র‍্যাব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কেন এত মাথাব্যথা?

বাংলাদেশ পুলিশের অধীনে গঠিত এলিট ফোর্স হলো র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। সন্ত্রাস দমনের উদ্দেশ্যে ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ গঠিত হয় র‍্যাব। একই বছরের ১৪ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে বিশেষ এ বাহিনী। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস ও আনসারের সমন্বয়ে গঠিত হয় বাহিনীটি। তাদের নিজস্ব কোনো অফিসার নেই।

আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন আইন ২০০৩ অনুযায়ী, র‍্যাবের প্রতিটি ব্যাটালিয়ন অ্যাডিশনাল ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল র‍্যাঙ্কের অফিসার বা তার সমকক্ষ অফিসারের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।

গঠনের পর থেকেই বাংলাদেশের সন্ত্রাস দমনে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলছে র‌্যাব। তবুও এ বাহিনীর বিরুদ্ধে কখনও কখনও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। র‍্যাবের প্রশিক্ষণ অনেকখানি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে হলেও ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক’ কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে র‍্যাব এবং এর ছয়জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ নিষেধাজ্ঞার পরপরই বাংলাদেশের পক্ষে তা প্রত্যাহারের জোরাল উদ্যোগ নেয় সরকার। এরপরও জল কম ঘোলা হয়নি। দীর্ঘ ৮ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেনি যুক্তরাষ্ট্র।

এদিকে বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পরই হঠাৎ বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র। তারা যেন বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আয়োজন করতে চায়। র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে মার্কিন অর্থ অধিদফতরের ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোল অফিস (ওএফসি) এ-সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে।

নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা ছয় কর্মকর্তা হলেন- চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন (র‍্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক), বেনজীর আহমেদ (সাবেক র‍্যাব মহাপরিচালক, জানুয়ারি ২০১৫-এপ্রিল ২০২০), খান মোহাম্মদ আজাদ (বর্তমান অতিরিক্ত মহাপরিচালক-অপারেশন্স), তোফায়েল মুস্তাফা সরওয়ার (সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক-অপারেশন্স, জুন ২০১৯-মার্চ ২০২১), মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক-অপারেশন্স, সেপ্টেম্বর ২০১৮-জুন২০১৯), ও মোহাম্মদ আনোয়ার লতিফ খান (সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক-অপারেশন্স, এপ্রিল-২০১৬-সেপ্টেম্বর ২০১৮)।

র‍্যাব বাহিনী হিসেবে গড়ে ওঠার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পেয়েছে। এই বাহিনীর কর্মপন্থা, অনুসন্ধান, জিজ্ঞাসাবাদ থেকে শুরু করে প্রায় সবকিছুই এই দুই দেশের তত্ত্বাবধানে হয়েছে। এমনকি উইকিলিকসের তথ্যেও উঠে আসে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রশিক্ষণ অনুযায়ী র‌্যাব সন্ত্রাস দমনে কাজ করেছে। তবুও ২০২১ সালে এসে র‍্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা দিল যুক্তরাষ্ট্র। আর এর ব্যাখ্যায় নানামুখী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন দেশটির মুখপাত্ররা।

এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেন, র‌্যাব সৃষ্টি করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। তারা এই বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, দক্ষ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবকে শিখিয়েছে তাদের নিয়ম ও শৃঙ্খলা। কীভাবে মানুষের সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে, কীভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে (হাউ টু ইন্টারগেশন)– র‍্যাবকে এই সবকিছু শিখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট স্বীকার করেছে, র‍্যাব থাকায় আমাদের এখানে (বাংলাদেশ) সন্ত্রাসবাদ কমেছে।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘ আয়োজিত পুলিশপ্রধানদের সম্মেলনে বাংলাদেশ পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদকে আমন্ত্রণের পর আবারও আলোচনায় আসে নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গ। এ ছাড়া দুদেশের যেকোনো পর্যায়ের প্রতিনিধি মিলিত হলেই উঠে আসছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর বিভিন্ন তৎপরতা নিয়ে সমালোচনা, প্রশ্ন উঠছে বাংলাদেশের মানবাধিকার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গ।

সর্বশেষ মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠক করেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। বৈঠক শেষে পিটার হাস সাংবাদিকদের বলেন, আমরা কেবল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েই নয়, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছি। এ দেশের আইনশৃঙ্খলার যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে। তবে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূলের লক্ষ্যে এ দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দক্ষতা উন্নয়নে আরও কাজ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।

বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, আইন মেনেই র‌্যাব-পুলিশ তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে রাষ্ট্রদূতকে জানানো হয়েছে। ৩১ আগস্ট থেকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ আয়োজিত পুলিশপ্রধানদের সম্মেলনে বেনজীর আহমেদের যোগদানের বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে যুক্তরাষ্ট্র।

আরও পড়ুন- উন্নয়ন নিয়ে অন্যান্য দেশগুলোকে যে শিক্ষা দিতে পারে বাংলাদেশ: ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের নিবন্ধ

বুধবার রাতে এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, যখন দুটি দেশের মাঝে সম্পর্ক থাকে, তখন একটি জায়গায় মতের অমিল হলে বাকি সহযোগিতা বন্ধ থাকবে–ব্যাপারটা এমন নয়। দেখুন, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানির বাজার ইউরোপ। সেটা বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার। এগুলো অব্যাহত আছে এবং এগুলো চলছে।

সম্প্রতি পিটার হাসের দেয়া সামরিক সহযোগিতার আশ্বাসের ব্যাপারে এ বিশ্লেষক বলেন, দেখুন, সামরিক সহযোগিতা কিন্তু কখনও বন্ধ হয়নি। সবসময়ই এটা চলেছে। সুতরাং আপনি যেটা বলছেন, সেটা একটা ক্ষেত্রের কথা। সর্বক্ষেত্রে তা কখনোই প্রযোজ্য নয়। এখনও সমান তালে যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন সামরিক বাহিনীর ট্রেনিং চলছে। একটা জায়গার ইস্যুকে ধরে বসে থাকলে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে এগোনো যাবে না।

নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে করণীয় কী–এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞা যেটা আছে, সেটা সরানোর চেষ্টা করতে হবে। এ ছাড়া একই সময়ে অন্যান্য যে জায়গায় আমাদের সহযোগিতার প্রয়োজন আছে, সেটা আরও প্রসারিত করতে হবে। যেমন, জঙ্গি দমনের যে পলিসি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের, সেটাই আমাদেরও পলিসি। সেটা হচ্ছে জিরো টলারেন্স। এখানে আমাদের কথা মিলে যাচ্ছে। যখন মিলেই যাচ্ছে, তখন কেন আমরা একসঙ্গে কাজ করব না? আর র‍্যাবের সঙ্গে যে সমস্যাটা হয়েছে, সেটা নিরূপণে আমাদের অন্যান্য কূটনৈতিক তৎপরতা বহাল রাখতে হবে। যেখানে সমস্যা, সেখানে আলোচনা হবে এবং যেখানে সহযোগিতা রয়েছে, সেখানে সহযোগিতা করতে হবে।

র‍্যাবের সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যাপারে তিনি বলেন, এখন সামরিক বাহিনীর অনেক অফিসার তাদের ওখানে প্রশিক্ষণের জন্য যান। সামরিক বাহিনীর অনেক অফিসার আবার পরে র‍্যাবে আসেন। কারণ র‍্যাবের তো নিজস্ব অফিসার নেই। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আবার আমাদের মিরপুরের ডিফেন্স কলেজেও অনেকে আসেন। আমাদের এখানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে।

একই বিষয়ে জানতে চাইলে আরেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ  বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বার্থ রক্ষা করে চলে। ভূ-রাজনৈতিক ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি আছে সেখানে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ।

এসএইচ-১৬/১৭/২২ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : সময়)