জুনের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ, বছর শেষে বুস্টার ডোজ

করোনা মহামারি মোকাবিলায় ২০২১ সালে বাংলাদেশের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ ছিল দেশের সব নাগরিকের জন্য টিকা নিশ্চিত করা এবং এর জন্য নানান প্রতিবন্ধকতার মুখেও পড়তে হয়েছে।

এখন পর্যন্ত দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ করোনা টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছেন। সরকারের লক্ষ্য, ২০২২ সালের জুনের মধ্যে সবাইকে ২ ডোজ টিকা দেওয়া এবং বছরের শেষ নাগাদ সবাইকে বুস্টার ডোজ দেওয়া।

সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, তারা সরবরাহসহ টিকার প্রাথমিক চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠেছে।

অন্য দেশের ওপর থেকে টিকা নির্ভরতা কমাতে দেশে টিকার প্ল্যান্ট স্থাপনেও কাজ করছে সরকার। যদিও এর অগ্রগতি বেশ ধীর। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা টিকা উৎপাদনের জন্য আগামী বছর (২০২২ সালে) একটি টিকার প্ল্যান্ট স্থাপনের বিষয়ে আশাবাদী।’

তিনি জানান, প্রাথমিকভাবে চ্যালেঞ্জ ছিল কিন্তু স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রায় ৮ কোটি মানুষকে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়ার দুর্দান্ত কাজটি করেছে।

প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি সরকার এখন ১২ বছর বা তার বেশি বয়সী শিশুদেরও টিকা দিচ্ছে এবং সীমিত পরিসরে বুস্টার ডোজ ক্যাম্পেইনও শুরু করেছে। শিগগির বুস্টার ডোজ আরও বড় পরিসরে শুরু হবে।

বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ১৩ লাখ ডোজ টিকা দেওয়া হচ্ছে। তবে শুরুতে এই কাজটি এতো সহজ ছিল না। প্রধানত ‘টিকা জাতীয়তাবাদ’, ভুল তথ্য ও জনমনে সংশয়ের কারণে গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি গণটিকা কার্যক্রম চালু করা হলে এ নিয়ে খানিকটা বেগ পেতে হয়।

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ক্রয় করা অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৩ কোটি ডোজ টিকা এবং ২০২১ সালের মধ্যে কোভ্যাক্স সুবিধার আওতায় ৬ কোটি ৮০ লাখ টিকা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে সরকার টিকাদান কার্যক্রম শুরু করে। গত বছরের ২৬ জানুয়ারি থেকে টিকার জন্য ‘সুরক্ষা’ অ্যাপের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করা শুরু হয়। কিন্তু হঠাৎ করেই সেরাম থেকে টিকা সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা আসায় প্রায় ১ মাস এই কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়। ২০২১ সালের এপ্রিলে ভারত সরকার টিকা রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে মাত্র ৭০ লাখ ডোজ দেওয়ার পর টিকা সরবরাহ বন্ধ করে দেয় সেরাম।

‘টিকা জাতীয়তাবাদ’ এর কারণে নিম্নআয়ের দেশগুলোতে টিকা সরবরাহে কোভ্যাক্স সুবিধাও ধাক্কা খায়। ধনী ও টিকা উৎপাদনকারী দেশগুলো তাদের নাগরিকদের টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়ায় ‘টিকা জাতীয়তাবাদ’ শব্দটির প্রচলন হয়।

সেরাম থেকে নিকা না পেয়ে সরকার বাধ্য হয় অন্যান্য উৎস থেকে টিকা সংগ্রহ করতে। অবশেষে চীন থেকে ১ কোটি ৫০ লাখ ডোজ সিনোফার্ম টিকা পাওয়ার পর জুনে পুনরায় টিকা দেওয়া শুরু হয়। গত আগস্টেই সিনোফার্মের আরও ৬ কোটি ডোজ টিকা ক্রয় করে সরকার।

এ ছাড়াও পর্যায়ক্রমে কোভ্যাক্স সুবিধার আওতায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১ কোটি ডোজ টিকা আসে দেশে।

কোভ্যাক্স সুবিধার আওতায় অনুদান হিসেবে পাওয়া ফাইজারের টিকাগুলোর বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ও মধ্যপ্রাচ্যগামী অভিবাসীদের দেওয়া শুরু করে সরকার।

দেশে টিকা সরবরাহ বৃদ্ধি হলে টিকাদান কর্মসূচীর গতি বৃদ্ধি পায়। সরকার টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে বয়স সীমা ৫৫ বছর থেকে কমিয়ে ৪০ নির্ধারণ করে। পরবর্তীতে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রচেষ্টায় এবং দেশের সব নাগরিককে টিকার আওতায় আনতে বয়স সীমা আরও কমিয়ে ১৮ করা হয়।

আরও বেশি মানুষকে টিকার আওতায় আনতে সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়, বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের জন্য যাদের পক্ষে অনলাইনে টিকার জন্য রেজিস্ট্রেশন করা কঠিন।

দেশের ১ হাজারেও বেশি টিকাকেন্দ্রের মাধ্যমে টিকাদানের এই বিশেষ উদ্যোগ কিছু অনিয়ম ও ভোগান্তির অভিযোগ ছাড়া বেশ ভালো ভাবেই সম্পন্ন হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্য পেশাদারদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচীর (ইপিআই) শক্তিশালী নেটওয়ার্কের কারণে অপ্রতুল জনস্বাস্থ্য সুবিধার পরেও টিকার ভালো ব্যবস্থাপনা সম্ভব হয়েছে।

টিকা উৎপাদনে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করতে ব্যর্থ হয়েছে।

গত আগস্টে চীনের সিনোফার্ম টিকা বোতলজাতকরণ, লেবেলিং ও বিতরণের জন্য একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করে সরকার। চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের ইনসেপ্টা ভ্যাকসিনস লিমিটেড সাভারে তাদের প্ল্যান্ট থেকে প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ টিকা সরবরাহ করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে তারা এখনও উৎপাদন শুরু করতে পারেনি।

গত কয়েক মাস ধরে দেশে করোনা শনাক্ত ও মৃত্যুর হার কম। কিন্তু নভেম্বরের শেষের দিকে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পরার খবর দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ওমিক্রনকে উদ্বেগজনক বলে চিহ্নিত করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকা হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যু ঝুঁকি কমায়। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা করোনা মোকাবিলার চাবিকাঠি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নাজির আহমেদ জানান, বাংলাদেশ টিকাদান কার্যক্রমের শুরুটা ভালো করেছিল। কিন্তু টিকার জন্য কেবল মাত্র একটি উৎসের ওপর নির্ভর করে থাকায় হোঁচট খেয়েছে।

তিনি বলেন, ‘তবে হোঁচট খেলেও খুব ভালোভাবে সেখান থেকে উঠে আসতে পেরেছে। কিন্তু এখনও টিকা আওতায় ডে পরিমাণ মানুষ এসেছে তা প্রত্যাশিত পর্যায়ের নয়, বিশেষ করে আমরা যখন মানুষকে বিভিন্ন ধরনের টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়ন।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইনফরমেশন ইউনিটের প্রধান ডা. শাহ আলী আকবর আশরাফি জানান, সম্পূর্ণ ডিজিটাল ভ্যাকসিন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম নিয়ে কাজ করা সহজ ছিল না।

তিনি বলেন, ‘দেশের ৪৯২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ৬৪টি জেলা অফিসে পরিসংখ্যানবিদদের দ্রুত প্রশিক্ষণ দিতে হয়েছে। সুরক্ষা অ্যাপ বিষয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে আমরা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম জুম ব্যবহার করেছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমকে শুরুতে একটি জটিল সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। সব কর্মকর্তা, ডেটা অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং সহায়ক কর্মরা সমস্যা সমাধানে ২৪ ঘণ্টাই কাজ করেছে।’

এসএইচ-০৫/০১/২২ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : দ্য ডেইলি স্টার)