সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারতের আপত্তি, বাংলাদেশের জবাব

বাংলাদেশ-ভারতের এমন কিছু ইস্যু রয়েছে যা দুই দেশের সম্পর্কে কাঁটার মতো বিধছে৷ সম্প্রতি সমুদ্রসীমার একটি মীমাংসিত বিষয় নিয়ে ভারত নতুন করে ‘বিরোধ’ সৃষ্টি করায় বাংলাদেশের বিশ্লেষকরা রীতিমতো বিস্মিত৷

তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি বন্টন, ভারতের নাগরিকত্ব আইন, ভারসাম্যহীন বাণিজ্য এবং সীমান্ত হত্যাও সমস্যা হিসবে রয়ে গেছে৷

গত ১৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বঙ্গোপসাগরের মহীসোপানে ভারতের কিছু দাবির ব্যাপাারে আপত্তি জানিয়ে জাতিসংঘকে চিঠি দেয়া হয়৷ এর আগে গত ১৩ এপ্রিল এ বিষয়ে জাতিসংঘকে নিজেদের আপত্তির বিষয়টি জানিয়েছিল ভারত৷

জানা গেছে, ভারত যে রেখা টেনেছে সেখানে বাংলাদেশের কিছু অংশ তারা নিজেদের সীমায় দেখিয়েছে৷ এই বিরোধের উৎপত্তি ২০০৯ সালে৷ ২০১১ সালে বাংলাদেশ নিজের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করে জাতিসংঘের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ বিষয়ক কমিশনে পাঠায়৷ ২০১৪ সালে বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা নির্ধারণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে জয়লাভ করে৷ রায় ভারতের বিপক্ষে যায়৷ বাংলাদেশ ২০২০ সালে আদালতের নির্দেশনা মেনে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত সংশোধিত সমুদ্রসীমার মানচিত্র জমা দেয়৷

২০১৯ সালে ভারত সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধ বাংলাদেশের সাথে আলাপ করে মিটিয়ে ফেলার কথাও বলেছিল৷ বাংলাদেশ তাতে সায়ও দেয়৷ কিন্তু ভারত এখন একতরফাভাবে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় তাদের অধিকার দাবি করছে৷

এদিকে বাংলাদেশের সাথে ভারতেরঅভিন্ন নদীর পানিবন্টনের সমস্যার সমাধানও হচ্ছে না৷ বিশেষ করে তিস্তার পানিবন্টন নিয়ে কোনো চুক্তি এখন নেই৷ ১৯৯৬ সালে শুধুমাত্র গঙ্গা চুক্তি হয়েছিল৷

কিন্তু তিস্তাসহ ৮টি নদীর পানিবন্টনের কোনো চুক্তি নেই৷ তিস্তার পানিবন্টন নিয়ে অনেক পানি ঘোলা হয়েছে৷

বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কে আরেকটি সংকটের জায়গা হলো সীমান্ত হত্যা৷ সীমান্তে হত্যার সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনা এবং সীমান্তে কোনো প্রাণঘাতি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করার বিষয়ে ভারতের শীর্ষ পর্যায় থেকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে অনেক দিন ধরেই৷ তারপরও সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা কমছে না৷ গত বছর সীমান্তে ৫২ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন৷

একইসঙ্গে ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইন এবং নাগরিকপঞ্জি বাংলাদেশকে চাপে রেখেছে৷ এসবের পাশাপাশি আছে ভারসাম্যহীন বাণিজ্য এবং অশুল্ক বাধা৷ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের এখন বাণিজ্য ঘাটতি চার হাজার ৬৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার৷

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘‘ভারতের সাথে বাংলাদেশের অনেক অমীমাংসিত ইস্যু আছে৷ তারপরও ভারত কেন একটি মীমাংসিত ইস্যুকে আবার বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে তা আমি বুঝতে পারছি না৷ আমার কাছে এটা বিস্ময়কর মনে হয়েছে৷ তারা কোন চিন্তায় এই কাজ করছে, তা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না৷”

তিনি আরো বলেন, ‘‘সমুদ্রসীমা নিয়ে অমীমাংসিত ইস্যু আছে৷ কিন্তু মহীসোপানের যে অংশ তারা দাবি করছে, তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই৷ এটা আদালতের মাধ্যমে নিস্পত্তি হয়েছে৷ একটি নিস্পত্তি হওয়া বিষয়, তারা তাদের পক্ষে কোনো সিদ্ধান্ত পাবে না জেনেও কেন বিতর্ক তৈরির চেষ্টা করছে সেটা ভেবে দেখার বিষয়৷”

ভারতের এই নতুন দাবিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদও বিস্ময় প্রকাশ করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘ভারতের সাথে তার কোনো প্রতিবেশীরই সম্পর্ক ভালো না৷ সর্বশেষ নেপালের সাথেও তার সম্পর্ক খারাপ হয়েছে৷ এটা দিয়ে ভারতের মানসিকতা বোঝা যায়৷”

তিনি মনে করেন, ‘‘সম্পর্কের জায়গায় ভারত একটি বড় রাষ্ট্র হিসেবে উদারতা দেখাতে পারছে না৷ তাদের রাজনীতিবিদরা যা বলেন বাস্তবে তার প্রতিফলন কমই দেখা যায়৷ হতে পারে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হচ্ছে তাই চাপে রাখতে চায়৷”

তার মতে, ‘‘তারা যে এই বিষয়গুলো সব সময় বুঝেশুনে করেন, তা আমার কাছে মনে হয় না৷ তাই আমাদেরও তাদের ব্যাপারে ধারণার পরিবর্তন আনতে হবে৷”

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কোনো একটি দেশের প্রতি ঝুঁকে থাকার নীতি নয়৷ সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়৷ সেই জায়গা থেকেই ভারত, চীনসহ সবদেশের সাথেই সুসম্পর্কবজায় রাখে বাংলাদেশ৷ তাতে প্রতিবেশী কোনো রাষ্ট্রের অভিমান বা রাগ করার কিছু নেই বলেও মনে করেন তিনি৷

তার মতে, ‘‘অমীমাংসিত সমস্যা জিইয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গে নতুন সমস্যাও তৈরি করা কখনো কাম্য নয়৷ তিস্তাসহ আরো অনেক বিষয়ের সমাধান এখনো হয়নি৷ এতে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেতিবাচক পরিবেশ তৈরি হতে পারে৷”

এসএইচ-০২/২৫/২১ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)