যেসব কারণে সেরা পদ্মা সেতু

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন হতে চলেছে আগামী ২৫ জুন। আর মাত্র তিন দিন বাকি। ইতোমধ্যে সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে এই পদ্মা সেতু। প্রমত্তা পদ্মা বিশ্বে খরস্রোতা নদীর তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।

পদ্মার প্রবল স্রোত উপেক্ষা করে আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। যার সব ধরনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায় রয়েছে। এখন নদীর উভয় তীরে দাঁড়ালেই দেখা যাচ্ছে বহুল কাঙ্ক্ষিত এই স্বপ্নের সেতু।

দ্বিতল এই পদ্মা সেতু তৈরিতে অনেক বাধাবিপত্তি ও চ্যালেঞ্জ পেরোতে হয়েছে। তবে এত কিছুর মধ্যেও যেসব কারণে পৃথিবীর অন্য সেতুর তুলনায় বিশেষ ও সবার সেরা এই পদ্মা সেতু তা আলোকপাত করছি।

চলুন জেনে নেয়া যাক কারণগুলো౼

বিশ্বের সবচেয়ে বড় পেন্ডুলাম বিয়ারিং ব্যবহার

পদ্মা সেতুতে ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’-এর সক্ষমতা ১০ হাজার টন। এখন পর্যন্ত কোনো সেতুতে এমন সক্ষমতার বিয়ারিং লাগানো হয়নি। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে টিকে থাকার মতো করে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।

ভূমিকম্প, মাটির ক্ষয়সহ সব ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে ঠিকে থাকতে সক্ষম এই পদ্মা সেতু। আর সেই সক্ষমতা গড়ে তোলার উপযোগী করেই নির্মাণ করা হয়েছে পদ্মা সেতুর অবকাঠামো।

এ ছাড়া পিলার এবং স্প্যানের মধ্যে যে বিয়ারিং থাকে সেটিতে ১০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ওজনের বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে। পৃথিবীতে এর আগে কোনো সেতুতে এমন বড় বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়নি। ফলে এই ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং পদ্মা সেতুকে অন্য সেতুর তুলনায় অসাধারণ করে তুলেছে।

পাইলের গভীরতা

খরস্রোতা পদ্মার মাটির ১২০-১২৭ মিটার গভীরে গিয়ে বসানো হয়েছে পদ্মা সেতুর পাইল। এর আগে পৃথিবীর অন্য কোনো সেতুর জন্য এত গভীরে গিয়ে পাইল বসাতে হয়নি, যা একটি রেকর্ড।

মূল সেতুতে পাইল রয়েছে ২৬৪টি। নদীর ভেতরে ও দুই প্রান্তে সেতুর ৪০টি পিলারের নিচে পাইপের মতো দেখতে পাইলগুলো বসানো হয়েছে। নদীর পাইলগুলো ভেতরে ফাঁকা, ইস্পাতের তৈরি। প্রতিটি পাইলের ব্যাসার্ধ তিন মিটার। পুরুত্ব ৬২ মিলিমিটার। একেকটি পিলারের নিচে ছয় থেকে সাতটি পাইল বসানো হয়েছে। এই পাইল নদীর তলদেশের মাটি থেকে সর্বোচ্চ ১২৫ দশমিক ৪৬ মিটার (প্রায় ৪১২ ফুট) গভীরে বসানো হয়েছে।

সবচেয়ে বড় ক্রেন ব্যবহার

সেতু নির্মাণে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রেন ব্যবহার করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে পদ্মা সেতু। পিলারের ওপর স্প্যান বসাতে যে ক্রেনটি ব্যবহৃত হয়েছে সেটি আনা হয়েছে চীন থেকে। ‘তিয়ান ই’ নামের ক্রেনটি ব্যবহৃত হয়েছে। এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ ভাসমান ক্রেনবাহী জাহাজ।

২০১৭ সালে বাংলাদেশে আসে ‘তিয়ান ই’। এই ক্রেন দিয়ে ৩ বছর ৯ মাসে ৪১টি স্প্যান বসানো হয়েছিল পদ্মা সেতুর ৪২টি পিলারের ওপর। প্রতি মাসে এর ভাড়া বাবদ গুনতে হয়েছে ৩০ লাখ টাকা। সাড়ে তিন বছরে মোট খরচ হয়েছে ১২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বিশ্বে প্রথম কোনো সেতু তৈরিতে এত দীর্ঘদিন ক্রেনটি ভাড়ায় থেকেছে। এই ক্রেনটির দাম ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

কংক্রিট ও স্টিল উভয়ের ব্যবহার

পদ্মা সেতু নির্মাণে কংক্রিট এবং স্টিল উভয়ই ব্যবহার করা হয়েছে। বিশ্বে আর কোনো সেতু নির্মাণে কংক্রিট এবং স্টিল একসঙ্গে ব্যবহার করা হয়নি। অর্থাৎ, সেতুগুলো হয় কংক্রিটে নির্মিত, না হয় স্টিলের। পদ্মা নদীর গতিপ্রকৃতি ও বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় এখানে যেকোনো সেতু নির্মাণ অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল।

বিশ্বের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং নদীশাসন ব্যবস্থা

পদ্মা সেতুর অন্য রেকর্ডটি হলো নদীশাসন সংক্রান্ত। ১৪ কিলোমিটার (১.৬ কিলোমিটার মাওয়া প্রান্তে ও ১২.৪ কিলোমিটার জাজিরা প্রান্তে) এলাকা নদীশাসনের আওতায় আনা হয়েছে। এই নদীশাসনে খরচ হয়েছে ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকারও বেশি।

পদ্মা সেতু প্রকল্প তিন জেলায় বিস্তৃত। মুন্সীগঞ্জের মাওয়া, শরীয়তপুরের জাজিরা এবং মাদারীপুরের শিবচর। ভাঙনসহ নানা কারণে পদ্মা সেতু যাতে করে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্যই নদীশাসন করা হচ্ছে। ৮ হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে এটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: পদ্মা সেতু ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতি

দেশি, বিদেশি ও নদীর নিজস্ব (গভীরতা-খরস্রোত) হাজারো প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে দেশের সবচেয়ে দীর্ঘতম এই পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের মানুষের পারাপারের জন্য উন্মোচিত হবে নবদিগন্তের দুয়ার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী সিদ্ধান্তে এখন সেই অপেক্ষায় প্রহর গুনছে দেশের মানুষ।

ইতোমধ্যে পদ্মা সেতু পারাপারের জন্য টোলের হার নির্ধারণ করেছে সরকার। গত ১৭ মে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় বিভিন্ন পরিবহনের জন্য আলাদা আলাদা টোলের হার নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। পদ্মা সেতুর (মূল সেতু) দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দুই প্রান্তের উড়ালপথ ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে সেতুর দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।

এসএইচ-১৪/২২/২২ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : সময়)