তিন দিনের বাংলাদেশ সফরে এসে যা করেছিলেন প্রিন্স অব ওয়েলস

যুক্তরাজ্যসহ ১৪টি দেশের রাজা হিসাবে অভিষিক্ত হয়েছেন রাজা তৃতীয় চার্লস। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুতে সত্তর বছর উত্তরাধিকারী থাকার পর তিনি রাজা হিসাবে দায়িত্ব নিলেন।

সিকি শতাব্দি আগে একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন সেসময়কার প্রিন্স অব ওয়েলস। ওই সফরে তিনি ঢাকার একটি বস্তিতেও গিয়েছিলেন।

রাজা চার্লস সেবার রাজকীয় বিমানে চড়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। উনিশশো সাতানব্বই সালের ২৬ থেকে ২৮শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশে ছিলেন।

তার এই সফর সম্পর্কে যুক্তরাজ্যের রাজপরিবারের তথ্য সম্বলিত ওয়েবসাইট রয়্যাল ডটকমে উল্লেখ করা হয়েছে, “ফেব্রুয়ারি ২৭: আজ সকালে প্রিন্স অব ওয়েলসকে স্বাগত জানান বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। এরপর তাকে স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী।”

সেই সময় চার্লসের মিনিস্টার ইন ওয়েটিং ছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী।

যখন কোন রাষ্ট্রপ্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ কোন বিদেশি অতিথি সফরে আসেন, তখন দেশের যে মন্ত্রী বা সরকারের প্রতিনিধি তার সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে থাকেন, তাকেই বলা হয় মিনিস্টার ইন ওয়েটিং।

আবুল হাসান চৌধুরী বলছেন, ”আমি দীর্ঘদিন ইংল্যান্ডে ছিলাম। ছাত্র হিসাবে ইংল্যান্ডে থাকায় তাকে দূর থেকে জানতাম। তিনি জনমুখী অনেক ব্যাপারে আগ্রহ নিয়ে কাজ করেছেন। ফলে তাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ ছিল আমার জন্য অনেক আনন্দের। তাকে বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করার পর থেকে সবসময় আমি সাথে সাথে ছিলাম।”

ঢাকায় আসার পর তিনি মোহাম্মদপুরের টিক্কাপাড়া নামের একটি এলাকায় বস্তিবাসীদের উন্নয়নের একটি প্রকল্প দেখতে গিয়েছিলেন। কারণ এই প্রকল্পটি দুটি আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়ন করা হচ্ছিল, যে দুটি সংস্থার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন প্রিন্স অব ওয়েলস।

রয়্যাল ডটকমে বলা হয়েছে, ”ঢাকার টিক্কাপাড়ার বস্তিবাসীদের জন্য অ্যাকশন এইড রিলিফ প্রজেক্টের একজন পৃষ্ঠপোষক প্রিন্স অব ওয়েলস পরিদর্শন করেন। অ্যাকশন এইড এবং ওয়াটার এইডের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাকে জানানো হয়।”

তার সেই সফরের সময় ছবি তুলেছিলেন তখনকার অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের আলোকচিত্রি পাভেল রহমান।

তিনি বলছেন, ”প্রিন্স চার্লসের সফরের জন্য আমি দুইতিনদিন ধরে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম যে, বেল্ট ঠিক আছে কিনা, ব্যাটারির কি অবস্থা। তাকে আমি প্রথম দেখলাম এয়ারপোর্টে। সেদিন নাকি পরের দিন, আমার মনে নেই- তার সঙ্গে ঢাকার কাছেই একটা বস্তি, টিক্কাপাড়া বস্তিতে ছবি তুলতে গিয়েছিলাম।”

”বস্তিবাসী তো খুবই গরিব। সেখানে রানি এলিজাবেথের ছেলে চার্লস যে এসেছেন, তার সঙ্গে বস্তিবাসী বা তাদের কোন আলাদা করে তফাৎ মনে হচ্ছিল না। চার্লস দূরে দূরে থাকছেন বা তাদের পাশে যেতে চাচ্ছেন না, এমন কোন কিছু তার আচরণে একেবারে মনে হচ্ছিল না। খুব মনে হচ্ছিল, তিনি ঘনিষ্ঠভাবে তাদের কথা শুনছেন”।

‘সেখানে একজন রিকশাচালককে চার্লসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো। তিনি তার সঙ্গে হ্যান্ডশেক (করমর্দন) করলেন। রিকশাওয়ালা খুব ভাব নিয়ে কোমরে হাত রেখে বেশ একটা ভাব নিলেন। চার্লস খুব মনোযোগ দিয়ে তার কথা শোনার চেষ্টা করলেন। সেখানে একজন দোভাষী ছিলেন, যিনি বাংলা ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিচ্ছিলেন,” বলছিলেন পাভেল রহমান।

পরদিন সকালে তখনকার প্রিন্স অব ওয়েলস ব্রিটিশ কাউন্সিলে যান। সেখানে তার সম্মানে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল।

তৎকালীন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী বলছেন, সেই সময় স্কটল্যান্ডের জ্বালানি কোম্পানি কেয়ার্ন এজেন্সি বঙ্গোপসাগরে একটি অফশোর ড্রিলিং করছিল। রাজকীয় হেলিকপ্টারে করে প্রিন্স চার্লস সেটা দেখতে যান।

‘সেই সময় ব্রিটিশ হাইকমিশনার ডেভিড ওয়াকার, ব্রিটিশ ও বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ছিলেন। প্রথমে প্লেনটা চিটাগাং (চট্টগ্রাম) যায়। সেখানে তিনি ব্রিটিশ কাউন্সিলে যান। এরপর আবার এয়ারপোর্টে আবার আমরা কেয়ার্নের প্রজেক্টে যাই, রিগের ওপরে হেলিকপ্টার নামে। উনি কিছুক্ষণ দেখেন, লোকজনের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন এরপর আবার ফিরে আসেন।”

”এই যাত্রার সময়টা তাকে অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে দেখার সুযোগ হয়েছিল। তিনি অনেক কিছু জানতে চেয়েছেন, আমাদের দেশের ইতিহাস সম্পর্কে। আমি কয়েকটা বইয়ের কথা বলেছিলাম, কিন্তু ভাবিনি সেটা আর বেশিদূর এগোবে। কারণ তার মতো ব্যস্ত মানুষদের দিনের মধ্য বহু দেশের বহু মানুষের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয়। কিন্তু আমি অবাক হয়ে গেলাম, কিছুদিন পরে ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকে আমাকে একটা চিঠি দেয়, যে তুমি এই এই বইয়ের নাম বলেছিলে, এগুলোর লেখক কে?”

”আরও আশ্চর্য ব্যাপার, এডিনবরায় কমনওয়েলথ সামিটে আমাকে যখন প্রধানমন্ত্রী নিয়ে যান, সন্ধ্যাবেলায় রিসেপশনে, আমি মনেও করিনি যে তিনি মনে রাখবেন, তার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার পর এগিয়ে যাচ্ছিলাম, হুট করে তিনি পেছন থেকে বলছেন, ওয়েট অ্যা মিনিট, ইউ আর দি ম্যান হু ইন্ট্রোডিউস মি টু সার্টেন বুকস অ্যাবাউট ইয়োর রিজিওন (একটু দাঁড়ান, আপনি তো সেই ব্যক্তি যে, আপনাদের এলাকা সম্পর্কে আমাকে কয়েকটি বই পড়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন)। আমি এখনো অবাক হয়ে যাই, যে মানুষ হাজার হাজার মানুষের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করছেন, তার স্মৃতিশক্তি কতটা প্রখর,” বলছিলেন মি. চৌধুরী।

যদিও যুক্তরাজ্যের রাজপরিবারের ওয়েবসাইট রয়্যাল ডটইউকে এই চট্টগ্রাম সফরের বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। প্রিন্স অব ওয়েলসের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে বলা হয়েছে, ২৬ থেকে ২৮শে ফেব্রুয়ারি তিনি বাংলাদেশ সফর করেন এবং ঢাকা ও সিলেটে যান।

রয়্যাল ডটকমে লেখা রয়েছে, ”এরপর হিজ রয়্যাল হাইনেস উড়োজাহাজে করে সিলেটে যান। সেখানে তাকে স্বাগত জানান বিভাগীয় কমিশনার (হাবিবুর রহমান)। এরপর সিলেট গলফ ক্লাবে স্থানীয় বাংলাদেশিদের একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রিন্স অব ওয়েলস অংশ নেন।”

প্রিন্স অব ওয়েলসের সফরের সেই সময় সিলেটের চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ছিলেন ফখরেউদ্দিন আলী আহমেদ।

তিনি বলছেন, ”তাঁর আসা উপলক্ষে শহরে অনেকগুলো তোরণ করা হয়েছিল। আমরা সংবর্ধনা দিয়েছিলাম। কিন্তু বয়স হয়েছে, খুঁটিনাটি সবকিছু মনে নেই।”

রয়্যাল ডটকমে উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকায় ফেরার পর ”শেরাটন হোটেল একটি সংবর্ধনার পর দ্য প্রিন্স অফ ওয়েলস বিজনেস লিডারস ফোরামের প্রেসিডেন্ট হিসাবে হিজ রয়্যাল হাইনেস ‘পার্টনারস ইন ডেভেলপমেন্ট’ সেমিনারে অংশ নেন। বিকালে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া একটি রাষ্ট্রীয় ভোজে অংশগ্রহণ করেন প্রিন্স অব ওয়েলস”।

এসএইচ-০৬/১৪/২২ (সায়েদুল ইসলাম, বিবিসি)