যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি মোটরসাইকেল চলে ঢাকায়!

দুই চাকার বাহন মোটরসাইকেল। বাহনটি ছোট হলেও দ্রুতগামী। সড়কে যানজটের মধ্যেও অল্প একটু ফাঁকা জায়গা পেলেই স্বল্প সময়ে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যেতে এ বাহনের জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। পাশাপাশি বাড়ছে দুর্ঘটনা। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫০ দশমিক ৪৭ শতাংশ, যা আগের বছরে ছিল ১৫ শতাংশ। অথচ গত দুই বছর সড়কে অন্যান্য দুর্ঘটনা প্রায় সমান ছিল।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, গত ছয় বছরে দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা বেড়েছে ১৮ লাখের বেশি।

২০১৬ সালে দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেল ছিল ১৭ লাখ ২৪ হাজার ৩৬৯টি। ২০১৭ সালে সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২০ লাখ ৫০ হাজার ৯১৯টি তে। এরপর ২০১৮ সালে ২৪ লাখ ৪৬ হাজার ৫২২টি তে, ২০১৯ সালে ২৮ লাখ ৫৩ হাজার ৪১৯টি তে, ২০২০ সালে ৩১ লাখ ৬৪ হাজার ৪৩৫টি তে এবং সদ্য বিদায় নেওয়া বছরে (নভেম্বর পর্যন্ত) নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৫ লাখ ২ হাজার ৫৮৫টি তে।

বিআরটিএ এর তথ্য বলছে, দেশে যে পরিমাণ নিবন্ধিত মোটরসাইকেল আছে তা মোট যানবাহনের ৭০ শতাংশ। আর শুধু ঢাকা শহরেই নিবন্ধিত মোটরসাইকেল সাড়ে ৮ লাখের মতো। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মোটরসাইকেল নিবন্ধন হয়েছে ২০১৯ সালে। ওই বছর ৪ লাখ ৬ হাজার ৮৯৭টি মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হয়েছে।

কাছাকাছি পরিমাণ নিবন্ধন হয়েছে ২০১৮ সালে। ওই বছর নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩ লাখ ৯৫ হাজার ৬০৩টি।

সে হিসেবে ২০২১ সালে মোটরসাইকেল কিছুটা কম নিবন্ধিত হয়েছে। এসময় ৩ লাখ ৩৮ হাজার ১৫০টি নিবন্ধনের হিসেবে দিয়েছে বিআরটিএ। আর এই সময়ে রাজধানীতেই নিবন্ধিত হয়েছে প্রায় এক লাখ মোটরসাইকেল। সে হিসেবে প্রতিদিন নিবন্ধিত হয়েছে ২৭০টি আর পুরো দেশে নিবন্ধিত হয়েছে এক হাজার মোটরসাইকেল।

যদিও বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর হিসেবে, দেশে বছরে প্রায় ৫ থেকে ৬ লাখ নতুন মোটরসাইকেল বিক্রি হয়। যার একটি বড় অংশ নিবন্ধনের বাইরেই থাকছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (এআরআই) তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেল আছে ৮ লাখের মতো। আর রাজধানীতে নিবন্ধিতই আছে সাড়ে ৮ লাখ। এর বাইরে আরও প্রায় অর্ধ লাখ মোটরসাইকেল চলে ঢাকার রাস্তায়। অর্থাৎ, শুধু রাজধানীতে যে পরিমাণ নিবন্ধিত মোটরসাইকেল চলে পুরো যুক্তরাষ্ট্রেও সে পরিমাণ মোটরসাইকেল চলে না।

মোটরসাইকেলের সংখ্যা বাড়ার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে অ্যাপস ভিত্তিক শেয়ার রাইডিং ব্যবস্থা। অনেকে জীবিকার টানে মোটরসাইকেল ভাড়ায় চালানোর দিকে ঝুঁকেছেন।

মোটরসাইকেল বৃদ্ধির এ হারকে বটগাছের জীবনচক্রের সঙ্গে তুলনা করে এআরআই পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘বটগাছ যখন চারা অবস্থায় থাকে তখন তাকে দু’আঙুল দিয়ে তুলে ফেলা যায়। কিন্তু সেটি ডালপালা মেলে বড় হয়ে গেলে তখন উপড়ানো সম্ভব হয় না।’

এ সময় তিনি জাপানের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘দেশটিতে ২০১০ সালে মোটরসাইকেল ছিল সাড়ে ১২ মিলিয়ন। ২০২০ সালে আড়াই মিলিয়ন কমিয়ে ১০ মিলিয়নে নামিয়েছে জাপান সরকার। এতে ৫০ শতাংশ দুর্ঘটনাও কমেছে দেশটিতে।’

এআরআই পরিচালক বলেন, ‘জাপান গণপরিবহন ব্যবস্থা এবং রেল সেবা ভালো করে তাদের দেশে মোটরসাইকেলের নিবন্ধন ফি, করের হার, পার্টস এর দাম এবং পার্কিং চার্জ বাড়িয়ে দিয়েছে। এরপর তাদের দেশের মোটরসাইকেলগুলো আমাদের দেশে ছেড়ে দিয়েছে। ফলে এই বাহন এখন মহামারি আকারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে।’

এ জন্য বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণে বড় গলদ আছে বলেও জানান ড. হাদিউজ্জামান। বলেন, ‘আমাদের দেশে গণপরিবহন ব্যবস্থা পুরোপুরি দুর্বৃত্তদের হাতে। রাজনীতি যখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে তখন পলিসি এবং পরিকল্পনাগুলো ফাইলবন্দি হয়ে থাকে। অনেক আগে থেকেই পরামর্শ হচ্ছে গণপরিবহনকে আধুনিক করার। বহুবার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পলিসি উল্টো পথে হাঁটছে।’

এরই মধ্যে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে মোটরসাইকেলের নিবন্ধন ফি অর্ধেক কমিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। বিষয়টিকে মহাসংকট বলেও হুঁশিয়ারি করেন এই গবেষক। তার মতে, গণপরিবহনে স্বস্তি ফিরলে মানুষ নিজ থেকেই মোটরসাইকেল ছেড়ে দেবে। অন্যথায় সড়ক ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পরবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘ঢাকা শহরের সড়কের অবস্থা বিবেচনায় মোটরসাইকেল চালানোর উপযোগী নয়। এখানে অবশ্যই পাবলিক বাস চলাচল করা উচিত। ঢাকা শহরে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে নগর ব্যবস্থাপক যারা আছেন তাদের ব্যর্থতা রয়েছে। আর গণপরিবহন সংকট ও বেকারত্ব পুঁজি করে বিপুলসংখ্যক মোটরসাইকেল ঢাকা ও গ্রামগুলোতে নেমেছে। কোনো পরিকল্পনা ছাড়া এভাবে মোটরসাইকেল বাড়তে থাকলে একসময় মানুষের জন্য অসহনীয় যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।’

এসএইচ-০৪/১৩/২২ (অনলাইন ডেস্ক)