেল দলটি। এরই মধ্যে ছাত্রদলের সাবেক সভাপতিসহ ৫ নেতা এবং কিছুদিন আগে ছাত্রদলের আরও তিন নেতাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ মুহূর্তে বিএনপির কোনো আন্দোলন বা অন্য কোনো কর্মসূচিও নেই; এর পরও কেন এই গ্রেপ্তার- এর কারণ খুঁজছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা।

রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারানো জামায়াতে ইসলামীর নেতারা বলেন, সামনে যারাই সরকারবিরোধী আন্দোলনের ডাক দেবে, তাদের সঙ্গে রাজপথে নামবে জামায়াত। দলের এই সিদ্ধান্ত থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদারে মাঠ গোছাতে সারাদেশ সফর করেন কেন্দ্রীয় নেতারা। এই সফরের ফল পর্যালোচনা করতেই ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় গত সোমবার দলটির সেক্রেটারি জেনারেলসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতারা বৈঠকে বসেন। সেখান থেকেই ৯ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তারদের বড় অংশই জামায়াতের ‘রাজনীতি ও নির্বাচন’ সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। ফলে তাদের গ্রেপ্তারে দলের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন দলটির নেতাকর্মীরা।

এই অবস্থায় গত বুধবার রাতে উত্তরার বাসা থেকে জামায়াতের নায়েবে আমির ও শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা আ ন ম শামসুল ইসলামকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটক করেছে বলে অভিযোগ করেছেন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। গতকাল বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে তিনি এ অভিযোগ জানিয়ে বলেন, এ ছাড়াও গত দুদিনে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জামায়াত-শিবিরের ১৫ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

জামায়াতের একাধিক নেতা বলেন, হঠাৎ করে তাদের কোনো কোনো নেতা গ্রেপ্তার হচ্ছেন। ফলে নেতাকর্মীদের মধ্যে গ্রেপ্তার আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এই অবস্থায় সবাইকে সতর্কভাবে চলাফেরার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স জানান, গত বুধবার রাতে ধানমন্ডি থেকে ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা রাজীব আহসান, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আব্দুর রহিম হাওলাদার সেতু, বরিশাল দক্ষিণ জেলা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক এস এম আশরাফুল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম রাহুলসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

হঠাৎ করে এভাবে বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ভাবিয়ে তুলেছে বিএনপিকে। কোনো কর্মসূচি না থাকলেও কেন এভাবে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে এর কারণ খুঁজতে শুরু করেছে দলটি। বিএনপির কোনো কোনো নেতা মনে করেন, নির্বাচন কমিশন গঠনকে সামনে রেখে বিএনপি আন্দোলনের পরিকল্পনা করছে। তা ব্যর্থ করতেই নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আবার কোনো কোনো নেতা মনে করেন, সরকারের দুর্বলতা ঢাকতেই বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য এহসানুল মাহবুব জুবায়ের আমাদের সময়কে বলেন, জামায়াত নেতাদের গ্রেপ্তারের ঘটনা সরকারের বাড়াবাড়ি ছাড়া কিছু নয়। এটি একটি অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এসব করে লাভ হবে না। কারণ জামায়াতের বিরুদ্ধে এই ধরনের গ্রেপ্তার নতুন নয়।

এদিকে, গত সোমবার দলের সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পরওয়ারসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেপ্তারের পর বিএনপির কাছ থেকে তাৎক্ষণিক বিবৃতি প্রত্যাশা করেছিল জামায়াত। এই নিয়ে জামায়াতের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করলেও তাৎক্ষণিক বিবৃতি দেয়নি বিএনপি। পরদিন বিবৃতি দিলেও সেখানে সরাসরি জামায়াত বা দলটির নেতাদের নাম উল্লেখ করা হয়নি, বরং ‘বিরোধী দলের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ’ বলা হয়েছে।

বিবৃতিতে জামায়াত নেতাদের নাম উল্লেখ না করার কারণ জানতে চাইলে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা আমাদের সময়কে বলেন, যারা ‘বিএনপি-জামায়াত’ ব্র্যান্ডিং করে বিদেশিদের কাছ থেকে সুবিধা নিতে চায়, তাদের দলের নীতিনির্ধারকরা কোনো সুযোগ দিতে চাচ্ছে না। এ কারণে জামায়াত নেতাদের নাম উল্লেখ না করে কৌশলে বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ দুই নেতা বলেন, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর জামায়াত টিকে থাকতে রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ করে সামাজিক কার্যক্রম শুরু করে। এর পর গত মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতায় ঢাকাসহ সারাদেশে ঝটিকা বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সক্রিয় হয় দলটি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সরকার লকডাউন তুলে নিলে জামায়াত তাদের সাংগঠনিক কর্মকা- আরও জোরদার করে। সিদ্ধান্ত নেয় যারাই সরকারবিরোধী আন্দোলনের ডাক দেবে, তাতে অংশ নেবে জামায়াত। এজন্য সার্বিক প্রস্তুতিও নেয় জামায়াত। সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পরওয়ার সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি দেন। আগাম বক্তব্য দিয়ে জামায়াতের মধ্যেই কঠোর সমালোচনায় পড়েন তিনি। জামায়াত নেতাদের ধারণা, ওই বক্তব্যের কারণেই সরকারের টার্গেটে পড়েছেন গোলাম পরওয়ার। তা ছাড়া এই ধরনের বৈঠকের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জানার কথা নয়।

জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, আমরা যতদূর জেনেছি, জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করতে বিএনপির ওপর দেশি-বিদেশি নানা চাপ রয়েছে। বিএনপির প্রভাবশালী কয়েকজন নেতাও বিএনপিকে জামায়াত ছাড়াতে জোরালোভাবে কাজও করছেন। তবে জোটের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া না বলা পর্যন্ত জামায়াত বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটেই থাকবে।

জামায়াত নেতারা জানান, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য জামায়াতও কাজ করছে। এই অবস্থায় জামায়াতকে যদি বিএনপি ছেড়ে দেয় তা হলে আরও চাপে পড়বে দলটি। সেক্ষেত্রে বিকল্প চিন্তা নিয়ে রেখেছে জামায়াত। ২০-দলীয় জোটের শরিক দলগুলোসহ সমমনা রাজনৈতিক দল নিয়ে বিকল্প জোট করবে জামায়াত। দলটির ধারণা বিএনপি বিরোধীদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমর্থনও তারা পাবেন।

যদিও বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, এই মুহূর্তে জামায়াত ছেড়ে দেওয়ার কোনো চিন্তা বিএনপির নেই। বরং জোট ঠিক রেখে কীভাবে জাতীয় ঐক্য করা যায় তা নিয়ে তারা কাজ করছেন।

এসএইচ-০৪/১০/২১ (অনলাইন ডেস্ক)