মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করছে দুদক

গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মুহাম্মদ ইউনূসহ গ্রামীণ টেলিকমের পরিচালনা পর্ষদের চারজন সদস্যের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করতে তিন সদস্যের একটি টিম গঠন করেছে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন।

এই টিম অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে দেখবে এবং তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করবে বলে জানিয়েছে কমিশনের কর্মকতারা।

কিন্তু এমন সময় দুদক এই অনুসন্ধান শুরু করতে যাচ্ছে, যার কয়েকদিনের মধ্যে অনেকটা একই ধরণের অভিযোগে একটি মামলায় রায় হওয়ার কথা রয়েছে।

দুর্নীতি দমন কমিশন জানিয়েছে, গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে সহযোগী প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর, শ্রমিক-কর্মচারীদের লভ্যাংশের টাকা লোপাট, কল্যাণ তহবিলের অর্থ বরাদ্দ না করে আত্মসাতের মতো অভিযোগ পাওয়ার পর তারা অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব মাহবুব হাসান সাংবাদিকদের বলেছেন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের একটি অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুদক এই অনুসন্ধান শুরু করেছে।

অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে:

অনিয়মের মাধ্যমে শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টনের জন্য সংরক্ষিত লভ্যাংশের পাঁচ শতাংশ লোপাট।
শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনা পরিশোধের সময় অবৈধভাবে আইনজীবীর ফিসহ অন্যান্য ফিয়ের নামে ছয় শতাংশ অর্থ কর্তন করা।

গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানি থেকে দুই হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা মানি লন্ডারিংয়ের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর।

শ্রমিক কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের বরাদ্দকৃত সুদসহ ৪৫ কোটি ৫২ লাখ ১৩ হাজার ৬৪৩ টাকা বিতরণ না করে আত্মসাৎ।

দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, শ্রমিকদের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎসহ এসব অভিযোগ জানিয়ে দুদকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছিল শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর।

সেই চিঠির অভিযোগ তদন্ত করে দেখতেই অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছে দুদক।

যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তাদের মধ্যে ড. ইউনূস ছাড়াও গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও দুইজন পরিচালক রয়েছেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে এর আগে বাংলাদেশর সরকারের শীর্ষ মহল থেকে অনেকবার নানা কারণে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে।

পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়ার পেছনে ড. ইউনূসের ভূমিকা ছিল বলে সরকারের শীর্ষ মহল থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে।

তবে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর অসন্তোষ তৈরি হয় ২০০৭-২০০৮ সাল থেকে। সেই সময় দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের নেত্রীদের রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার ‘মাইনাস টু’ পরিকল্পনায় ড. ইউনূসের জড়িত থাকার অভিযোগ করেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা।

রাজনৈতিক দলের বক্তৃতা-বিবৃতিতে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে কর ফাঁকি, বিদেশে অর্থ পাচারের মতো অভিযোগও তোলা হয়েছে।

সেসব বক্তব্য ভিত্তিহীন দাবি করে বিবৃতি দিয়েছে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পাওয়া অর্থনীতিবীদের প্রতিষ্ঠান, ইউনূস সেন্টার। কর ফাঁকি, বিদেশে অর্থ পাচারের যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে, সেসবেরও প্রতিবাদ জানানো হয়েছে বিবৃতিতে।

ইউনূস সেন্টার বলেছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা নিতান্তই কল্পনাপ্রসূত।

তিনি নিয়মিত কর রিটার্ন জমা দেন ও পরিশোধ করেন। গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি হিসাবে বেতনের বাইরে তিনি কোন অর্থ গ্রহণ করেননি। তার আয়ের মূল উৎস হলো ভাষণের উচ্চ ফি, বইয়ের রয়্যালটি ও স্থায়ী আমানতের আয়।

দুদক যে প্রতিষ্ঠানের আবেদনের ভিত্তিকে নতুন করে এই অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেই কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে একটি মামলা করেছিল। সেই মামলায় ১১ই অগাস্ট রায় ঘোষণার কথা রয়েছে। সেই মামলাতেও অনেকটা একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে।

এর এক মাস আগেই শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনা নিয়ে গ্রামীণ টেলিকমের সঙ্গে বহুদিনের এক আইনি বিরোধ আদালতের বাইরে সমঝোতা হয়েছে। এরপর গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে শ্রমিক- কর্মচারীদের ১১০টি মামলা তুলে নেয়া হয়। কিন্তু সেখানেও অনিয়মের অভিযোগ তোলা হয়েছে।

সমঝোতার ঘটনার পর গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

তবে গ্রামীণ টেলিকমের আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান খান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধে কোন অনিয়ম হয়নি।

তিনি বলছেন, ”শ্রমিকদের সঙ্গে যে সেটেলমেন্ট হয়েছে, সেটা সম্পূর্ণ আইন অনুযায়ী হয়েছে। তাদের নির্দেশনা মেনেই আইন সম্পূর্ণভাবে মেনে টাকা দেয়া হয়েছে।”

সেটেলমেন্ট নিয়ে যেসব প্রশ্ন উঠেছে, সেই প্রসঙ্গে তিনি বলছেন, ”এটি যেহেতু তদন্তাধীন ও বিচারাধীন, তাই আমরা এ বিষয়ে আদালতেই বলব।”

দুদকের নিয়ম অনুযায়ী, সোমবার যে অনুসন্ধানকারী দল গঠন করা হয়েছে, তারা এখন কলকারখানা অধিদপ্তরের অভিযোগের সত্যতা আছে কিনা, তা যাচাই করে দেখবে এবং তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করবে। এরপর তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মামলা করা বা না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন।

অবসর গ্রহণের সময়সীমা নিয়ে এক বিতর্কের পর ২০১১ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ড. মুহম্মদ ইউনূসকে অপসারণ করা হয়।

এসএইচ-০১/০২/২২ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : বিবিসি)